আফজাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের কলঙ্ক : অরুন্ধতী রায়
প্রকাশ: ২০১৬-০২-২০ ১৫:৫১:৩৪
কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামী নেতা আফজাল গুরুকে ২০০১ সালে ভারতে সংসদ ভবনে হামলার অভিযোগে ফাঁসি দেয়া হয় ২০১৩ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি । প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্র গার্ডিয়ানে তার পরদিনই, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ প্রকাশ হয় বুকার পুরস্কারজয়ী ভারতের ভিন্ন মতাবলম্বী খ্যাতিমান লেখিকা ও মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায়ের একটি নিবন্ধ।
ওই নিবন্ধে তিনি আফজাল গুরুর সঙ্গে ভারতের গণতন্ত্র ও বিচার বিভাগ কী আচরণ করেছে তা খোলাসা করেছেন। অনলাইন থেকে এটির অনুবাদ সংগ্রহ করে এখানে শেয়ার করলাম। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র কিভাবে একজন স্বাধীনতাকামী আন্দোলনের নেতাকে প্রমাণ ছাড়া ফাঁসি দেয় তার বাস্তব চিত্র জানতে লেখাটি সাহায্য করবে।
আফজাল গুরুর ফাঁসি ভারতীয় গণতন্ত্রের কলঙ্ক:
শনিবার ভারতে বসন্ত এসেছে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পরই আইন তার নিজস্ব পথ ধরেছে। এদিন প্রাতঃরাশের কিছুক্ষণ আগেই ভারত সরকার আফজাল গুরুকে কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে ফাঁসি দেয়। ২০০১ সালে সংসদ ভবনে হামলার জন্য প্রধান অভিযুক্ত তিনি। ফাঁসির পর তাকে তিহার জেলে সমাধিত করা হয়েছে। এখানে ১২টি বছর তিনি নিঃসঙ্গ বন্দীজীবন কাটিয়েছেন।
ফাঁসির কথা আফজালের স্ত্রী ও সন্তানদের অবহিত করা হয়নি। তবে ভারতের স্বরাষ্ট্র সচিব দাবি করেছেন যে, দ্রুত ও রেজিস্ট্রি ডাকের মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ তার পরিবারকে অবহিত করে। জম্মু ও কাশ্মীরের পুলিশের মহাপরিচালককে বলা হয়েছে তারা চিঠিটি পেয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখতে। এ নিয়ে এত মাথা ঘামানোর কী আছে! তারা তো একজন কাশ্মীরি সন্ত্রাসবাদীর পরিবারমাত্র।
আফজালের ফাঁসির পর পুরো ভারতে এক নজিরবিহীন ঐক্য দেখা যায়। বিশেষ করে প্রধান রাজনৈতিক দল, যেমন কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ডঙ্কা পিটিয়ে আইনের শাসনের উত্সব পালন করেছে। টিভি চ্যানেলগুলো ‘গণতন্ত্রের বিজয়’ হিসেবে একে চিত্রিত করে আফজালের নানা ঘটনা সরাসরি সম্প্রচার করেছে।
উগ্র হিন্দুবাদীরা ফাঁসির উত্সব উদযাপনের জন্য মিষ্টি বিতরণ করেছে এবং যেসব ছেলেমেয়ে দিল্লিতে প্রতিবাদ জানাতে সমবেত হয়েছিল, তাদের পিটিয়েছে। এমনকি আফজালের ফাঁসি কার্যকর করার পর টিভির ভাষ্যকার ও রাস্তার জনতা কাপুরুষের মতো উল্লাস করেছে। তারা সম্ভবত ভেতরে ভেতরে বুঝতে পেরেছিল যে, তারা ভয়ঙ্কর কোনো ভুল করছে।
ঘটনাটি কী? ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতের সংসদ ভবনের গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ৫ জন সশস্ত্র ব্যক্তি গাড়িবোমা হামলা চালায়। তাদের চ্যালেঞ্জ করা হলে গাড়ি থেকে বের হয়ে তারা গুলিবর্ষণ করে আট নিরাপত্তাকর্মী ও এক মালীকে হত্যা করে। পরে বন্দুকযুদ্ধে হামলাকারী ৫ জনই নিহত হয়।
এরপর আফজাল গুরুকে দিয়ে হামলাকারীদের নাম বলাতে বাধ্য করে পুলিশ। তাদের নাম আমাদের সবারই জানা ছিল। তত্কালীন বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আদভানি বলেছিলেন, তারা পাকিস্তানিদের মতো দেখতে। সিন্ধুতে জন্ম নেয়া আদভানি তো জানবেনই পাকিস্তানিরা দেখতে কেমন।
শুধু পুলিশি হেফাজতে আফজালের স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করেই (প্রক্রিয়াগত বিষয় লঙ্ঘনের দায়ে যাকে সুপ্রিমকোর্ট পরে বাতিল বলে ঘোষণা করেছিল) বিজেপি সরকার পাকিস্তান থেকে ভারতের হাইকমিশনারকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং পাকিস্তান সীমান্তে ৫ লাখের মতো সৈন্য সমাবেশ করে। এ সময় পারমাণবিক যুদ্ধের হুঙ্কার দেয়া হয়। বিদেশী দূতাবাসগুলো এ সময় ভ্রমণ সতর্কতা জারি করে এবং দিল্লী থেকে তাদের অনেক কর্মী প্রত্যাহার করে নেয়। এই অচলাবস্থা কয়েক মাস কার্যকর ছিল এবং এতে ভারতের হাজার হাজার কোটি রুপির ক্ষতি হয়েছে।
ওই ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এনকাউন্টার ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য কুখ্যাত দিল্লি পুলিশের স্পেশাল সেল দাবি করে যে, তারা ঘটনার আসল পরিকল্পনাকারীদের খুঁজে পেয়েছে। এ ঘটনার মূল পলিকল্পনাকারী হিসেবে ১৫ ডিসেম্বর দিল্লি থেকে অধ্যাপক এসএআর গিলানি, কাশ্মীরের শ্রীনগর থেকে শওকত গুরু ও তার চাচাতো ভাই আফজাল গুরুকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর গ্রেফতার করা হয় শওকতের স্ত্রী আফসান গুরুকে।
ভারতীয় গণমাধ্যমে সোত্সাহে পুলিশের ভাষ্যই প্রচার করা হয়। যেমন কয়েকটি শিরোনাম ছিল, ‘দিল্লি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকের বাসায় বোমা হামলার পরিকল্পনা’, ‘ভার্সিটির ডন ফিদাইনদের পরিচালক’, ‘অবসর সময়ে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে ফ্রি লেকচার দিতেন ডন’ প্রভৃতি। জিটিভি ১৩ ডিসেম্বরের ওপর একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করে। এতে দাবি করা হয়, এটি পুলিশের চার্জশিটের ওপর ভিত্তি করে তৈরি সত্য কাহিনী। প্রশ্ন ওঠে, পুলিশি ভাষ্যই যদি সত্য হবে, তবে আদালত কেন?
তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ও আদভানি প্রকাশ্যে ওই তথ্যচিত্রটির ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেটি প্রচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে অস্বীকৃতি জানায় সুপ্রিমকোর্ট। কোর্টের মন্তব্য, গণমাধ্যম বিচারকদের প্রভাবিত করতে পারবে না। গিলানি, শওকত ও আফজালকে একটি দ্রুত আদালতে ফাঁসি দেয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে তথ্যচিত্রটি প্রচার করা হয়। তবে হাইকোর্টে খালাস পান গিলানি ও আফসান গুরু। সুপ্রিমকোর্টও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখে। তবে ২০০৫ সালের ৫ আগস্ট রায়ে সুপ্রিমকোর্ট আফজাল গুরুকে তিনবার যাবজ্জীবন ও দুইবার মৃত্যুদণ্ড দেয়।
২০০২ সালে আফজাল গুরুকে পুলিশ আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময়! বিজেপি অবিলম্বে ফাঁসি কার্যকর করার দাবি জানায়। দলটির অন্যতম নির্বাচনী স্লোগান ছিল- দেশ আবি শরমিন্দা হ্যায়, আফজাল আভিভি জিন্দা হ্যায় (বিদ্রূপাত্মক ছন্দে)। এর অর্থ হলো, আফজাল এখনও বেঁচে থাকা আমাদের জাতির জন্য লজ্জা। এই স্লোগানকে বাস্তবায়িত করার জন্য শুরু হয় মিডিয়া প্রচারণা।
বর্তমানে বিজেপির এমপি ও সেই সময়ে পাইয়োনিয়ার সংবাদপত্রের সম্পাদক চন্দন মিত্র লেখেন, ‘২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে হামলার অন্যতম সন্ত্রাসী ছিলেন আফজাল গুরু। তিনিই প্রথমে নিরাপত্তা রক্ষীদের ওপর গুলিবর্ষণ করেন। নিহত ছয়জনের মধ্যে তিনজনকেই হত্যা করেন আফজাল।’
যদিও পুলিশের চার্জশিটে আফজাল গুরু সম্পর্কে এমন কথা বলা হয়নি। সুপ্রিমকোর্টও তার রায়ে বলে যে, আফজাল গুরুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে দুঃখজনকভাবে এরপরই বলা হয়, ‘ওই ঘটনায় বিপুল সংখ্যক হতাহত এবং এতে গোটা জাতি আলোড়িত হয়েছে। সমাজের সম্মিলিত বিবেক সন্তুষ্ট হবে যদি অভিযুক্তকে ফাঁসি দেয়া হয়।’
সংসদ ভবনে হামলার ঘটনায় আমাদের সম্মিলিত বিবেককে কে চিত্রিত করেছে? সংবাদপত্রের তথ্য? টিভির তথ্যচিত্র? আইনের শাসনের গুণকীর্তন করার আগে চলুন জেনে নিই, আসলে কী ঘটেছিল।
যেসব লোক আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে উত্সবে মাতোয়ারা, তারা যুক্তি দেখাচ্ছেন, ভারতের আদালত গিলানিকে খালাস ও আফজালকে শাস্তি দেয়ায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বিচার স্বচ্ছ হয়েছে।
২০০২ সালের মে মাসে দ্রুত আদালতে বিচার শুরু হয়। তখন বিশ্ব ওয়ান-ইলেভেনের উন্মত্ততায় কাঁপছে। অসময়েই আফগানিস্তানে বিজয় হয়েছে দাবি করে উল্লাস করছে যুক্তরাষ্ট্র। ওই বছরেরই ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গুজরাট রাজ্যে পুলিশ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় মুসলিম নিধন শুরু হয়ে তখনও বিক্ষিপ্তভাবে চলছিল।
বাতাসে ছিল সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। এ অবস্থায় সংসদ ভবনে হামলার বিচার শুরু হয়। ফৌজদারি মামলার বিচারের ঠিক চরম মুহূর্তে যখন হাইকোর্ট, সুপ্রিমকোর্টে বিচার চলে, সাক্ষীদের জেরা করা হয়, যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়, আইনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়, কিন্তু তখন তো আর নতুন কোনো প্রমাণ হাজির করা যায় না।
আফজাল গুরুকে এ সময় হাই সিকিউরিটি সেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় বন্দী করে রাখা হয়। তার কোনো আইনজীবী ছিল না। আদালত এক জুনিয়র আইনজীবীকে নিয়োগ দিলেও তিনি একটিবারের জন্যও আফজাল গুরুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। আফজালের সমর্থনে কোনো সাক্ষীকেও হাজির করা হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের জেরা করেননি তিনি। ওই পরিস্থিতিতে কোনো কিছু করার সামর্থ্য নেই বলে মন্তব্য করেন বিচারক।
তারপরও কিছু তথ্য বের হয়ে আসে। কয়েকটি উদাহরণ হলো, গ্রেফতারের সময় জব্দ করা একটি মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। তবে আইন অনুযায়ী সেগুলো সিলগালা করা হয়নি। বিচারের সময় ফাঁস হয়ে যায় যে, ল্যাপটপের হার্ডডিস্কে গ্রেফতারের পরও হাত দেয়া হয়েছে।
তাতে দেখা যায়, সংসদ ভবনে প্রবেশের ভুয়া অনুমতিপত্রের একটা কপি আছে এবং জিটিভির একটি ভিডিও আছে যাতে সংসদের ভেতর-বাহির দেখানো হচ্ছে। পুলিশ অভিযোগ করেছে যে, আফজাল গুরু সব তথ্য মুছে ফেলেছেন, তাও কেবল এরকম মারাত্মক কয়েকটি নমুনা রেখে দিয়ে!
পুলিশ দাবি করেছে, মোবাইল নম্বর দিয়ে হামলাকারীদের সঙ্গে ২০০১ সালে ৪ ডিসেম্বর যোগাযোগ করেছেন আফজাল। তবে রাষ্ট্রপক্ষের কল রেকর্ডে দেখা যায়, সিমটি ২০০১ সালের ৬ নভেম্বরের পর আর চালু ছিল না। পুলিশ কীভাবে আফজালকে গ্রেফতার করেছিল? পুলিশ বলেছিল, গিলানির সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়।
তবে পুলিশি রেকর্ডে দেখা যায়, গিলানিকে গ্রেফতারের আগেই আফজালকে গ্রেফতার করা হয়। হাইকোর্ট একে স্ববিরোধী বললেও এ নিয়ে আর সামনে আগায়নি। এভাবে মিথ্যা আর সাজানো তথ্যের পাহাড়ের ওপর ভিত্তি করে প্রমাণ হাজির করা হয়। আদালত এসব বিষয় স্বীকার করলেও পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি।
কেউ যদি রহস্যাবৃত সেই সংসদ ভবনে হামলার ঘটনা সম্পর্কে জানতে চান, তাকে এসব প্রমাণ অনুসরণ করে আগাতে হবে। কেউই এটা করেনি। ফলে ষড়যন্ত্রের আসল হোতাদের চিহ্নিত করা যায়নি।
আফজাল গুরুর সত্যিকার কাহিনী ও ট্র্যাজেডি শুধু আদালতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, প্রকৃত ঘটনা জানতে হলে কাশ্মীর উপত্যকার ঘটনাবলি জানতে হবে। এটি একটি পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্র এবং পৃথিবীর সবচেয়ে সামরিকীকরণকৃত এলাকা। এখানে রয়েছে ভারতের পাঁচ লাখ সৈনিক।
প্রতি চারজন বেসামরিক নাগরিকের বিপরীতে একজন সৈন্য! আবু গারিবের আদলে এখানকার আর্মি ক্যাম্প ও টর্চার কেন্দ্রগুলোই কাশ্মীরিদের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বার্তাবাহক। আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিতে সংগ্রামরত কাশ্মীরিদের জঙ্গি আখ্যা দিয়ে এখন পর্যন্ত ৬৮ হাজার কাশ্মীরিকে (মুসলামানকে) হত্যা করা হয়েছে এবং ১০ হাজারকে গুম করা হয়েছে। নির্যাতিত হয়েছে আরও অন্তত এক লাখ লোক।
আফজালের হত্যাকাণ্ডটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। জেলে যে হাজার হাজার কাশ্মীরিকে হত্যা করা হয়েছে, আফজালের জীবন ও মৃত্যু নিয়েও সে রকম অন্ধখেলা চলেছে। ভারতীয় গণতন্ত্রের সব প্রতিষ্ঠানই আফজাল গুরুকে হত্যায় ভূমিকা রেখেছে। এখন তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। আমি আশা করি, আমাদের সম্মিলিত বিবেক এখন সন্তুষ্ট হয়েছে। নাকি এখনও আমাদের রক্তের কাপের অর্ধেকটা খালি?
সানবিডি/ঢাকা/এসএস