ঋণ থেকে মুক্তি কেন জরুরি?

সানবিডি২৪সাইফুল ইসলাম আপডেট: ২০২৩-১০-১৫ ১৮:৫৪:২১


একবার নবীজী (স) মসজিদে নববীতে আবু উমামা সাহাবীকে অসময়ে দেখতে পেলেন। অসময়ে বসে থাকতে দেখে নবীজী (স) তার কাছে গেলেন। বললেন, উমামা এখন তো নামাজের সময় নয় এখানে বসে আছ কেন?

দেখেন, নবীজী (স) কিন্তু সাহাবীকে সবসময় মসজিদে নববীতে বসে থাকতে বলেন নাই। যে নামাজ পড়ার পরে, এই পড় ঐ পড় সেই পড় বসে থাক! না, নামাজ পড়ার পরে কী করো? তুমি আল্লাহর অনুগ্রহ সম্পদ অনুসন্ধানের জন্যে বেরিয়ে পড়।

তো বসে থাকতে দেখলেন। জিজ্ঞেস করলেন, বসে আছ কেন? তখন সে বলল, ইয়া রসুলুল্লাহ! ঋণের চিন্তায় আমি পেরেশান আছি। তখন তিনি সকাল সন্ধ্যা পাঠ করার জন্যে তাকে একটা দোয়া শিখিয়ে দিলেন।

সে দোয়াটি হচ্ছে, হে আল্লাহ! দুশ্চিন্তা ও দুর্দশাগ্রস্ত হওয়া থেকে অক্ষমতা ও আলস্য থেকে আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি। হে আল্লাহ! ভীরুতা ও কৃপণতা থেকে ঋণজর্জরিত পরাভূত হওয়া থেকে আমি তোমার আশ্রয় গ্রহণ করছি।

আবু উমামা পরবর্তীতে বলেন, এই দোয়া পাঠের বরকতে আল্লাহ আমাকে দুশ্চিন্তা এবং ঋণ থেকে মুক্তি দেন।

ঋণ এত ঝামেলার কেন?

আপনি বলবেন যে, ঋণ এত ঝামেলার কেন? রসুলুল্লাহ (স) বলেন, যে ব্যক্তি ঋণী হয় সে যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন ওয়াদা করে তা ভঙ্গ করে।

এবং অথর্ববেদে ষষ্ঠ অধ্যায় শ্লোক ১১৭-১১৯ প্রার্থনা আছে একটা ১৭-১৯ শ্লোকে, ইহলোকে উত্ত উত্তমর্ণের কাছে সকল ঋণশোধ করার শক্তি দাও। তোমার প্রসাদে আমার সকল ঋণ থেকে মুক্ত করো। ঋণ নিমিত্ত নরকপাত থেকে আমায় মুক্ত করো।

অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্রেও কিন্তু ঋণশোধ না করলে নরক বাস নিশ্চিত।

লৌকিক ও বৈদিক সকল ঋণ থেকে মুক্ত করো। দেহত্যাগের পর সর্বলোকে আমাকে মুক্ত করো। অথর্ববেদে এই যে প্রার্থনা এটাও কিন্তু ঋণমুক্তির প্রার্থনা।

যদি মৃত ব্যক্তি দেনাগ্রস্ত হতো নবীজী (স) তার জানাজায় অংশ নিতেন না!

বিশিষ্ট সাহাবী মোহাম্মদ ইবনে জাহাশ একটা ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, একবার আমি রসুলুল্লাহর সাথে বসে আছি, এমন সময় তিনি আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালেন হাতের তালু কপালে রেখে বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! কী কঠোর একটা নির্দেশ আমার ওপর নাজিল করা হলো।

ইবনে জাহাশ বলেন যে, আমরা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পেলাম না।

পরদিন সকালে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! কী কঠোর নির্দেশ নাজিল করা হয়েছে?

তিনি বললেন, আল্লাহর পথে জেহাদ করে শহিদ হওয়ার পর যদি কারো জান ফিরিয়ে দেয়া হয় এবং আবারও সে শহিদ হয় তারপর আবার তাকে জীবিত করা হয় আবারও সে শহিদ হয় যতবারই সে শহিদ হোক, শহিদ হওয়ার পরও সে ঋণশোধ না করা পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশের অনুমতি পাবে না।

এবং ঋণগ্রস্ত হওয়াটাকে নবীজী (স) কত অপছন্দ করতেন সেটা বোঝা যায় তার জানাজা পড়ানোর ঘটনা থেকে। তিনি যখনই কারো জানাজা পড়াতেন আগে খোঁজ নিতেন যে, মৃতের কোনো ঋণ আছে কিনা। যদি মৃত ব্যক্তি দেনাগ্রস্ত হতো তিনি জানাজায় অংশ নিতেন না।

তো ঋণগ্রস্ত হলে তার শাফায়াত পাওয়া যাবে? যিনি নিজের চোখের সামনের ঋণগ্রস্ত মৃতের জানাজা পড়াতেন না।

তো অতএব ঋণের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকবেন। এমনকি একবার জানাজা পড়াতে গিয়ে তিনি তিনি শুনলেন মৃত ব্যক্তি ঋণগ্রস্ত এবং সে কোনো সম্পদ রেখে যায় নি যেখান থেকে ঋণশোধ করা যাবে।

তিনি সাহাবীদের বললেন, তোমরা জানাজা পড়ও। কতটুকু ঋণ খোঁজ নেয়া হলো। ঋণ খুবই অল্প দুই বা তিন দিনার। উপস্থিত আরেক সাহাবা আবু কাদাতা আরজ করলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি এই ঋণের জিম্মাদার হলাম। তখন নবীজী (স) জানাজায় ইমামতি করলেন।

ঋণশোধের ব্যাপারে নবীজী (স) যে কারণে তাগাদা দিতেন…

কারণ ঋণ হচ্ছে একটা নেশা আফিমের নেশার মতো। ঋণ একটা আসক্তি। যে একবার ঋণের স্বাদ পায় সে ঋণ ছাড়া অন্য কোনো অর্থে সে কোনো স্বাদ পায় না খুঁজে। তো ঋণ করার ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকতে হবে।

জানাজা পড়ানোর পরদিন আবু কাদাতার সাথে দেখা হতেই নবীজী (স) জিজ্ঞেস করলেন, ঋণটা কি শোধ করেছ? আবু কাদাতা বললেন যে, পাওনাদারের পুরো প্রাপ্য পরিশোধ করা হয়েছে।

নবীজী (স) স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, এখন সে শান্তি পাবে।

অতএব যাদেরই মা-বাবার ঋণ আছে একটু খোঁজ নেবেন, যদি হাতে পায়ে ধরেও হয় তাকে ঋণ করতে নিরুৎসাহিত করবেন।

এবং ঋণের ব্যাপারে সবসময় হাজবেন্ডকে সন্তানকে স্ত্রীকে কন্যাকে নিরুৎসাহিত করার জন্যে যা যা করার এটা করবেন।

ঋণশোধ করার ব্যাপারে নবীজী (স) তাগাদা দিতেন এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, একজন বিশ্বাসীর আত্মা ঐ ঋণশোধ না করা পর্যন্ত প্রশান্তি পায় না সে ঝুলে থাকে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারে না।

সাহাবীরা এবং পরবর্তীকালে তাবে তাবেঈন এবং সমস্ত বুজুর্গরা প্রত্যেকেই ঋণমুক্ত হয়ে মারা যাওয়ার ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেছেন।

মৃত্যুশয্যায় মাত্র ৫০ দিরহাম ঋণের চিন্তায় হযরত রুমি অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন

হযরত জালাল উদ্দিন রুমি যখন মৃত্যুশয্যায় হঠাৎ তার মনে পড়ল, তার কাছে একজন ৫০ দিরহাম পাবে। ৫০ দিরহাম কিন্তু খুব বেশি না রৌপ্যমুদ্রা। ৫০ দিরহাম পাবে।

ঋণের কথা মনে পড়ার সাথে সাথেই তিনি সক্রিয় হয়ে উঠলেন এবং ৫০ দিরহাম সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করলেন যে, কীভাবে সংগ্রহ করা যাবে। এর মধ্যে যে পাবে সে পাওনাদার তারই ভক্ত। সে যখন শুনল যে, হুজুর অস্থির হয়ে গেছে সেও দৌড়ে আসল।

তো জালাল উদ্দিন রুমিকে বলল যে, হুজুর আমার পাওনা আমি মাফ করে দিলাম। আমার কোনো দাবি নাই, আমি এটা উপহার হিসেবে উপহার দিলাম।

তখন রুমি শান্তির স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন যে, তুমি আমাকে বাঁচালে। আলহামদুলিল্লাহ! একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া থেকে আমি বেঁচে গেলাম।

চিন্তা করেন! রুমির মতো মানুষ ৫০ দিরহামের জন্যে যদি বলেন যে, একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া থেকে আমি বেঁচে গেলাম। বুঝতে পারছেন যে, ঋণটা কত খারাপ জিনিস।

নবীজী (স) ঋণের ব্যাপারে এত কঠোর হওয়ার কারণ কী?

নবীজী (স) ঋণের ব্যাপারে এত কঠোর হওয়ার কারণ হচ্ছে, একজন মানুষ যখন ঋণ করে তার চিন্তার বড় অংশ জুড়ে থাকে কীভাবে এই ঋণশোধ করবে। তার এই চিন্তা থেকে সে কিন্তু বের হতে পারে না। পাওনাদারের সামনে সে সবসময় সংকুচিত হয়ে থাকে। সে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, অমুক দিন দেবো কিন্তু সে দিতে পারে না এবং যখন দিতে পারে না তখন আবার এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের যে গুনাহ এই গুনাহ তার নামে জমা হয়।

এবং পাওনাদারের কাছে সে আরো অপদস্থ হয়। অর্থাৎ ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি কখনো সম্মানের অধিকারী হয় না তার আত্মসম্মান বোধটাই শেষ হয়ে যায়।