কেন সি গ্রেডের যোগ্যরা এ+ পায়!
প্রকাশ: ২০১৬-০২-২৯ ১৮:৪৩:২১
প্রশ্ন এক উত্তরও এক। হুবহু মিলে গেলেও সমস্যা নেই। কারণ সেটা হতেই পারে। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর যখন বেশ কয়েকজন হুবহু দেয় এবং সক’টিই ভুল হয়, তখন আর সেটাকে স্বাভাবিক ভাবার অবকাশ থাকে না। তাহলে ধরেই নিতে হয় সবাই মিলেমিশে একই উত্তর দিয়েছে।
এখনকার নকলের ধরনটা এরকমই। পরীক্ষার্থীরা আর পকেটে, শার্টের কলারের ভাঁজে বা শরীরের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় নকল বেধে পরীক্ষাকেন্দ্রে যায় না। পরীক্ষাকেন্দ্রে নানা মাধ্যমে তাদের জন্য সহযোগিতা আসে। যাকে বলে ‘পোলাপান লিখুক, পাস করে যাক’।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পরীক্ষার কেন্দ্র বসানো থেকে শুরু করে পরীক্ষার কেন্দ্র টিকিয়ে রাখতে যত ধরনের অসদুপায় অবলম্বলন করতে হয় সবই করে থাকে পরীক্ষার কেন্দ্র পেতে ইচ্ছুক প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ।
এর মধ্যে অন্যতম অসদুপায় হচ্ছে পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীদের প্রশ্নপত্র সমাধানে সহযোগিতা করা। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে জেলা, উপজেলা, এমনকি বিভাগীয় পর্যায়ে এমন পরীক্ষা কেন্দ্রও আছে যারা কেন্দ্র টিকিয়ে রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বা ভালো শিক্ষার্থীদের ভাড়া করে আনে পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র সমাধানে সহযোগিতা করার জন্য। পরীক্ষাকেন্দ্রে পরিদর্শকদের সহযোগিতাও আছেই। এতে করে কেন্দ্র যেমন স্থায়ী হয়ে গেলে পরীক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠানও ভালো ফলাফল করলো। এ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে দুই কর্তৃপক্ষই খুশি।
এসএসসি ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের উত্তরপত্রে দেখা যায়, গ্রামার অংশের ৬০ নম্বরের মধ্যে বেশিরভাগ পরীক্ষার্থী ৫৫ থেকে ৫৭ নম্বর পেয়ে যাচ্ছে। তারাই বাকি ৪০ নম্বরের লেটার, সিভি রাইটিং, অ্যাপ্লিকেশন রাইটিং প্যারাগ্রাফ, কম্পোজিশন অংশে ১০, ১৫ নম্বরের বেশি পাচ্ছে না। প্রত্যেকটি বান্ডেলের (৫০টি উত্তরপত্রে) উত্তরপত্রেও আছে যথেষ্ট মিল। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বান্ডেলের সবাই অনেক প্রশ্নে একই ভুল করেছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে উপরের বাস্তবতা।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরীক্ষক বলেন, এখন নকল আগের মতো নেই। তবে যে পদ্ধতিতে হচ্ছে তা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, গ্রামারের ৬০ নম্বরের মধ্যে যে পরীক্ষার্থী ৫৫ পায় সে কী করে বাকি ৪০ নম্বরে ১৫ পায়! ব্যাখ্যা তিনি নিজেই দিলেন, পরীক্ষার হলে পরিদর্শক পরীক্ষার্থীদের সহযোগিতা করছে, পরীক্ষার্থীরা একে অপরকে সহযোগিতা করছে। প্রয়োজনে বাইরে থেকে প্রশ্ন সমাধান করে ভিতরে সরবরাহ দেয়া হচ্ছে। এসব কারণে গ্রামারের ছোট ছোট প্রশ্ন বা এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তরগুলোতে শিক্ষার্থীরা ভালো নম্বর পেয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যখনই তাদের আসল মেধা বা পড়াশোনার বিষয়টি আসে তখন তারা ৪০ নম্বরে ১০-১৫ পাচ্ছে। এতে করে একজন ডি, গ্রেড, সি গ্রেডের পরীক্ষার্থী এ গ্রেড বা এ+ পেয়ে যাচ্ছে।
তবে পরীক্ষার কেন্দ্রে এটাকে নকল মানতে নারাজ অনেক পরীক্ষার্থী। এরকমই একজন বলে, ‘আমরা তো নকল করছি না। দেখা গেলো আমি একটা প্রশ্নের উত্তর পারি না বা মনে পড়ছে না পাশের কাউকে জিজ্ঞাস করলাম। বা পাশের সিটে যে বসলো তারও এমন হলো। আমাদের স্কুলের সবাই একই কেন্দ্রে পরীক্ষা দিচ্ছি। আমাদের পরীক্ষার রুমের সবাই আমাদের গ্রুপের। এটাতো শেয়ার করা।’
অনগ্রসর শিক্ষা পদ্ধতির কারণে এমনি ঘটছে বলে মনে করেন সেভ দ্য চিলড্রেনের পরিচালক, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ম. হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের শ্রেণিকক্ষের অবস্থা খুবই খারাপ। শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের না শিখিয়ে শুধু মুখস্ত করিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষকরা বলে আগামী দিন এ পড়াটা মুখস্ত করে এসো। শিক্ষক যদি বলতেন শিখে এসো তাহলে এ সমস্যাগুলো হতো না।‘
তিনি আরো বলেন, ‘পাঁচটি প্যারাগ্রাফ, পাঁচটি লেটার এভাবে বাছাই করে করে পরীক্ষার্থীদেরই মুখস্ত করানো হয়। এগুলোর বাইরে প্রশ্ন আসলে তখন আর তারা উত্তর দিতে পারে না। তখন যে প্রশ্নেই আসুক তারা যা মুখস্ত আছে তাই লিখে দেয়। পরীক্ষার জন্য পড়াশোনা এমনটা না হয়ে, যদি শেখার জন্য পড়াশোনা হতো তাহলে সবাই শিখতে পারতো।’
এদিকে পরীক্ষা কেন্দ্রে নকলের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান অবু বকর সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘কিছু সংখ্যক কুলাঙ্গার শিক্ষকের কারণেই এমনটা হচ্ছে। শিক্ষকরা ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, এখন ফেল বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। তারা এতো পরিমাণে অনৈতিক কাজ করে যে শিক্ষকজাতির জন্য কলঙ্ক। এসব কুলাঙ্গার শিক্ষকের কারণে আজ এ অবস্থা। এ ধরনের হীনমন্যতা থেকে শিক্ষকরা যদি না বেরোতে পারেন তাহলে আমরা বহুমাত্রিক সমস্যায় পড়ে যাবো।’
তবে পরীক্ষা কেন্দ্রের এ অবস্থার জন্য তিনি জনবল সঙ্কটকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘ঢাকা বোর্ডের অধীনে ৪১৯টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে দেশে ৪১১টি কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিদিন ৪১১টি কেন্দ্রে গিয়ে দেখভাল করার মতো জনবল আমাদের নেই। মাঝে মাঝে জেলা শিক্ষা অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার, সহকারী শিক্ষা অফিসাররা পরীক্ষা কেন্দ্র পরিদর্শনে যান। কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এ পরিস্থিতিতে শিক্ষকদের সৎ হওয়া খুবই জরুরি।’
পরীক্ষার কেন্দ্র নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এ বছর কেন্দ্র নির্ধারণের বিষয়ে আমরা খুবই কঠোর ছিলাম। নিয়মনীতি মেনেই আমরা পরীক্ষা কেন্দ্র নির্ধারণ করা চেষ্টা করেছি।’
বান্ডেল ভিত্তিক একই রকম ভুল এবং গ্রামারে বেশি নম্বর পাওয়ার বিষয়ে আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘এখনো রেজাল্ট হয়নি। রেজাল্ট প্রকাশ হওয়ার পরে বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে পারবো।’ সূত্র: বাংলামেইল