শ্রীলঙ্কার চেয়েও পিছিয়ে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার

::বীর সাহাবী প্রকাশ: ২০২৪-০৪-০২ ২৩:২৭:০৩


রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে বিধ্বস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের সঙ্গে বাড়ছে বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশগুলোর পুঁজিবাজারে সূচকও। বিশ্বের পুঁজিবাজার যখন ইতিবাচক ধারায় হাঁটছে, ঠিক তখনই এর উল্টো বাংলাদেশের পুঁজিবাজার। এক মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা পতনে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার। এমনকি দেওলিয়াত্ব কাটিয়ে ওঠা শ্রীলঙ্কা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় থাকা পাকিস্তানের চেয়েও খারাপ অবস্থানে রয়েছে দেশের পুঁজিবাজার।

বৈশ্বিক পুঁজিবাজার নিয়ে করা ইবিএল সিকিউরিটিজের মাস ভিত্তিক গবেষণায় দেখা গেছে, গত মার্চ মাসে দেশের পুঁজিবাজার বিশ্বের অন্যান্য বাজারের চেয়ে সবচেয়ে খারাপ করেছে। যেখানে প্রায় দেওলিয়া অবস্থায় চলে যাওয়া অর্থনীতির দেশ শ্রীলঙ্কা আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় উত্তাল পাকিস্তানের মত দেশের পুঁজিবাজার বাংলাদেশের চেয়ে ভালো করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মার্চ মাস শেষে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ডিএসইএক্স কমেছে সবচেয়ে বেশি। আলোচ্য সময়ে ডিএসইএক্স কমেছে ৬ দশমিক ৭৯ পয়েন্ট। যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজারে চেয়ে সবচেয়ে বেশি। এই সূচকটি গত এক সপ্তাহের ব্যবধানেই হারিয়েছে ১ দশমিক ৮৮ পয়েন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক ডাউ জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল এভারেজ গত মার্চ মাসে সূচক বেড়েছে ১ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এসময় সূচক দাঁড়ায় ৩৯ হাজার ৫১২ দশমিক ১৩ পয়েন্ট। এক বছরের হিসাবে সূচক বেড়েছে ১৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। আর তিন বছরের হিসাবে সূচক বেড়ে যায় ২০ দশমিক ৭ শতাংশ।

দেশটির আরেকটি সূচক এসঅ্যান্ডপি ৫০০ মার্চ শেষে সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ২ দশমিক ২৮ শতাংশ। এসময় এই সূচকটি দাঁড়ায় ৫ হাজার ২২৪ দশমিক ৬২ পয়েন্টে। এছাড়া নিউইয়র্ক ভিত্তিক স্টক এক্সচেঞ্জ নাসডাক গত মাসে দশমিক ৬৪ শতাংশ সূচক বেড়ে দাঁড়ায় ১৬ হাজার ৩৬৯ দশমিক ৪১ পয়েন্টে।

মার্চ শেষে শ্রীলঙ্কার পুঁজিবাজারের সূচক সিএসই অল শেয়ার বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। এসময় সূচকটি ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ হাজার ২৭৬ দশমিক ৩১ পয়েন্টে। যা সপ্তাহের হিসাবে ১ দশমিক ৬২ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের পুঁজিবাজার করাচি ১০০ সূচক মার্চে বেড়েছে ২ দশমিক ৭১ পয়েন্ট। এ সময় সূচক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৫৮৬ দশমিক ২৮ পয়েন্টে। যা সপ্তাহের ব্যবধানে ২ দশকি ৯৮ শতাংশ বেশি।

যুক্তরাজ্যের পুঁজিবাজারের প্রধান সূচক এফটিএসই ১০০ মার্চে ভালো অবস্থানে রয়েছে। মাস শেষে এই সূচকটি ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৮২৫ দশমিক ৬০ পয়েন্টে।

মার্চে চীনের পুঁজিবাজার সাংহাইয়ের সূচক বেড়েছে দশমিক ৪৭ শতাংশ। বর্তমানে সূচক রয়েছে ৩ হাজার ৭৭ দশমিক ১১ পয়েন্টে। এছাড়া হংকংয়ের হাংসেং সূচক আলোচ্য সময়ে কমেছে। সূচকটি দশমিক ২৯ শতাংশ কমে দাাঁড়য়েছে ১৬ হাজার ৮৫৬ পয়েন্টে।

আলোচ্য সময়ে দক্ষিণ কোরিয়ার কোসপি সূচক বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ। এ সময় সূচকটি বেড়ে দাঁড়ায় ২ হাজার ৭৫৪ দশমিক ৬৪ পয়েন্টে। ভিয়েতনামের পুঁজিবাজার ভিএন ৩০ সূচক বেড়েছে ২ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

এছাড়া মার্চে সূচক কমার মধ্যে ভারতের বিএসই সেনসেক্স কমেছে দশমিক ২১ শতাংশ, ফিলিপাইনের পিএসইআই কম্পোজিট সূচক কমেছে দশমিক ২৩ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার আইডিএক্স কম্পোজিট সূচক কমেছে দশমিক ৬৮ শতাংশ।

মার্চে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের অবস্থা: গত মার্চে পুঁজিবাজারে বড় দরপতন হয়েছে। এই সময়ে ডিএসইএক্স ৪২৫ পয়েন্ট হারিয়েছে। ডিএসইর দৈনিক গড় লেনদেন কমেছে প্রায় ৫৩ শতাংশ। মূলত লোকসান এড়াতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা তীব্র হওয়ার কারণে মার্চে পুঁজিবাজারে নিম্নমুখিতা দেখা গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

গত ফেব্রুয়ারি শেষে ডিএসইএক্স সূচক ছিল ৬ হাজার ২৫৫ পয়েন্টে। মার্চ শেষে সূচকটি কমে ৫ হাজার ৮৩০ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে। এক মাসে ডিএসইর প্রধান সূচক কমেছে ৪২৫ পয়েন্ট।

বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের ভবিষ্যৎ পূর্বাভাস নিয়ে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বেড়েছে এবং এটি তাদের বিনিয়োগ সিদ্ধান্তকেও প্রভাবিত করছে। বাজারের ক্রমাগত দরপতনের কারণে পোর্টফোলিওর লোকসান আরও বাড়তে পারে এমন শঙ্কায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বাড়ছে।

বিশেষ করে মার্জিন ঋণ নেয়া বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছিল সবচেয়ে বেশি। সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) তথ্য বলছে, গত এক মাসে ৯ হাজার ২২৪টি বিও হিসাবে থাকা সব শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

৪৮ কার্যদিবসে হাওয়া ১ লাখ কোটি টাকা: টানা দরপতনে মাত্র ৪৮ কার্যদিবসে পুঁজিবাজারের বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয়েছে ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি। গত ১৮ জানুয়ারি থেকে গত ১ এপ্রিল পর্যন্ত ডিএসইর তালিকাভুক্ত সিকিউরিটিজের বাজারমূল্যের হিসাবে এ তথ্য মিলেছে। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি, বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডের বাজারমূল্যের ভিত্তিতে প্রতিদিন বাজার মূলধনের হিসাব করে ডিএসই। ডিএসইর হিসাবে গত ১৮ জানুয়ারি বাজার মূলধন ছিল ৭ লাখ ৮৭ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা।

সোমবার (১ এপ্রিল) তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৪৮ দিনে তালিকাভুক্ত সব সিকিউরিটিজ ১ লাখ ১০ হাজার ২৩১ কোটি টাকা বাজারমূল্য হারিয়েছে। তাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যক্তিশ্রেণি থেকে শুরু করে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী এবং উদ্যোক্তারাও।

যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, ‘আমাদের পুঁজিবাজারে এই মুহুর্তে ভালো কিছু দেখা যাচ্ছে না। ঈদের লম্বা ছুটি পর্যন্ত আর তেমন কিছু পরিবর্তন হবে না। ঈদের পর কেউ মনে করে এই বাজারটাকে জীবিত রাখার দরকার আছে তাহলে তারা সেভাবে পদক্ষে নেবে। বিনিয়োগকারীরা বরং এক দেড় মাস অন্য কাজে মনযোগী হলেই ভালো।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি ব্রোকার হাউজের সিইও বলেন, ‘বিশ্বে যেখানে অন্যান্য দেশের পুঁজিবাজার ইতিবাচক ধারায় চলছে সেখানে আমাদের দেশের পুঁজিবাজার চলছে নেতিবাচক ধারায়। এতেই বোঝা যায় এই বাজারের পরিস্থিতি কী।’

তিনি বলেন, ‘এখন কোনো ইস্যু নাই। অর্তনীতির প্রায় সবগুলো সূচক তুলনামূলক ভালো অবস্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক পরিস্থিতিও অনেকটা স্থিতিশীল, তবুও বাংলাদেশের পুঁজিবাজার কেন খারাপ করবে? তার কারণ একটাই এই মার্কেটে অনেক সুশাসনের অভাব রয়েছে। এগুলো সংস্কার করা না গেলে এই বাজার ভালো হবে না।’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘পুঁজিবাজার চলবে তার নিজস্ব গতিতে। বাজারে ওঠানামা থাকবে এটা স্বাভাবিক বিষয়। বাজার যে পর্যায়ে নেমেছে, তাতে আশা করছি শিগগিরই নিজস্ব শক্তিতেই বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে ‘