ভ্যাট ১৫ শতাংশই থাকছে: অর্থমন্ত্রী
আপডেট: ২০১৬-০৪-২৮ ২১:৪০:০৯
আগামী অর্থবছরের (২০১৬-১৭) জন্য ভ্যাট (মূসক) ১৫ শতাংশই থাকছে বলে ব্যবসায়ীদের জানিয়ে দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তিনি বলেন, ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট নির্ধারণে আমার আপত্তি নেই। তবে এবার ভ্যাট ১৫ শতাংশ থাকবে। আমি কথা দিচ্ছি আগামীতে ভিন্ন ভিন্ন হারে ভ্যাট নির্ধারণ করা হবে।
আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর সোনারগাঁ হোটেলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দ্য ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) যৌথ আয়োজিত এনবিআরের পরামর্শক কমিটির ৩৭তম সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা জানান।
এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদের সভাপত্তিত্বে সভায় উপস্থিত ছিলেন, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান ও এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, এফবিসিসিআই সহ সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, বাংলাদেশ প্লাস্টিক এসোসিয়েশনের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনসহ এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, ডিসিসিআই নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন শ্রেনী পেশার ব্যবসায়ীরা।
আগামী অর্থবছরের (২০১৬-১৭) বাজেটে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি হবে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, এ বাজেটে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। ফলে এ খাতে আগের চেয়ে বরাদ্দ বাড়ানো হবে। বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ মুখ রক্ষা করতে পারবে। এতো দিন পরিবহন ও এনার্জি খাতের প্রতি বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কারণ এ দু’টি খাতই ভেরি ডিসটাব (খুব সমস্যা)।
এখন জ্বালানী সম্পর্কে আপনারা (ব্যবসায়ীরা) দুর্ভাগ্যজনকভাবে অভিযোগ করেছেন জ্বালানী সরবরাহে সমস্যা রয়েছে। আমার মনে হয় ২০১৮ সালের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত ২০১৮ সালে নিরবিচ্ছন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে, বলেন মুহিত।
ভ্যাটের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভ্যাট নতুন কর। নতুন কর হওয়ার কারণে এর অনেক বিবর্তন হবে। আমাদের যে ইচ্ছা তাহলো, ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাট হতে পারে, তাতে আপত্তি নেই। তবে আমার নিজের ইচ্ছা হলো যে ১৫ শতাংশ দিয়েছে, তা কিছু দিন রাখি। তারপর একাধিক ভ্যাট হার করা হবে। বিভিন্ন দেশে একাধিক ভ্যাট হার আছে। তবে আমি বলছি, এ বছর আমরা ভ্যাট ১৫ শতাংশই রাখছি।
অর্থমন্ত্রী বলেন, এক সময় আমরা বৈদেশীক যে সাহায্য নিয়ে আসতাম তার মোট পরিমাণ ছিল আমাদের উন্নয়ন ও রাজস্ব বাজেটের থেকেও বেশি। বাজেটে বৈদেশিক সাহায্য থাকতো ৭ থেকে ৮ শতাংশের উপরে। সেখান থেকে বৈদেশিক সাহায্য এখন ২ শতাংশের নীচে নেমে এসেছে। যা ১ দশমিক ৪৫ শতাংশের মতো। তবে আমরা চায় বিদেশী সাহায্য ২ থেকে ৩ শতাংশের মতো থাকুক। এটা অতিরিক্ত সম্পদ হিসিবে ব্যবহার করা যায়। আমরা গর্বিত যে আমরা অবস্থার পরিবর্তন করতে পেরেছি। আগে রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস ছিল শুল্ক, আর সবার নীচে ছিল আয়কর। এখন সবার উপরে চলে এসেছে আয়কর। এভাবে রাজস্ব আদায়ের বিবর্তন হচ্ছে। অনেক দেশেই এভাবে বিবর্তন হয়।
বাজেট বক্তব্য দীর্ঘ হওয়ার বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, কয়েকজন উল্লেখযোগ্য অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে প্রথম তাজউদ্দিন আহমেদ। সে সময় বক্তব্য ছিল খুব কম। আমার মতো এতো লম্বা বক্তব্য তখন হতো না। আমি আমার লম্বা বক্তব্য জাষ্টিফাই (বিচার) করি এইভাবে ‘আমার অর্থনীতি তো বড় হয়ে গেছে’। সেক্টরর্স অনেক বেড়ে গেছে। সুতরাং আপনারা দয়া করে এটি সহ্য করেন। আমি দুই ঘণ্টা আড়াই ঘণ্টার মতো বক্তব্য দিই। এটা সারা বছরের জন্য দেই। আমার বক্তব্যের বিষয়ে প্রথম যখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হয় তখন আমি প্রধানমন্ত্রীকে বলেছি, আগে আমার বক্তব্য ৬ থেকে ৭ পৃষ্ঠায় হয়ে যেতো, কিন্তু এবার আর তা হবে না। আমার ১০০ পৃষ্ঠার মতো লাগবে। সেটাই এখন বজায় থাকছে।
অর্থমন্ত্রী আরো বলেন, আমাদের সবসময় চেষ্টা থাকে সেবা করার। সেবা করার জন্য কিছু ক্ষমতা থাকে। এই ক্ষমতার অপব্যবহার হতে পারে। শেষ ৭ বছরে লোককে হয়রানি করা এবং লোকের উপর ক্ষমতা দেখানোর প্রক্রিয়া হ্রাস করার জন্য আমরা চেষ্টা করেছি। আমার মনে হয় অনেক ক্ষেত্রে আমারা সফলও হয়েছি।
এদিকে আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডর (এনবিআর) পরামর্শক কমিটির ৩৭তম সভায় এফবিসিসিআই ৪৪৭টি প্রস্তাব দিয়েছে। প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে, ভ্যাটে (মূসক) ৮৪টি, আয়করে ১২৪টি ও শুল্কে ২৩৯টি।
সভায় মূলধনী বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে ও অর্থপাচার ঠেকাতে আগামী অর্থবছর বাজেটে অপ্রদর্শিত আয়ের বৈধ করার সুযোগের দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, ভবিষ্যতে রাজস্ব আয় ও উৎপাদনমুখী শিল্পখাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এফবিসিসিআই বাজেট প্রস্তাবনায় বলা হয়, আবাসন খাতের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ আরো ৫ থেকে ১০ বছর দেয়া উচিত। প্রদর্শিত পরিসম্পদের উপর যেসব সারচার্জ আরোপ করা হচ্ছে তা বিদ্যমান কর নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই সম্পদের সারচার্জ প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়।
প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, যেহেতু নিট পরিসম্পদের উপর করদাতাগণ পূর্বের বছরে একবার কর পরিশোধ করছেন, সেহেতু একই সম্পদের ওপর পরের বছর পুনরায় সারচার্জ আরোপ সঠিক নয়। কারণ সম্পদের কর একবার পরিশোধ হচ্ছে। পরের বছর আবার দিলে তা একই সম্পদের উপর দুইবার কর পরিশোধ করতে হয়। এ জটিলতা দূর করতে কর পরিশোধের পর অর্জিত পরিসম্পদের ভিত্তিতে এনবিআর যে কর আরোপ করে তা বাতিলের জোর দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই।
আয়কর আধ্যাদেশের ১৬ ধারায় শুধুমাত্র কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী মোট আয়ের উপর কর ধার্য করার বিধান রয়েছে। সুতরাং নিট পরিসম্পদের উপর কর আদায় করা সম্পূণরুপে বেআইনি। ব্যক্তি করদাতার প্রদর্শিত নিট সম্পদের ভিত্তিতে সরকার সারচার্জ আদায় করা হচ্ছে। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে এ ক্ষেত্রে নিট সম্পদের পরিমাণ দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা হলে কর দিতে হয় না। তবে দুই কোটি ২৫ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে কিন্তু ১০ কোটি টাকার বেশি নয় এমন সম্পদধারীকে ১০ শতাংশ হারে সারচার্জ দিতে হয়।
সম্পদের মূল্য ১০ কোটি টাকার অধিক কিন্তু ২০ কোটি টাকার বেশি নয় এমন সম্পদধারীকে ১৫ শতাংশ, ২০ কোটির বেশি কিন্তু ৩০ কোটির বেশি নয় এমন সম্পদধারীকে ২০ শতাংশ এবং ৩০ কোটি টাকার বেশি যেকোনো পরিমাণ সম্পদের ওপর ২৫ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা রয়েছে। এফবিসিসিআই এই সারচার্জ প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে। শিল্প-কারখানায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ থেকে ৬ টাকা করার দাবি জানিয়েছে এফবিসিসিআই। তেলের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের দর সমন্বয় করতে আলাদা নীতিমালা তৈরি করারও আহ্বান জানানো হয়।
এছাড়া ব্যক্তি শ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা ও অন্যান্য করমুক্ত আয়সীমা বৃদ্ধি, করপোরেট করহার পুনর্নিরধারণেরও প্রস্তাব করা হয়েছে। জুলাই থেকে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হবে। এক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বিশেষ যৌথ কমিটির সাতটি সুপারিশ বাস্তবায়নেরও প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, সুশাসন, সচ্ছতা ও জবাবদিহিতা রেখেই আগামী বাজেট প্রণয়ন করা হবে। যা হবে ব্যবসায়ী ও জনকল্যাণকর বাজেট। তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ীদের চির শত্রু হলো সন্ত্রাস। আর এ সন্ত্রাসকে দেশ থেকে জাতীয়ভাবে র্নিমূল করা হবে। তবে দেশের সকল নাগরীককে আরো সচেতন হতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি আরো বলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নে ও সরকার প্রণিত বাজেটকে বাস্তবায়নের নারী-পুরুষ সকল ব্যবসায়ীকে স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদান রাখতে হবে।
সভায় এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, দেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদুৎ ও জ্বালানির ভূমিকা অপরিসীম। দেশের বিদ্যুতের চাহিদা মিটানোর জন্য সরকার বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে শিল্পায়নের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ জরুরি। এজন্য শিল্পখাতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ থেকে ৬ টাকা নির্ধারনের সুপারিশ করছি।
মাতলুব আহমাদ বলেন, তেলের মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুতের দর সমন্বয় করতে আলাদা নীতিমালা তৈরি করতে হবে। এছাড়া রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট ও পুরাতন বন্ধ হয়ে যাওয়া সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলো পিপিপির আওতায় এনে পুনরায় চালু করতে হবে। এজন্য বিদ্যুতের উন্নয়নের স্বার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতা সরকারকে বাড়াতে হবে।
প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দর কমানো হলে তা যেন শিল্পের উৎপাদন খরচ কমাতে সহায়ক হয়। একদিকে জ্বালানি তেলের মূল্য কমিয়ে অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দর বাড়ালে তা কোনো ভাবেই শিল্পের জন্য সহায়ক হবে না। কারণ, এতে শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের খরচ কমবে না।
আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, ২০১৬ সালে পর্যটনবর্ষ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যটকদের জন্য শুল্কমুক্ত বাস ও গাড়ি আমাদানির সুযোগ দেয়ার জন্য দাবি ও প্রস্তাব করছি। এসময় তিনি সব রপ্তানির ওপর বিশেষত পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয়ের ওপর পূর্বে বলবৎ হ্রাসকৃত ১০ শতাংশ কর নির্ধারণের প্রস্তাব করেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে আর্থিক ব্যবস্থাপনার বিশেষ নজর দিতে হবে। দেশে আর্থিকখাতে যেসব অপতৎপরতার ঘটনা ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি যাতে আর না ঘটে এ জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে। তিনি বলেন, বাজেট অর্থায়নে অপেক্ষাকৃত সুলভ সুদে বৈদেশিক অর্থের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা যেতে পারে। এতে ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর সরকারে নির্ভরশীলতা কমে আসবে। সেই সঙ্গে বিপুল সুদের দায়ভার কমে আসবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পাবে।
তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমিয়ে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ালে শিল্প কারখানার উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। যা দেশে শিল্প কারখানা বিকাশে অন্তরায়। তাই জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামও সমন্বয় করতে হবে। এ সময় দেশের বন্ধ বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানায় অংশীদারিত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে চালু করার পরামর্শ দেন তিনি।
শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, প্রতিবছরই সরকারের কাছে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এফবিসিসিআই কিছু বাজেট প্রস্তাবনা দেয়। প্রতিবারের মতো এবারও এক গুচ্ছ প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। আগামী বাজেটে এসব প্রস্তাবনার সংযোজন ও তার প্রতিফলন ব্যবসায়ীরা দেখতে চায়। তাছাড়া ব্যবসায়ীদের সেন্টিমেন্টকে সামনে রেখে আগামী বাজেট প্রণয়নের জন্য অর্থমমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
সানবিডি/ঢাকা/আহো