#এক. বাংলাভাষায় যৌন অঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক অধিকাংশ শব্দই অশ্লীল কিংবা গালাগালির শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। (যৌনতা ও গালাগালির টার্গেট অবশ্যই নারী। কোনও পুরুষকে গালি দিলেও টার্গেট হবেন তার মা ও বোন।) যৌনতা ও নারীর প্রতি প্রচলিত ধারণাগুলো ভেঙ্গে দেয়ার জন্য ফেসবুকে আমাদের কিছু বন্ধু ভিন্নধারার লেখা ও মন্তব্য পোষ্ট করেন। এসব লিখতে গেলে বেঁছে বেঁছে কেবল শ্লীলশব্দ ব্যবহার করা যায়না। অতএব তারা শ্লীল এবং অশ্লীল দু’ধরণের শব্দই ব্যবহার করেন। এটা আমাদের ছেলে বন্ধুরা করলে ক্ষতি নেই। কিন্তু মেয়েরা করলে সমস্যা আছে। কারণ অশ্লীল শব্দে পুরুষের একছত্র অধিকার। কোনও নারী সমাজ ভাঙ্গার গান গাইলে তার সম্পর্কে সরাসরি মন্তব্য করা হবে, মাগী, বেশ্যা….. ।
#দুই. নারী যদি একান্ত খোশ গল্পে মাতেন তাহলে তিনি যত অশ্লীল শব্দ ব্যবহারে সক্ষম তিনি তত রসিক ভাবি। গ্রাম, শহর সর্বোত্র রসিক ভাবি ও রসিক দেবরের অভাব নেই। “ভাবিটা অনেক ভাল, জমাতে পারে।” বেশি হলে বলবে, “আপনিও পারেন“। খুব বেশি নেগেটিভিষ্ট হলে বলবে, “মহিলার এত মুখ খারাপ!” এর বেশিনা। তবে ভাষার সে রস নেগেঠিভিষ্ট ভাইও উপভোগ করবেন। কোনও নারী সমাজ ভাঙ্গার গান না গাইলে, প্রচলিত বিশ্বাসকে কটাক্ষ না করলে এবং বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ না করে পুরুষের প্রয়োজনের সঙ্গ দিলে তিনি খারাপ বলে বিবেচিত হননা।
#তিন. কথায় নয়, কাজে যেসব নারী খোলামেলা তাদেরও গ্রহণযোগ্যতার অভাব নেই। এটা সমাজের নিভৃত কথা। নিভৃতে যেটা হয় তাতে ধার্মিক, অধার্মিক, অাস্তিক, নাস্তিক, বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী সবার আগ্রহ। এছাড়াও আছে। বাংলাদেশে এটা কেবল আইনগতভাবে নয়, সমাজগতভাবেও স্বীকৃত। তার নাম বেশ্যাবৃত্তি। বেশ্যা কম। খদ্দের বেশী। বেশ্যার সম্মান নেই। খদ্দেরের সম্মান আছে, সম্ভ্রম আছে।
#চার. বাঙালি সমাজের নারী এবং পুরুষ উভয় লিঙ্গের মানুষ ব্যপকভাবে সমকামী। এই সমকামিতার প্রকাশ তাদের কথায় ও আচরণে সুস্পষ্ট। সমাজে এটাকে দোষের বিষয় বলে মনে করা হয় না। পুরুষের চেয়ে সম্ভবত: বাঙালি নারীরাই বেশী সমকামী। আমার এই কথায় দয়া করে চমকে উঠবেন না। যৌনতার আলোচনা বেশি হওয়ার কথা নারী ও পুরুষের মধ্যে। অথচ বাংলাদেশে যৌনবিষয়ক আলোচনা বেশী হয় নারীতে-নারীতে এবং পুরুষে-পুরুষে। নারী ও পুরুষ মুখোমুখী হলে সেখানে আচরণের শ্লীলতা ও প্রবৃত্তির অবদমন বাঙালি ভদ্রস্থ সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু নারীতে-নারীতে এবং পুরুষে-পুরুষে আলোচনায় শ্লীলতার বাধ রাখতে হয়না। এটা অবদমিত যৌন মননের উচ্ছসিত প্রকাশ। কারণ দুই নারীতে কিংবা চার নারীতে একত্রে গল্প করলে সমাজ দোষি করবে না। পুরুষদের নিজেদের মধ্যে যৌন আলোচনা হলে সমাজ দোষি করবে না। মানসিক সমকামিতা এবং বাক্যের সমকামীতা প্রকাশ্যে এবং সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যেই হয়। শুধু দৈহিক সমকামিতার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রাখা হয়। যৌনতার ক্ষেত্রে বাঙালি কায়-মন-বাক্যে বিকৃত। সমকামীতার প্রবণতা ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে বাঙালি সমাজেই বেশি।
পরবর্তী পয়েন্টে যাওয়ার আগে “নারীর সম্ভ্রম” প্রসঙ্গে ব্লগার (Shammi Haque) শাম্মী হকের একটি লেখা এখানে হুবহু তুলে ধরছি। গত ২৯ মার্চ তিনি লিখেছেন:
“সম্ভ্রম শব্দের অর্থ কী? এই শব্দটির ব্যবহার এখনি বন্ধ করুন। সম্ভ্রম একটি বিশেষ্য পদ। এর অর্থ হিসেবে বাংলা একাডেমীতে উল্লেখ করা হয়েছে- মর্যাদা, সম্মান, মান, গৌরব, সমাদার, ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা।সম্ভ্রম শব্দটি সব থেকে বেশি যে ২টি বিষয়টিতে ব্যবহার করতে দেখেছি ও শুনেছি তা হল-
১। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ৪ লক্ষ নারী ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনায়।
২। যখনই কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে তখনই এই শব্দটির প্রয়োগ অধিক হারে লক্ষ্য করা যায়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন নারী যখন ধর্ষিত হয়, তার কী কী ক্ষতি হয়?
১। শারীরিক ভাবে অসুস্থতা।
২। মানুসিকভাবে অসুস্থতা।
৩। পরিবারকে হেনস্তা করা।
৪। পুলিশ, প্রশাসন দ্বারা হেনস্তা।
এরকম আরো অনেক কিছু।
এখন লক্ষ্য করুন তো, একজন ধর্ষিতার যে ক্ষতিগুলো হয়, সেগুলোকে একটি শব্দে নিয়ে এসে বলা হয় সে ‘সম্ভ্রম’ হারিয়েছে, তার ‘সম্ভ্রম’ কেড়ে নেয়া হয়েছে। সে শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়েছে, তার মানে কি সে তার সম্ভ্রম হারিয়েছে? মর্যাদা হারিয়েছে? গৌরব হারিয়েছে? তাহলে যে ব্যক্তি ছিনতাইকারীর কবলে পরে আহত হয়, যে সন্ত্রাসীর দ্বারা খুন হয়, তাহলে তার ক্ষেত্রে কেনো, ‘সম্ভ্রম/মর্যাদা’ হারিয়েছে বলা হয় না?
আমরা এমন এক জাতি যে, আমরা ধর্ষক এবংনির্যাতিতার সংজ্ঞা গুলিয়ে ফেলেছি, এবং খুব সচেতন ভাবেই এটা হয়েছে। যেখানে- মর্যাদা, সম্মান, মান, গৌরব, সমাদার, ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা এগুলো হারানোর কথা ধর্ষকের, সেখানে এই গুলো হারায় নির্যাতিতা!! কী অদ্ভুত রাষ্ট্র আমার।
আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করুন, কেউ কি কখনো শুনেছেন, কোন পুরুষকে বলা হয়েছে, সে সম্ভ্রম হারিয়েছে? না, আমি শুনি নি। এটা আমার সীমাবদ্ধতা হতে পারে কিংবা আমার শ্রদ্ধেয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিচক্ষনতা হতে পারে। তার মানে এটাই কী স্পষ্ট হয়ে ওঠে না যে, পুরুষের কোন সম্ভ্রম নেই? পুরুষের কোন মর্যাদা, সম্মান, মান, গৌরব, সমাদার, ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা এগুলো নেই? হয়তো, অসম্ভ্রমতাই একজন পুরুষকে আরও বেশি পুরুষ করে তোলে। তাই অসম্ভ্রতাই একজন পুরুষকে গৌরবিত করে!
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে আমরা যেমন বলে থাকি, ৩০ লক্ষ শহিদের আত্মত্যাগে আমাদের এই বাংলাদেশ, তেমনি ৪ লক্ষ মা-বোনের ধর্ষিত হওয়াটাও আত্মত্যাগ, ‘সম্ভ্রম’ নয়।
তনুর ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে, যারা বক্তব্যে, লেখায় ‘তনুর সম্ভ্রম’ কেঁড়ে নেয়া হয়েছে বলে তীব্র নিন্দা জানাচ্ছেন, তাদের জন্য করুণা। আপনাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই চতুর শব্দগুলোকে আমরা কিন্তু লাথি মেরে ভেঙে চুরে দিতে শিখে গেছি। নারী, জোরপূর্বক একদল হিংস্র জানোয়ার তোমার যোনীকে রক্তাক্ত করলে, তোমার সম্ভ্রম হারায় না, সম্ভ্রম হারায় ওই জানোয়ারগুলোর। তুমি আওয়াজ তোলো, গর্জে ওঠো। তনুরা সম্ভ্রম হারায় না, সম্ভ্রম হারায় ধর্ষক, সম্ভ্রম হারায় ধর্ষক চাষ করা রাষ্ট্র।”
#পাঁচ. নারীর প্রতি বিদ্যমান দৃষ্টিভঙ্গি এবং ধর্ষন বিষয়ে প্রচলিত ধারণা বদলানোর জন্য শাম্মীর লেখাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যারা সংবাদ পরিবেশন করি তারাও শব্দপ্রয়োগে অনবধানতা বসত: এধরণের ভূল করে থাকি। ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ধর্ষিত অগণিত নারী প্রসঙ্গে বক্তব্য রাখতে গিয়ে “সম্ভ্রমহানী” শব্দটি ব্যবহার করি। নারীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে হয়তো এটা করিনা; বরং নারীকে একটা বিশেষ সম্মানের জায়গায় রাখতে গিয়ে এবং শ্লীলতা ও অশ্লীলতার প্রচলিত ধারণা থেকে সতর্কতামূলক শব্দ চয়ন করতে গিয়ে আর এক ধরণের অন্যায় করে ফেলি। বিষয়টি খেয়াল করা দরকার।
#ছয়: ফেসবুকে যেসব নারী লেখেন –বিশেষ করে যারা প্রচলিত বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে লেখেন –তাদের লেখার নিচে যেসব মন্তব্য আসে সেগুলো দেখলেই সমাজপ্রবণতা বোঝা যায়। শাম্মীর লেখার নিচে কি রকম সব মন্তব্য পোষ্ট করা হয়েছে দেখুন। ওরা সবাই শাম্মীকে ধর্ষণ করার জন্য উন্মুখ। ওরা শাম্মীকে কাছে পাচ্ছেনা বিধায় ধর্ষণ করার সুযোগ পাচ্ছেনা। তবে ধর্ষনের ইচ্ছা প্রকাশ করছে অকুণ্ঠে। কারণ এদের সম্ভ্রমের সমস্যা নেই। এরা মনে করে, ধর্ষন করলে নারীর সম্ভ্রম যায়, পুরুষের বাহাদূরী বাড়ে। এরা সবাই পুরুষতন্ত্র, প্রচলিত বিশ্বাস এবং ধর্ম রক্ষার বীর! ইসলাম রক্ষার জন্যেও এদের কেউ কেউ অনৈসলামিক শাম্মীদের ধর্ষণ করতে চায়। এদের সম্ভ্রম এদের বিশ্বাস দ্বারা সুরক্ষিত। ধর্ষকদের সম্ভ্রম যাবেনা। শুধু শাম্মী নয়, শাম্মীর চৌদ্দ গোষ্ঠিকে এরা ধর্ষণ করতে চায় এবং ধর্ষণ করে। শারিরিকভাবে ধর্ষণ করতে পারেনা বলে এরা বাক্য দিয়ে ধর্ষণ করে এবং মনে মনে ধর্ষণ করে। কায়-মন-বাক্যে এরা ধর্ষক। এটাই এদের শিক্ষা। এদের আচরণ ও গালিগালাজ যত দেখছি ততই ঘৃণা হচ্ছে।