গুপ্তহত্যা সরকার পতনের কারণ হবে কী?

প্রকাশ: ২০১৬-০৪-২৬ ১১:০৬:০৮


Abusalah.Sunbdমুঘল সম্রাট বাবর তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন: ‘বাংলাদেশে অদ্ভুত রীতি আছে এখানে জনগণ সিংহাসনকে শ্রদ্ধা করে। রাজাকে হত্যা করে যে কোনো ব্যক্তি সিংহাসনে বসুক না কেন তাকে সকলে রাজা বলে স্বীকার করে।’ সম্রাট বাবর এর ওই উক্তি যে মিথ্যা নয়; তা ঐতিহাসিকভাবে আমরা বহুবার প্রমাণ করেছি। ইংরেজ বাহিনীর সাথে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ বনাম নবাব বাহিনীর যুদ্ধে জনতা নিরব দর্শক হিসেবে ইংরেজদের সিংহাসন দখলকে উপভোগ করেছে। বাংলার জনসাধারণের ওই মানসিকতার পরিচয় আমরা ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভের বক্তব্য থেকেও পেয়েছি। রবার্ট ক্লাইভ লিখেছেন: ‘২৯ শে জুন, তিনি ২০০ ইউরোপীয় ও ৫০০ দেশীয় সৈন্য নিয়ে বিজয় গর্বে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করেন। এই উপলক্ষ্যে বহু লক্ষ দর্শক উপস্থিত হয়। তারা ইচ্ছা করলে শুধু লাঠি ও ঢিলা দিয়েই ইউরোপীয় সৈন্যদের মেরে ফেলতে পারত। কিন্তু বাঙালিরা তা করেনি।’

বংশ পরম্পরায় বাঙালির ওই মানসিকতাই তার জন্য সর্বনাশের কারণ হয়েছে। ১৭৫৭ সালে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হলেও বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের বিরুদ্ধে তারা রুখে দাঁড়ায়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার পরও খুনিদের ক্ষমতা গ্রহণের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে রাজপথ কাঁপিয়ে তোলেনি। বছরের পর বছর সামরিক শাসকরা এদেশের গণতন্ত্রের টুটি চেপে ক্ষমতায় থাকলেও জনতা খুব কমই ওই সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে।

অন্যায়কে মেনে নেয়ার বাঙালির অসম্ভব ক্ষমতা, সবকিছুকে মেনে নেয়ার প্রবণতাই আজ কতিপয় নষ্ট রাজনীতিবিদদের অন্যায়ের পর অন্যায় করতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। তনুরা বারবার ধর্ষিত হচ্ছে। হলমার্ক, ডেসটিনি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারির পর বাংলাদেশে ব্যাংকের ১০০ মিলিয়ন ডলার রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা ঘটেছে। অফশোর ব্যাংকিংয়ের আড়ালে অনায়াসে সাবেক এক মন্ত্রী ৩৪০ কোটি টাকা পাচার করতে পেরেছে সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। একের পর এক ব্লগার হত্যার ঘটনা ঘটছে। জনগণের নিরবতায় এখন অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীর মতো নিরিহ শিক্ষকরাও রক্ষা পাচ্ছে না। আস্তিক-নাস্তিক দ্বন্দ্বে জনগণের অদ্ভুত পক্ষপাতিত্ব আজ অধ্যাপক রেজাউলকে হত্যা করে হত্যাকে জায়েজ করতে তাকে নাস্তিক বানাতে খুনি চক্রের অপতৎপরতা বেশ হালে পানি পাচ্ছে।

আজ হয়তো অধ্যাপক রেজাউল করিমকে হত্যার পর নাস্তিক বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। জনগণ যদি এর  জোরালো প্রতিবাদ না করে; তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি যে পথে হাঁটছে কাল হয়তো পারিবারিক অথবা অন্য কোনো কারণে আপনাকে হত্যা করা হলে খুনিরা খুব সহজে আপনাকে নাস্তিক উপাধি দিয়ে পার পেয়ে যাবে। সবার মনে রাখা উচিত। নগর পুড়লে দেবালয়ও রক্ষা পায় না।

দুই.
ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইল জ্বালিয়ে দেয়ার তৎপরতায় একটি গোষ্ঠী তৎপর হলেও আমরা ওই গোষ্ঠীকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে কেন পারছি না সেই প্রশ্ন জাগছে মনে। আমাদের ঘুম কেন ভাঙছে না? তবে কি মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলেই তবে আমাদের ঘুম ভাঙবে! সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের কী কোনো দায়বদ্ধতা নেই? একের পর এক হত্যার উৎসবে মেতে ওঠা ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারীদেরকে সামাজিকভাবে প্রতিহত করা কী আমাদের নৈতিক দায়িত্ব নয়? আমরা কী সামাজিকভাবে পারি না দল-মতের উর্ধ্বে উঠে জঙ্গিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে? রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগই বা কি করছে? মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলেও নগর-বন্দর, গ্রাম-গ্রামান্তরে অথবা পাড়া-মহল্লা পর্যন্ত সাংগঠনিকভাবে বিস্তৃত এই রাজনৈতিক দলটি কেন জঙ্গিদের প্রতিরোধ করছে না, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলছে না সে এক মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন। হয়তো আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হবে- জঙ্গিরা হঠাৎ এসে আক্রমণ করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। তাই তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলে কি হবে! কিন্তু একথা তো ঠিক জঙ্গিরা যতগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সব হত্যাকাণ্ডই জনতার সম্মুখেই হয়েছে। জনগণ ভয়ে পালিয়েছে বলেই নির্বিঘ্নে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পেরেছে। কিন্তু জনগণ যদি রুখে দাঁড়াত। তবে ওই দুই-তিন অথবা চার-পাঁচ জন জঙ্গির পক্ষে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যাওয়া অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হত।

আমরা আগুন সন্ত্রাসের সময় দেখেছি- প্রথম দিকে আগুন সন্ত্রাসীরা গাড়িতে পেট্টোল বোমা মেরে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেত। কিন্তু যখন জনগণ প্রতিরোধ করতে শুরু করল তখন একের পর এক আগুন সন্ত্রাসী ধরা পড়ল। জনগণের প্রতিরোধে শেষপর্যন্ত আগুন সন্ত্রাসীরা পিছু হটতে বাধ্য হল। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ আগুন সন্ত্রাসী প্রতিরোধের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম প্রতিরোধ করার জনগণকে সচেতন করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে জনগণের সচেতনা আর সামাজিক আন্দোলন ছাড়া জঙ্গি তৎপরতা ও গুপ্তহত্যা বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব। তাই রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে হবে। অন্যথায় ইতিহাসের কাঠ গড়ায় তাদেরকেও দাঁড়াতে হবে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব ছিল জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গুপ্তহত্যা ও জঙ্গিদের তৎপরতা বন্ধ করা। কিন্তু তারা তা পালনে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।

বিএনপি-জামায়াতের উপর দোষারোপ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। দুর্বৃত্তরা-জঙ্গিরা সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে রাষ্ট্রকে বিপন্ন করতে চাইবে। আর ওই গোষ্ঠীর হাত থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্যই তো একটি দেশে সরকারের দরকার পড়ে। ওই গোষ্ঠী যদি নির্বিঘ্নে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে পারে তাহলে দেশে সরকারের কি দরকার আছে? আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারকে এই বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। অন্যথায় দেশ যে পথে এগিয়ে যাচ্ছে, জঙ্গিরা যেভাবে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সফল হচ্ছে, ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে তাতে  আওয়ামী লীগের প্রতি, বর্তমান সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ বাড়ছে। যা শেষপর্যন্ত সরকার পতনের কারণ হয়ে উঠতে পারে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ সব ঘটনাকে ‘বিছিন্ন ঘটনা’ না বলে আওয়ামী লীগ ও সরকার যত দ্রুত এ সত্য উপলব্ধি করবে ততই তাদের জন্য মঙ্গল হবে। দেশ ও জাতি জঙ্গিবাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।

সানবিডি/ঢাকা/এসএস