দুঃস্বপ্ন এখনো তাড়া করে সেই গারো তরুণীকে
প্রকাশ: ২০১৬-০৪-০৪ ১১:২৬:৩৪
গারো জাতিগোষ্ঠীর তারুণীকে (২২) গণধর্ষণের পর হত্যা করার চেষ্টা ছিল ধর্ষকদের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেদের বাঁচাতে তারা ওই তরুণীকে ফেলে চলে যায়।
এ ঘটনায় বেশ কয়েকজন জড়িত থাকলেও পুলিশ দুজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে। মামলাটি এখন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন বলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে। গত বছর ২১ মে কর্মস্থল থেকে বাসায় ফেরার পথে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে দুর্বৃত্তরা ওই তরুণীকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ওই সময় গারো সম্প্রদায় এমনকি সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে।
ঘটনার তদন্ত প্রথম থেকেই করছিলেন ভাটারা থানার ওসি (তদন্ত) সাজ্জাদ হোসেন। রোববার তিনি বলেন, ঘটনার সঙ্গে প্রকৃত অর্থে কারা জড়িত, সাত-আট মাস তদন্ত করে তা শনাক্ত করা হয়। একই সঙ্গে তাদের গ্রেফতারও করা হয়। ওই দুজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এখন মামলার বিচারে শুনানি চলছে।
থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার পর ওই তরুণী অজ্ঞাত পাঁচজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। তিনি ৫ জনকে সন্দেহ করেছেন। ড্রাইভারের সঙ্গে আরো ৪ জন ছিল। পুলিশ মেয়েটির সহকর্মী আরিফ ও শফিউল্লাহ দেওয়ানকে গ্রেফতার করে। অভিযোগ আছে যে, নানামুখী চাপের কারণে সে সময় আসামিদের না খুঁজে এই গ্রেফতারকৃত দুজনকেই আসামি করে তদন্ত শেষ করা হয়। গ্রেফতারকৃত দুজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
অভিযোগ আছে যে, মেয়েটির তথ্যকে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করলে সব আসামি শনাক্ত হতো। কিন্তু তা হয়নি নানা কারণে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-৫-এ এই মামলার বিচার চলছে। এর বিচারক তানজীনা ইসমাইল। আগামী মাসে মামলার শুনানি হওয়ার কথা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মামলায় সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। তদন্ত চলাকালে তারা যে ঠিকানা দিয়েছিল সেই ঠিকানায় তাদের এখন পাওয়া যাচ্ছে না। আর মামলার শুনানিতে যদি সাক্ষী হাজির করা না যায় তাহলে বিচার-প্রক্রিয়া অনেকাংশে বিলম্ব হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আসামিরা আইনের ফাঁক গলে কারাগার থেকে বের হয়ে আসতে পারেন। ওই দুই আসামি এখনো কারাগারে আছেন।
ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে মেয়েটি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘সেদিনের ভয়ংকর স্মৃতি এখনো আমাকে তাড়া করে। মাঝেমধ্যেই ঘটনা মনে পড়ে। কিন্তু এমন একটি ঘটনা যে কারো সঙ্গে শেয়ার করতে পারছি না। আমাকে যারা হেনস্তা করেছে তাদের সবাই এখনো গ্রেফতার হয়নি। মামলার তদন্ত বা বিচার কোন পর্যায়ে, তাও আমি জানি না। কেননা, আমাকে কোনো কিছু বলা হয় না। আর এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে বিচার পাব কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘বিচারের আশা আমি এখনো ছাড়িনি। কেননা, এ ঘটনার পর আমাদের গোষ্ঠীর লোকজন এবং অনেকেই খোঁজ রাখছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’ বিচার দেরি হওয়ায় এ ধরনের অপরাধ আরো বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দোষীদের দ্রুত বিচার করতে হবে। বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি করা গেলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।’
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘আমাদের দেশে নারীদের ওপর সহিংসতা বেড়েই চলেছে। আমরা সরকারকে বলতে চাই, আমাদের যে গারো আদিবাসী বোনটি ধর্ষিত হয়েছে, এর অপরাধীদের অবিলম্বে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।’
মানবাধিকারকর্মী অ্যাডভোকেট সালমা আলী এ ব্যাপারে বলেন, ‘আমরা এ ধরনের ভুক্তভোগীর পক্ষে সব সময় কাজ করছি। এটিও আমরা নজরে রেখেছি। বিচার চলছে। প্রয়োজনে মহিলা আইনজীবীরা কেবল এই তরুণীর পাশেই নয়, সারা দেশে এ রকম ভুক্তভোগীর পাশে থাকবেন।’
বেসরকারি সংস্থা ‘নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশী কবির বলেন, ‘আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। কিন্তু তারপরও কেন ধর্ষকেরা গ্রেফতার হয় না? এ ধরনের অপরাধীদের গ্রেফতার করে দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
গত বছর ২১ মে রাতে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে আদিবাসী গারো তরুণীকে (২২) মাইক্রোবাসে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে পাঁচজনে ধর্ষণ করে। মেয়েটির গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়।
এ ঘটনায় সামাজিক গণমাধ্যম থেকে শুরু করে সারা দেশে ঘটনার প্রতিবাদ এবং নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। বাংলাদেশ গারো ছাত্র সংগঠন (বাগাছাস), গারো স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (গাসু) ও আরো বিভিন্ন আদিবাসী সংগঠন এবং সামাজিক সংগঠন বিক্ষোভ করতে থাকে। ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। ধর্ষকদের শাস্তির দাবিতে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম মহানগর শাখার যৌথ উদ্যোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ হয়। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহলেও।
এই ধর্ষণের ঘটনায় মামলা নিতে বিলম্ব করায় রাজধানীর উত্তরা, খিলক্ষেত, গুলশান থানার সংশ্লিষ্ট পুলিশের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। ওই সময় চার সপ্তাহের মধ্যে সংশ্লিষ্টদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়। পরে ভাটারা থানায় মামলা করা হয়। সূত্র: রাইজিংবিডি