স্বাগতম বাংলা নববর্ষ ১৪২৩
আপডেট: ২০১৬-০৪-১৪ ১১:৪৯:৩২
স্বাগতম বাংলা নববর্ষ ১৪২৩। নতুন স্বপ্ন, উদ্যম ও প্রত্যাশার আলোয় রাঙানো নতুন একটি বছর।
‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা/ অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা। এসো, হে বৈশাখ এসো, এসো।’ সকল না পাওয়ার বেদনাকে ধুয়ে মুছে, আকাশ-বাতাস ও প্রকৃতিকে অগ্নিস্নানে শুচি করে তুলতেই আবার এসেছে পয়লা বৈশাখ।
বৈশাখের নবপ্রভাতেই বাঙালির তাই কায়মনো প্রার্থনা- যা কিছু ক্লেদাক্ত, গ্লানিময়, যা কিছু জীর্ণ বিশীর্ণ দীর্ণ, যা কিছু পুরনো- তা বৈশাখের রুদ্র দহনে পুড়ে হোক ছাই।
গ্রীষ্মের এই তাপস-নিঃশ্বাস বায়ে পুরনো বছরের সব নিষ্ফল সঞ্চয় উড়ে যাক-দূরে যাক, যাক দূর-দিগন্তে মিলিয়ে।
আজ বাংলার চারদিক বর্ষবরণের উৎসবের আমেজে মুখরিত থাকবে। গ্রীষ্মের অগ্নিজিহবাও কাল হয়তো বাতাসে লকলক করে নেচে উঠবে। অগ্নিবরণ নাগনাগিনীপুঞ্জও তাদের সঞ্চিত বিষ উগড়ে দিবে বাংলার ভূ-প্রকৃতিতে। তারপরও বাঙালি এই খরতাপ উপেক্ষা করে মিলিত হবে তার সর্বজনীন অসাম্প্রদায়িক উৎসবে।
বাংলা নববর্ষে মহামিলনের এ আনন্দ উৎসব থেকেই বাঙালি ধর্মান্ধ অপশক্তির কূট ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করবার আর কুসংস্কার ও কুপমন্ডুকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবার অনুপ্রেরণা নেবে এবং হবে ঐক্যবদ্ধ।
নতুন বছর মানেই এক নতুন সম্ভাবনা, নতুন আশায় পথ চলা। বুকভরা তেমনি প্রত্যাশা নিয়ে নতুন উদ্যমে ও চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতি আজ শপথ নেবে সকল কল্যাণের ।
সম্রাট আকবরের প্রিয়পাত্র আবুল ফজলের আইন-ই- আকবরী পাক ভারত উপমহাদেশের একটি প্রামাণিক ইতিহাস। এই গ্রন্থে বিক্রমজিত নামে একজন প্রাচীন ভারতীয় নরপতির নাম পাওয়া যায়। তার সিংহাসনারোহণের দিন হতে তিনি একটি নতুন অব্দ প্রচলন করেছিলেন।
সম্রাট আকবরের রাজত্বের ৪০তম বছরে ঐ সালটির ১৫১৭ অব্দ চলছিলো। সম্ভবত এই প্রাচীন সালটিই আমাদের বর্তমান বাংলা সনের উৎস।
বাংলা সনের উৎপত্তি সর্ম্পকিত ইতিহাসে জানা যায় আকবরের রাজত্বের ২৯ বছর কালে, কতিপয় বিখ্যাত ভারতীয় জ্যোতির্বিদের সহায়তায় সম্রাট আকবর উপরোক্ত সালটিকেই সংস্কার পূর্বক গ্রহণ করেছিলেন এবং সর্বভারতে তা প্রচলিত হয়েছিল ।
তবে বঙ্গাব্দের সাথে আকবর প্রবর্তিত ‘তরিখ- ই-ইলাহি’ সম্পৃক্ততা এই বিষয়ে গবেষকরা সকলেই মেনে নিয়েছেন এমন নয় । বেশ কিছু ইতিহাসবিদ, গবেষক বঙ্গাব্দের উৎস নিয়ে ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। অনেক পন্ডিত মনে করেন রাজা শশাঙ্কই হলেন বঙ্গাব্দের মূল প্রবর্তক।
এদের মতে শশাঙ্কের রাজ্যাভিষেকের দিন থেকে এই অব্দ চালু হয়েছিল।এই বক্তব্যের প্রবক্তা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার একটি লেখায় বলেছেন, ৫৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ এপ্রিল, পহেলা বৈশাখ, সোমবার বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়। ঐ দিনেই শশাঙ্ক গৌড়বঙ্গে স্বাধীনভাবে রাজত্ব শুরু করেন।
নববর্ষকে সামনে রেখে এমিরেটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “নতুন বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে পারবো বলে আমার প্রত্যাশা। যার মধ্যে দিয়ে দেশে সহনশীলতা ও উদারতার পরিবেশ সৃষ্টি হবে।”
ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন বৈশাখকে কেবল আনন্দের নয়, প্রতিবাদের মাস হিসেবেও আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে যে সহিংস ঘটনাগুলো ঘটছে তা স্বাধীনতাবিরোধীদেরই কাজ। তাদের কঠোর হস্তে প্রতিরোধ করতে হবে। বৈশাখ আমাদের সেই অপশক্তি রুখে দাঁড়াবার শক্তি যোগাবে।
নববর্ষ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটির দিন। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা , বিরোধীদলের নেতা রওশন এরশাদ দিনটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহে এবারই প্রথম চালু হয়েছে বৈশাখী ভাতা, যা এবারের উৎসবে যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা।
জাতীয় সংবাদপত্রগুলো বাংলা নববর্ষের বিশেষ দিক তুলে ধরে ক্রোড়পত্র বের করেছে।
সরকারি ও বেসরকারি টিভি চ্যানেলে নববর্ষকে ঘিরে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালা প্রচার করছে।
বাংলা ১৪২২ সালকে বিদায় এবং নববর্ষ ১৪২৩ বরণকে কেন্দ্র করে তিন পার্বত্য জেলার আদিবাসী সম্প্রদায় প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্য দিয়ে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালা পালন করছে।
বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে সকল কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) উন্নতমানের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবার পরিবেশন করা হবে।
শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হবে। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং প্রত্মতত্ত্ব অধিদপ্তরের ব্যবস্থাপনায় জাদুঘর ও প্রত্মস্থানসমূহ সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। শিশু-কিশোর, প্রতিবন্ধী ও ছাত্র-ছাত্রীরা বিনা টিকেটে আজ জাদুঘর পরিদর্শন করতে পারবে।
সকাল থেকেই অন্যান্য দিন থেকে ভিন্ন সাজে সেজেছে রাজধানী ঢাকার দৃশ্যপট।
শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও মেলায় বর্ণবহুল হয়ে উঠবে নগরী।
বরাবরের মতই ভোর সোয়া ছ’টায় রমনার বটমূলে ছায়ানটের প্রভাতী অনুষ্ঠানে ভোরের সূর তুলে শুরু হয় বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা।
এর সঙ্গে সঙ্গেই রমনার বটমূল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডির লেকের পাড়, সংসদ ভবনসহ শেরেবাংলা নগর, গুলশান, বনানী, উত্তরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, অর্থাৎ এক কথায় পুরো রাজধানীই বৈশাখী আমেজে মেতে উঠছে।
কাকডাকা ভোর থেকেই নগরীর পথে ঢল নামতে দেখা গেছে বাঙালি সংস্কৃতি লালনকারী আনন্দপিয়াসী নগরবাসীর। সবার পরনেই বৈশাখী রং লাল-সাদার পাশাপাশি অন্যান্য রঙের বাহারি নকশার পোশাক।
নগরীর অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলো এবং রমনা ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশেপাশে ভ্রাম্যমাণ রেস্টুরেন্টগুলো আয়োজন করেছে ইলিশ-পান্তার ।
অনেকের বাসাবাড়িতে তৈরি হবে বাঙালি খাবার-ইলিশ মাছভাজা, শুটকি-বেগুন-ডাল-আলু-কালিজিরাসহ নানা পদের ভর্তা। আবার অনেকের ঘরে সর্ষে ইলিশও থাকবে। কায়মনে বাঙালি হয়ে উঠার বাসনা ছাড়া সব কিছুই তুচ্ছ মনে হবে সকলের।
জাতি, ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই নয়, পৃথিবীর যেখানেই বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে, সেখানেই বর্ণাঢ্য উৎসবের পালিত হবে পয়লা বৈশাখ।
বাঙালীর এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে রমনা পার্কসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয়েছে নিরাপত্তা চাদরে। শুধু রাজধানী ঢাকাই নয় এ উপলক্ষে সারাদেশই নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থা ও তাদের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যৌথভাবে কাজ করছে সব সংস্থা। বিভিন্ন সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকেও নিরাপত্তা নিয়ে নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ।
সার্বিক নিরাপত্তা ও নজরদারি নিশ্চিত করতে বসানো হয়েছে কন্ট্রোল রুম, অবজারভেশন পোস্ট ও চেকপোস্ট। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি থাকছে গোয়েন্দা দলের সদস্য, বোমা ডিসপোজাল টিম ও মেডিক্যাল টিম।
বর্ষ আবাহনে মূল অনুষ্ঠানসমূহ
বর্ষবরণে রাজধানী জুড়ে নানা ধরনের আয়োজন লক্ষ্য করা গেছে। দিনের প্রথম প্রভাতেই রমনার বটমূলের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছায়ানট ভোরের সুর্যের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই ভোর সোয়া ছ’টায় শুরু করে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। শেষে দেশের সাম্প্রতিক সময় ও এর পরিবেশ তুলে ধরে বক্তৃতা দেন ছায়ানট সভাপতি ড. সনজীদা খাতুন।
চারুকলার শিক্ষার্থীরা সকালে বের করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এ বছর ‘মা ও শিশু’কে চেতনায় ধারণ করে ‘অন্তর মম বিকশিত কর অন্তর তর হে’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনের রেখে শোভাযাত্রাটি চারুকলা থেকে বের হয়ে রূপসী বাংলা হোটেল চত্বরে ঘুরে আবার চারুকলার সামনে এসে শেষ হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর কর্মসূচির মধ্য রয়েছে, নববর্ষ বরণ উপলক্ষে চারুকলা অনুষদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক সভাযাত্রায় নেতৃত্ব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, চারুকলা ইনস্টিটিউটে দিনব্যাপী চলবে পুতুল নাচ ও নাগরদোলা। বাংলা বিভাগ ও বাংলা অ্যালামনাইয়ের উদ্যোগে কলাভবন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান।
সংগীত বিভাগ সকাল ৮টায় বিশ্ববিদ্যালয় বটতলায় সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছে । থিয়েটার এন্ড পারফরমেন্স স্টাডিজ বিভাগের উদ্যোগে নাট-ম-ল প্রাঙ্গণে বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে পট-গান ও দেশের গান।
মল চত্বর এলাকায় অনুষ্ঠিত হবে এক মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে আরও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন থাকবে। মুহসীন হল মাঠে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে খাবারের আয়োজন।
বর্ষবরণ উপলক্ষে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সকাল ৭টায় বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়, যাতে বাংলার লোকজ সংস্কৃতির নানা উপকরণ শোভা পায়। এ র্যালিতে জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট আজ বিকাল ৪টায় ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে একক ও দলীয় লোকসঙ্গীত, নৃত্য ও আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন করেছে। বাংলা একাডেমি সকাল ৮টায় একাডেমীর নজরুল মঞ্চে বর্ষবরণের সঙ্গীত দিয়ে দিবসটি উদযাপন করে।
বর্ষবরণ উপলক্ষে চ্যানেল আই ও সুরের ধারা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রাঙ্গণে পঞ্চম বারেরমত আয়োজন করেছে হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। এখানে মেলার আয়োজনও থাকছে। অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করছে চ্যানেল আই।
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির মেলাপ্রাঙ্গণেবৈশাখী মেলার আয়োজন করেছে। জাতীয় প্রেসক্লাব বর্ষবরণে তাদের সদস্য ও পরিবারবর্গের জন্য সকাল থেকেই খৈ, মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা সহ বিশেষ ভোজের আয়োজন করেছে।