হুমকির মুখে পোল্ট্রি শিল্প

::গিয়াস উদ্দিন প্রকাশ: ২০২৩-১২-২৬ ১৭:১১:৪৪


করোনা মহামারী চলাকালে পোল্ট্রি শিল্পে ধস নেমে আসে। মহামারী কেটে গেলেও এর প্রভাব থেকে যায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত। সে সময়ে পুঁজি হারিয়ে অনেক খামারিই উৎপাদন বন্ধ করে দেন। তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ফিডের দাম বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। করোনার পর থেকে এ পর্যন্ত খামারিদের ঝরে পড়ার এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৯ হাজারে। যা দেশে মোট পোল্ট্রি খামারিদের প্রায় অর্ধেক।

এদিকে মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট -সবমিলিয়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতির অস্থিরতার কারণে বেশ কিছুদিন ধরে দেশে ডিম ও মুরগির বাজারে অস্থিরতা চলছিল। তবে এটি দূর হয়ে যখন বাজারে স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তখন নতুন করে চাপ তৈরি হয়েছে খামারিদের উপর। একদিকে বেড়েছে ফিডের দাম, অন্যদিকে প্রান্তিক খামারিদের পণ্য বিক্রি করতে হচ্ছে উৎপাদন খরচেরও নিচে। এ অবস্থায় খামারিদের অনেকে নতুন করে উৎপাদন থেকে সরে আসছেন। এতে হুমকির মুখে পড়তে পারে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি, অগ্রিম আয়কর, আমদানি শুল্ক ও করপোরেট ট্যাক্স প্রত্যাহার না হওয়ায় বড় ধরনের চাপের মুখে রয়েছে দেশের পোল্ট্রি শিল্প। পোল্ট্রি মুরগির খাবার বিশেষ করে সয়ামিল, ভুট্টা-গমের গুঁড়া, চালের কুঁড়াসহ সব ধরনের ওষুধের দাম বেড়েছে। ফলে এই খাতের উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত লোকসানের দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। তারা বলছেন, অচিরেই এর সুরাহা না হলে বিপদে পড়বে এই শিল্প। জানা গেছে, নভেম্বর মাসের শেষের দিকে ব্রয়লার ও লেয়ার ফিডের দাম কোম্পানিভেদে কেজিতে আড়াই থেকে সাড়ে তিন টাকা বাড়ানোর কথা জানায় কোম্পানিগুলো। যেখানে তিন দফায় সাড়ে তিন টাকা পর্যন্ত দাম কমিয়েছিল ফিড উৎপাদনকারীরা, সেখানে এক লাফেই সাড়ে তিন টাকা বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। খামারিরা বলছেন, এখন ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বিক্রয় মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় অনেক কম।

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) বাজার বিশ্লেষণের তথ্য বলছে, এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির দাম ১৬.৬৭ শতাংশ এবং ডিমের দাম ২১.৫৭ শতাংশ কমেছে। খামারিরা বলছেন, সরকার যদি এখন খামার পর্যায়ে ডিম ও মুরগির দাম কত হবে সেটা নির্ধারণ করে না দেয়, তাহলে সংকট আরো বাড়বে। খামারিরা আবার লোকসান করতে থাকলে সেটা দীর্ঘমেয়াদে সরবরাহ চেইনে বড় সংকট তৈরি করবে।

প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, খামারিদের বাঁচানোর জন্য সরকারকে এখানে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে। কারণ সাপ্লাই চেইনের তিন-চারটি হাতবদলে সবাই লাভবান হলেও বঞ্চিত হচ্ছে উৎপাদনকারীরা। তিনি বলেন, সরকার যদি খামারিদের উৎপাদন খরচের মূল্য ঘোষণা করে তা পর্যবেক্ষণ করে, তাহলে এ অবস্থার উন্নতি হতে পারে। তা না হলে খামারিরা উৎপাদন থেকে সরে আসবে এবং দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন ঘাটতি তৈরি হবে। ফলে এটা বাজারে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। খামারিরা উৎপাদন খরচের নিচে ডিম-মুরগি বিক্রি করলেও নতুন করে ফিডের দামের ঘোষণা বাড়তি চাপ তৈরি করেছে।

গত ২৪ নভেম্বর মৎস ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (এফআইএবি) ফিডের দাম বাড়ার বিষয়ে একটি চিঠি দেয়। এ বছর সরকারের নানা ধরনের চাপের কারণে ব্রয়লার মুরগির ফিডের দাম তিন থেকে সাড়ে তিন টাকা কমানো হয় তিন দফায়। ফিড উৎপাদনকারীরা বলছেন, চলতি বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ফিডে ব্যবহৃত প্রধান সাতটি কাঁচামালের দামে প্রতি কেজিতে প্রায় সাড়ে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। একইসঙ্গে আগস্টে কাঁচামাল আমদানির এলসি খুলতে যেখানে ডলারপ্রতি ১১০ থেকে ১১১ টাকা দিতে হতো, সেটা নভেম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে ১২২ টাকায়। ফিড উৎপাদনকারীদের দাবি, শুধু কাঁচামাল ও ডলারের দাম বাড়ার প্রভাবেই প্রতি কেজি ফিডে ব্যয় বেড়েছে গড়ে প্রায় সাড়ে ৫ টাকা থেকে ছয় টাকা। শুধু আমদানি করা কাঁচামালই নয়, স্থানীয়ভাবে ভুট্টার দাম ২৯ টাকা থেকে বেড়ে ৩৫ থেকে ৩৬ টাকায় উঠেছে। সিড ক্র্যাশিং ইন্ডাস্ট্রি কোনো ঘোষণা ছাড়াই সয়াবিন মিলের দাম অস্বাভাবিক বাড়িয়েছে। যে কারণে এই কাঁচামালটি ৬৫-৬৭ টাকা থেকে বেড়ে এখন ৮২ থেকে ৮৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।

এদিকে প্রতি কেজি ফিডে যে পরিমাণ ব্যয় বেড়েছে, তা সমন্বয় করা না হলে অনেক ফিড মিল ঋণ খেলাপি হয়ে যাবে। কিছু মিল বন্ধও হয়ে যাবে। একইসঙ্গে ভুট্টা, সয়াবিন মিলসহ ফিডের প্রধান কাঁচামালগুলো সময় মতো আমদানি করা সম্ভব না হলে মৎস ও পশুখাদ্যের উৎপাদন ব্যহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান এফআইএবির সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম।

পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টদের তথ্য অনুযায়ী, এসডিজি’র ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ‘লক্ষ্য-২’ সরাসরি এবং ১৪টি লক্ষ্যের সঙ্গে পোল্ট্রি খাতের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাদের মতে জিডিপি’তে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান ২ শতাংশের ওপরে। এই খাতে ৩০ হাজার কোটি টাকারও অধিক বিনিয়োগ হয়েছে, বার্ষিক টার্নওভার ৩৫-৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২৫ লাখ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে, যার প্রায় ৪০ শতাংশই নারী।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পোল্ট্রি ফিড তৈরির জন্য মোট ৯ ধরনের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের মধ্যে প্রোটিন কনসেনট্রেট, ভুট্টা, লাইম স্টোন, হুইট পলিশ, সয়াবিন মিল, রাইস ব্রান, ফিসমিল, ব্রয়লার ফিড ও লেয়ার ফিড অন্যতম। পোল্ট্রি ফিড তৈরির কাঁচামালগুলো এখনও আমদানিনির্ভর। মোট চাহিদার মাত্র ৫০ ভাগ ভুট্টা দেশে উৎপাদিত হয়, সয়াবিন উৎপাদিত হয় না। দেশীয় সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পাওয়া সয়াবিন মিলে চাহিদা মেটে মাত্র ৫০ শতাংশ। বাকি উপাদানগুলো বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এতে ফিড উৎপাদনের খরচ বাড়ছে। আন্তর্জাতিক কৃষি ও খাদ্য সংস্থার মতে, একজন সুস্থ ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু দেশে বছরে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডিম খান মাত্র ৫০ থেকে ৬০টি। বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় তিন কোটি ডিম উৎপাদন হয়। এ অবস্থায় উৎপাদন বাড়াতে না পারলে আমিষের ঘাটতিতে পড়বে জনসাধারণ।