যে কারনে পতনের কবলে দেশের পুঁজিবাজার
:: প্রকাশ: ২০২২-০২-২৭ ১৮:৫৭:২৭
ইউক্রেন যুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক আতঙ্ক কাটিয়ে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার পতনের খোলস থেকে বেড় হয়ে আসলেও অব্যাহতভাবে দরপতন হচ্ছে দেশের পুঁজিবাজারে।
রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) লেনদেনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দেশের পুঁজিবাজারে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো পতন অব্যাহত ছিল। দিন শেষে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক আগের দিনের চেয়ে ১৬৩ পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে। একই সাথে দিন শেষে ৩৭৫ কোম্পানির মধ্যে ৩৬৫ টির দাম কমেছে।
লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ডিএসইতে প্রধান সূচক দিন শেষে ৬ হাজার ৬৭৬ পয়েন্টে অবস্থান করছে। অপরদিকে, ডিএসইএস শরীয়াহ সূচক ৩০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪৪৫ পয়েন্টে এবং ডিএস৩০ সূচক ৪৭ পয়েন্ট কমে ২ হাজার ৪৬৭ পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে।
একই সাথে ডিএসইতে লেনদেনের পরিমাণ কমছে অব্যাহত ভবে। দিন শেষে লেনদেন হয়েছে ৯১৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। আগের দিন লেনদেন হয়েছিল ১ হাজার ৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ এক কার্য দিবসে লেনদেন হ্রাস পেয়েছে ১৩৪ কোটি ২২ লাখ টাকা।
এদিকে, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক সিএএসপিআই আগের দিনের চেয়ে ৫০৬ পয়েন্ট হ্রাস পেয়ে দিন শেষে ১৯ হাজার ৪৮৫ পয়েন্টে অবস্থান করছে। অপর সূচকগুলোর মধ্যে সিএসসিএক্স ৩০০ পয়েন্ট কমে ১১ হাজার ৬৯৯ পয়েন্টে, সিএসই ৫০ সূচক ৩০ পয়েন্ট কমে ১ হাজার ৪৪৩ পয়েন্টে এবং সিএসই৩০ সূচক ৩২৩ পয়েন্ট কমে ১৩ হাজার ৮২৩ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে।
সিএসইতে ৩০৪টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে ২৮৩ টির শেয়ারে দাম কমেছে। দাম বেড়েছে ৮টি প্রতিষ্ঠানের এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের। দিন শেষে সিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩৩ কোটি ৫৩ লাখ টাকা।
অব্যাহত দরপতনের কারন সম্পর্কে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, কেন এমন হচ্ছে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে ব্রোকারেজ হাউজগুলোর ফোর্স সেলের কারনে এমন হয়ে থাকতে পারে বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেন, অধিকাংশ ব্রোকার হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের নেগেটিভ ইকুইটি রয়েছে। বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে এসব ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট ব্যাংককে নেগেটিভ ইকুইটি থেকে বের হয়ে আসতে নির্দেশ দিয়েছে। এতে ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোতে ফোর্স সেল বৃদ্ধি পাওয়ায় ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতা বেড়েছে, যা দর পতনে ভুমিকা রাখছে।
ডিএসইর সাবেক পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের পরোক্ষ একটি প্রভাব দেশের শেয়ারবাজারে পড়েছে। রাশিয়া ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করার পর বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে তা প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ওপর এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানিতে বড় বড় বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ আটকে আছে। সবকিছু মিলিয়েই শেয়ারবাজারে এই দরপতন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারের দরপতনের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় রয়েছে। প্রথমে তারা বলছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের সীমা বাজার মূল্যের নিয়ম বাদ দিয়ে কস্ট প্রাইস বেসিসে (কেনা মূল্যে) গণনা করবে। কিন্তু তারা পরক্ষণেই গণমাধ্যমে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায় যে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সীমা বাজার মূল্যেই গণনা করা হবে।
তিনি বলেন, শুধু তাই নয়, এখন থেকে প্রতি মাসে কোন ব্যাংক কত শতাংশ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করেছে তার তথ্য দিতে হবে। সর্বশেষ গত ১৫ ফেব্রুয়ারি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের বিষয়ে অপর এক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) নিজস্ব সাবসিডিয়ারি কোম্পানিকে দেওয়া ইকুয়িটি, দীর্ঘমেয়াদি ইকুয়িটি বিনিয়োগ বা ভেঞ্চার ক্যাপিটালকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে না। এর ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের সক্ষমতা কমেছে। এই সার্কুলার জারির পর থেকে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দরপতনের পাল্লা ভারি হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসির এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১১৬টি ব্রোকারেজ হাউজ ও মার্চেন্ট ব্যাংকের নেগেটিভ ইকুইটি রয়েছে ৮ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। ২০১০ সালের ধ্বসের সময়ে এই নেগেটিভ ইকুইটির পরিমাণ ছিল ২১ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ এক যুগে সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা হ্রাস পেয়েছে।
ডিএসইর পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, আমাদের পুঁজিবাজার চলে গুজবে। ফলে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরুর দিন (বৃহস্পতিবার) দেশের পুঁজিবাজারে দরপতন হয়েছে। ইউরোপে যুদ্ধ হচ্ছে তাতে বাংলাদেশের কী কোনো সমস্যা হবে? তারপরও কেন শেয়ার বিক্রি করতে হবে?
তিনি বলেন, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা গুজবে কানে দেন। এ কারণে তারা বেশিরভাগ সময় লস করেন। আর বুদ্ধিমান বিনিয়োগকারীরা সব সময়েই লাভ করেন।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক শেখ সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার কিছুটা সংকট তৈরি হয়েছে। তবে বিভিন্ন কারণে বাজার এমন হতে পারে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কারেকশনের ডাইমেনশন। আর দ্বিতীয়টি হলো- কিছু ক্ষেত্রে পলিসির পরিবর্তন। সেগুলো মার্কেটকে ডি-প্রাইভ করছে।
তিনি বলেন, এ অবস্থায় বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন রাজস্ব নীতি, মুদ্রানীতি ও পুঁজিবাজার নীতি। এই তিনটি নীতি সুসংগঠিত করতে পারলে বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়বে। বিনিয়োগকারীদের অবস্থার পরিবর্তন হবে।
পুঁজিবাজারের সব খবর পেতে জয়েন করুন
Sunbd News–ক্যাপিটাল নিউজ–ক্যাপিটাল ভিউজ–স্টক নিউজ–শেয়ারবাজারের খবরা-খবর
এএ