দেশে এলইডি চিপ তৈরির কারখানা স্থাপনে প্রধান বাধা শুল্ক বৈষম্য

প্রকাশ: ২০১৬-০৪-০৩ ২১:৫৬:৪১


LED Cheap-1বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি (লাইট ইমেটিং ডায়োড) বাল্ব তৈরির প্রধান উপকরণ হচ্ছে এলইডি চিপ। এই চিপ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় আট ধরনের উপাদান। বাংলাদেশে সম্পূর্ণ তৈরি এলইডি চিপ আমদানি করতে ৩০.৭৯ শতাংশ কর দিতে হয়। আর এই চিপ দেশেই উৎপাদন করতে যে আট ধরনের কাঁচামাল লাগে সেগুলো আমদানিতে শুল্ক দিতে হয় ৩৬.৭৮ শতাংশ থেকে ১৩০.২৬ শতাংশ পর্যন্ত।

এই উৎপাদনবিমুখ শুল্ক বৈষম্যই দেশে এলইডি চিপ তৈরির কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। অনেক উদ্যোক্তার আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে গড়ে উঠছেনা এলইডি চিপ তৈরির কারখানা। ফলে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে হাই-টেক শিল্পে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।

উদ্যোক্তারা জানান, দেশে এলইডি চিপ তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানি করতে যে পরিমান কর দিতে হবে তার চেয়ে অনেক কম কর দিতে হয় সম্পূর্ণ তৈরি চিপ আমদানিতে। ফলে, উদ্যোক্তারা দেশে এলইডি চিপ তৈরির পরিবর্তে এটি আমদানি করেই প্রয়োজন মেটাচ্ছেন। এ ধরনের হাই-টেক কারখানা স্থাপনে দেশীয় উদ্যোক্তাদের আগ্রহ থাকলেও কাঁচামাল আমদানিতে বৈষম্যমূলক শুল্ক কাঠামো এ খাতে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করছে বলে মনে করেন তারা।

জানা গেছে, এলইডি বাল্ব বা লাইটের প্রধান উপকরণ এলইডি চিপ তৈরিতে লাগে লিড ফ্রিম, ফসপর, ক্যারিয়ার টেপ, প্লাস্টিক রীল, কভার টেপ, গোল্ড ওয়্যার, ডাই এ্যাটাচ মেটেরিয়াল বা এ্যাডহেসিভ এবং এ্যানক্যাপসুলেশন বা রেসিন। এর মধ্যে লিড ফ্রিম, ফসপর, ক্যারিয়ার টেপ এবং কভার টেপ আমদানিতে ১০ শতাংশ করে কাস্টমস ডিউটিসহ প্রতিটিতে সর্বমোট কর দিতে হয় ৩৬.৭৮ শতাংশ। গোল্ড ওয়্যার, ডাই এ্যাটাচ মেটেরিয়াল বা এ্যাডহেসিভ, এ্যানক্যাপসুলেশন বা রেসিন এর আমদানিতে ২৫ শতাংশ কাস্টম ডিউটি, ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কসহ কর দিতে হয় ৬০.০২ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি কর দিতে হয় প্লাস্টিক রীল আমদানিতে। এটিতে আরোপ করা হয়েছে ২৫ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ৪৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক, ৫ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কসহ সর্বমোট ১৩০.২৬ শতাংশ কর। অন্যদিকে বাইরে থেকে সম্পূর্ণ তৈরিকৃত এলইডি চিপ আমদানিতে সব মিলিয়ে কর দিতে হয় ৩০.৭৯ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এলইডি প্রযুক্তির যতো পণ্য রয়েছে যেমন টিভি, ফ্রিজের লাইট, মোবাইল, ট্যাব এবং কম্পিউটার মনিটরের প্রধান কাঁচামাল হলো এলইডি চিপ। এই শুল্ক বৈষম্যের কারনে আমদানিকৃত এলইডি চিপ দিয়ে তৈরি পণ্যের তুলনায় দেশে তৈরি চিপ দিয়ে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী এলইডি পণ্য উৎপাদনে খরচ পড়বে অনেক বেশি। এতে করে, মূল্য প্রতিযোগি সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়বেন দেশীয় উদ্যোক্তরা। ঝুঁকিতে পড়বে এই খাতের বিনিয়োগ। ফলে এলইডি চিপ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা।
সানটেক্স ইলেকট্রনিক্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এর চেয়ারম্যান শামসুল আরেফীন সোহেল বলেন, দেশের স্বার্থে এ ধরনের শুল্ক বৈষম্য দূর করা দরকার। সরকার একদিকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী পণ্য উৎপাদনের আহবান জানাচ্ছে, অন্যদিকে এলইডি চিপ তৈরির কাঁচামালের উপর অত্যধিক শুল্ক আরোপের মাধ্যমে দেশীয় উৎপাদনকে নিরুৎসাহিত করছে।

বর্তমানে আমদানি করা চিপ দিয়ে উৎপাদন করা হচ্ছে এলইডি বাল্ব, টিভিসহ অনেক ধরনের পণ্য। আবার অনেকে সরাসরি সম্পূর্ণ প্রস্তুত বিভিন্ন এলইডি পণ্য আমদানি করছে। যেহেতু দেশে এলইডি চিপের পূর্ণাঙ্গ কোনো কারখানা এখনো গড়ে উঠেনি, তাই একচেটিয়া ব্যবসা করছেন আমদানিকারকরা। আবার কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় নি¤œ মানের এলইডি চিপ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য আমদানি করছে। এতে করে অল্প কয়েকদিন ব্যবহারের পরই নষ্ট হয়ে যায় পণ্য। প্রতারিত হচ্ছেন গ্রাহকরা।
সোহেল আরো বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা নি¤œমানের এলইডি চিপ থেকে লীড বা সীসা নির্গত হয় অনেক বেশি। যা পরিবেশের জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। বিদেশ থেকে আমদানি করা এলইডি চিপ বুয়েটে টেস্ট করার জন্য সরকারকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম । কিন্তু, তা আর কার্যকর হয়নি।

শামসুল আরেফীন সোহেল আরো বলেন ’যদি দেশেই উচ্চ প্রযুক্তি ও মান সম্পন্ন এলইডি চিপ উৎপাদন কারখানা গড়ে উঠতো, তাহলে নিজস্ব তত্ত্ববধানে মান নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো। এতে করে পরিবেশের ক্ষতি যেমন এড়ানো যেত তেমনি গ্রাহকরাও উচ্চ গুণগতমানের এলইডি পণ্য কিনতে পারতেন। পাশাপাশি, এ ধরনের উচ্চ প্রযুক্তি পণ্য উৎপাদনে দেশও অনেক এগিয়ে যেতো।’ এলইডি চিপ তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানিতে বিদ্যমান শুল্ক বৈষম্য দূর হলে দেশীয় অনেক উদ্যোক্তা বিনিয়োগে এগিয়ে আসবেন বলে জানান তিনি।
এবিষয়ে এডিবি (এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক) এর বাংলাদেশ পার্টের সাবেক প্রধান অর্থনীতি মুহাম্মদ জাহিদ হোসেন বলেন, ফিনিশড প্রোডাক্টের উপর কর হার বেশি হবে এবং কাঁচামালের উপর কম হবে এটাই স্বাভাবিক । এর ব্যতয় হলে উৎপাদন খাত টেকসই হবে না এবং স্থানীয় উৎপাদন নিরুৎসাহিত হবে।

উল্লেখ্য, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বরাবরই দেশীয় শিল্পের পক্ষে কথা বলে থাকেন। গত বুধবার সচিবদের সঙ্গে প্রাক বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, আগামি বাজেটে দেশীয় শিল্পের স্বার্থরক্ষায় জোর দেয়া হবে। ইতিপূর্বে দেখা গেছে, যেসকল খাতে সরকার নীতি সহায়তা দিয়েছে সেসব খাত দ্রুত উঠে এসেছে। বিপুল কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অজর্নও সম্ভব হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ওষুধ, রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি শিল্পের কথা আসে। দেশীয় উদ্যোক্তাদের প্রত্যাশা, অর্থমন্ত্রী তথা সরকার বিষয়টিতে নজর দেবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভারতে এলইডি চিপ তৈরির কারখানা স্থাপনে উদ্যোক্তাদেরকে উৎসাহিত করতে কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক সহযোগিতা দিয়েছিল সরকার। ফলে, উচ্চ প্রযুক্তির এলইডি পণ্য উৎপাদনে ভারত এখন অনেক এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশেও হাই-টেক শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হলে সরকারকে প্রয়োজনীয় শুল্ক ও নীতি সহায়তা প্রদান করতে হবে। অন্যথায়, প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশে অন্যান্য দেশের তুলনায় ক্রমশঃ পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ।