আমি যে কারণে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করি

প্রকাশ: ২০১৬-০৫-১৩ ১৩:০৮:৩৬


Meherunnisa
লেখক: মেহেরুন্নিসা জুবাইদা, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মী

ভূমিকা রেখে সরাসরিই চলে যাই। মূল আলোচনাই সংক্ষেপ করতে পারিবো কিনা বুঝতে পারছিনা। কেন দন্ড হিসাবে মৃত্যুকে সমর্থন করিনা এ সম্পর্কে লিখতে চাইনি কিন্তু অনেকে আমাকে বলেছেন মৃতুদন্ড সমর্থন না করে আদতে আমি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। আর একজনের মন্তেব্যে ওয়াদাও করেছি- এ বিষয়ে পোস্ট লিখবো বলে।

ইসলামে বিচারে মৃত্যুদন্ড বলে একটা দন্ড আছে এটা আমি অস্বীকার করিনা। আর আমি এও অস্বীকার করিনা যে আমি ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী একজন মানুষ। ইসলামের আইনকানুন নিয়ে আমার মনে কখনো প্রশ্ন আসেনা, তবে বিভিন্ন আইনের শানে নুযুল বা তার গুরুত্ব নিয়ে আগ্রহ হয়েছে অনেক। এখানে বলে নিতে চাই ইসলামে মতুদন্ড দেয়ার যে বিধান আছে তা নিয়ে আমি কোন আলোচনায় যেতে চাইনা।

আমি এ নিয়েও আলোচনায় যেতে চাইনা যে বাংলাদেশের সংবিধানে একটি পদ আছে – ন্যায়পাল। এবং এই ন্যায়পাল পদটি আজ স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও শূন্যআসন হিসাবে পরে আছে। এপদটি শূন্য আছে বলে আমি বাংলাদেশের সংবিধানকে অকার‌্যকর মনে করিনা, অথবা এ পদটি আছে বলে এ পদটি পুরন না করলে বাংলাদেশের অস্বীত্ব বিনষ্ট হবে বলে আমি মনে করিনা।

যে কারনে বাংলাদেশে আজো ন্যায়পাল পদটি শূন্য আছে, ঠিক সেই কারনেই আমি মৃতুদন্ডের মতো একটি বিধির দায়িত্ব বর্তমান মানুষদের হাতে দেয়া হোক এতে সমর্থন করিনা।

ইসলামের বিধিগুলো তৈরি হয়েছে মানুষের কল্যানে। অন্যায় করা থেকে মুক্তি দিতে এবং অররাধের শাস্তির মাধ্যমে অপরাধীকে মুক্ত করতে- অপরাধ উষ্কে দিতে নয়। শাস্তি কায়েমের নামে অন্যদের অপরাধ বোধের ইন্ধন যোগাতেও নয়। ইসলাম ঠুনকো নয়। যে অপরাধের যতবড় শাস্তি তার সাক্ষ্যপ্রমানও তত কঠিন। মৃত্যুদন্ডযোগ্য কোন অপরাধের সাক্ষিদের হতে হবে সত্যবাদী, নির্লোভী ভালোমানুষ। অপরাধের অভিযোগ আছে এমন ব্যক্তির সাক্ষ্যে কারো মৃতুদন্ড দেয়া যাবেনা। মৃতুযোগ্য কোন অপরাধের অভিযোগ সাক্ষ্য ব্যতীত কারো বিরুদ্ধে আনাও হবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যেমন, সাক্ষী ছাড়া কারো বিরুদ্ধে যেনার অভিযোগ আনলে অভিযোগকারীকে যেনার শাস্তি দিতে বলা হয়েছে এবং তার সাক্ষ্য কোনদিনও আর গ্রহন না করতে বলা হয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে, বিশেষত, বাংলাদেশের ট্রেন্ডে এই মানবিকতা কতটােআস্থা যোগ্য? আমরা প্রায়ই দেখি চুরির অপরাধে শিশু বা কিশোরকে পিটানো হচ্ছে। ক্ষেত্র বিশেষে পিটিয়ে মেরেই ফেলা হচ্ছে। চুরির অপরাধের “অভিযোগে” কোন শাস্তির বিধান নেই। অভিযোগ প্রমানিত হলেও তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড নয়। সুদ ঘুষের ছড়াছড়ি নিয়ে আশাকরি কেউ দ্বিমত করবেন না।
যে দেশের মানুষেরা সামান্য কটা মুনাফার জন্য সব ধরনের খাবারের মধ্যে বিষ মেশাতে অসস্খিবোধ করেনা; যে দেশের মানুষেরা কোলের শিশুটির খাবারে অবধি বিশ মেশাতে দ্বিধা করেনা, সে মানুষেরা কতটুকু নিরাপদ নিরপেক্ষভাবে একটা জীবনকে বাঁচানোর জন্য, বা একটা জীবনকে পাপের অপরাধ থেকে মুক্ত কেরতে শিক্ত নয়নে তার শাস্তি কার‌্যকর করতে?

একজন মৃতুদন্ডপ্রাপ্ত অপরাধীও একজন মানুষ। সে ফেরেশতা যেমন নয়, শয়তানও নয়। মানব মন্ডলীরই অংশ। তার উপর পরিমিত ন্যায়পরায়ন শাস্তি যেমন তাকে পাপমুক্ত করে, তার প্রতি অপরিমিত অণ্যায় শাস্তি অন্য মানুষদেরও পাপের অপরাধে বেধে ফেলে এবং শয়তানের উৎসবের কারন হয় । মানুষদের যত নামে যত অণ্যায় শয়তানের তত আনন্দ।
মৃত্যুদন্ডের মতো শাস্তি কোন অপরাধপ্রবন জাতির হাতে তুলে দেয়া আর ঘরে ডাকাত পরলে তাদের হাতে ঘরের দা, কুড়াল আর বন্দুক তুলে দেয়ার মতো।

মৃতুদন্ড সেই সব মানুষদের হাতে মানায় যাদের একজন যুদ্ধের ময়দানে যখন প্রতিপক্ষকে মেরে ফেলতে উদ্ধত ঠিক তখন প্রতিপক্ষ থুতু ছুড়ে দেয় তার মুখে। আর এই রাগ এবং ক্রধের মুহুর্তে তাকে কোনরকম আঘাত না করে তাকে ছেড়ে দেয় সে। যখন জানতে চাওয়া হয় কেন ছেড়ে দেয়া হচ্ছে উত্তর হয়েছিলো থুতু দেয়ার কারনে তার উপর যে রাগ এবং ঘৃনার উদ্রেক হয়েছে তাকে হত্যা করলে যদি হত্যার কারন হিসাবে তার সেই রাগ এবং ঘৃনাকে গ্রহন করা হয় সেই ভয়ে।

মৃতুদন্ডের মতো শাস্তি তার হাতে তুলে দেয়া হয় যার কাছে একজন মৃতুদন্ডাপুযুক্ত অপরাধী এসে তার পাপের কথা বলতে চাইলে সে মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে নেয়। আরো কৌতুহলী হয়ে বিস্তারিত জানতে চায়না। যখন অপরাধী আবারো দিক পরিব র্তন করে তাকে বলতে চায়, সে আবারো অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। যখন অপরাধী একান্ত বাধ্য করে তার অপরাধের বিবরন শুনায়, তখন সে তাড়াতাড়ি শাস্তি না দিয়ে আরো সময় দেয় বোঝার জন্য শাস্তি আদায় করলে অন্যকারো উপর অপরাধ করা হবে কিনা। যখন জানা যায় অপরাধী একজন সম্ভাব্য মা, তখন তাকে সন্তান জন্মের এবং তার লালনের সুযোগ দেয়া হয় যাতে সেই সন্তানটি তার মাকে ছাড়াও বেচে থাকতে পারে।

কিন্ত বর্তমান মানুষের সহ্যশক্তি কি সত্যি এমন? বেশি দূরে যেতে হবেনা। এই ফেইজবুকেই কত অবলীলায় কারো মতামত পছন্দ না হলে কত সহজেই একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে বিশ্রি ভাষায় বকা ঝকা করছে। কত সহজেই যারে তারে মেরে ফেলতে চাইছে এবং কিভাবে মারা হবে তার বিভৎশ বর্ননা দেয়া হচ্ছে। এমনকি প্রায়ই দেখা যাচ্ছে মানুেষদের গুম করা হচ্ছে যাদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে- অনেক সময় অংশবিশেষ। যখন একটা মানুষ গুম হচ্ছে- কেউ না কেউতো এ অপরাধের সাধে জড়িত। গুমের পরে যে মানুষটিকে মারা হচ্ছে- তার কি অপরাধ তা আমরা আর জানতে পারিনা। জানতে পারিনা তার কোন অপরাধই আসলে আছে কিনা। তবে জগতে সকল অপরাধের শাস্তি যে মৃত্যু নয় এ জানায় মনে হয় কোন ভুল নেই।

বাংলাদেশের অপরাধের দদন্ত করে পুলিশবাহিনী। প্রতিনিয়ত তাদের চাদাবাজি, অন্যায়ভাবে রাস্তা থেকে মানুষ তুলে নিয়ে টাকা আদায়ের গল্প পড়ি পত্রিকায়। যে মানুষেরা টাকার জন্য বিনা অপরাধে মানুষকে তুলে নিয়ে তার কাছে টাকা দাবি করে, অত্যাচার করে, সেই মানুষেরা টাকার বিপরীতেও ন্যায়নিষ্ঠভাবে তদন্ত প্রতিবেদন দিবে এটা কিভাবে মেনে নেয়া যাবে?

পাশাপাশি বাংলাদেশের শুরু থেকে এখন অবধি যখনই যে সরকার আসে সেই সরকার একের পর এক মামালা করে প্রতিপক্ষের নামে। আর একই সাথে তার নিজের দলের কারো নামে যদি আগে করা মামলা থেকে থাকে সব নির্দোষ প্রমানিত হয়ে মামলা শেষ হয়ে যায়। এটাতো ম্যাজিক হতে পারেনা যে প্রতি পাচ বছরে অপরাধীরা সব ভালোমানুষ হয়ে যায় আর ভালো মানুষেরা সব অপরাধী হয়ে যায়!

মৃতুদন্ডের বিরোধিতা করলে অনেকেই বলেন যে এখন মৃত্যুদন্ড না দিলে সরকার বা বিচারপতি বদলালে বিচার বদলে যাবে। অপরাধী ছাড়া পেয়ে যাবে। এটা মৃত্যুদন্ডের কোন যুক্তিপূর্ন কারন হতে পারেনা। এটা আরো বিশালভাবে আমাদের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা নির্দেশ করে বরং। এটার সমাধান হতে পারে জাতি হিসাবে সবাই মিলে আদালতের নিরাপেক্ষতা বিষয়ে কাজ করা। এটা না করে একজন যাবৎজীবন শাস্তিযোগ্য অপরাধীকে মেরে ফেলা হবে আরেক অপরাধ। নিরাপরাধকে মেরে ফেলাতো আরো বিশ্রি অপরাধ।

আরো একটা বিষয় হলো মৃত্যুর যে কালচার আর অপরাধ প্রবনতার যে বৃদ্ধি- আমরা যারা দূরে থাকি আমরা তো পুরো চিত্রটা দেখতে পাই। আমরা দেখতে পাই কিভাবে একের বিরুদ্ধে অপরে ফুসে উঠছে। যেনো একটু সুযোগ পেলেই যত কিছু এখন করা হচ্ছে তার দ্বিগুন করা হবে। আমরা কেন শঙ্কিত হই জানেন? কারন আপনার ভাই দেখেন বা প্রতিপক্ষ দেখেন তাদের সবাইকেই আমি ভাই দেখি। আপনাদের এই পরষ্পর ফুসে ওঠা তাই আমাকে অনেক বেশি শঙ্কিত করে। আপনারা হয়তো উল্লাসে, রাগে বা দুখে বুধ হয়ে আছেন তাই অতটা বুঝতে পাননা। আপনারা প্রতিপক্ষের উপর আক্রমন করতে, তার প্রান কেড়ে নিতে নানা নামে তাই মৃত্যুকে জায়েজ করতে চান। আর আমি আমার ভাইয়ের উপর ভাইয়ের আক্রমনের তীব্রতায় কুঁকড়ে উঠি।

আশাকরি বুঝতে পারছেন কেন আমি মৃতুদন্ড বিধিকে সমর্থন করিনা। শিশুর হাতে যেমন আমি জলন্ত মোম দিয়ে ছেড়ে দিবনা. অপ্রাপ্ত বয়স্কের হাতে বন্দুক তেমনি মানুষদের হাতে মৃত্যুদন্ডের মতো জীবন নাশকারী বিধিও দিতে রাজী নই আমি।

সবাই ভালো থাকবেন। ঘৃনা থেকে বেড়িয়ে আসবেন। নিজেকে বোঝার শক্তি অর্জন করবেন- এই দোয়া করে শেষ করছি।