তবুও অ্যাকাউন্ট বাড়ছে বাড়ছে আমানত
প্রকাশ: ২০১৬-১০-০৮ ১৬:১৯:৪৩
অর্থনীতির স্থবিরতার প্রভাব ব্যাংকিং খাতেও পড়েছে। ব্যবসায় মন্দা চলছে ব্যাংক খাতেও। ব্যাংকগুলো বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না, বিভিন্ন ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় জমেছে। আমানতের বিপরীতে ব্যাংকে প্রদত্ত সুদের হারও কমছে দিনে দিনে। আগের তুলনায় অনেক কম টাকা মুনাফা হিসেবে পাচ্ছেন ব্যাংকে আমানতকারী হিসাবধারী গ্রাহকরা। কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।
চলতি ২০১৬ সালে জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংক হিসাব বেড়েছে ১ কোটি ৬ লাখ। জানা গেছে সবচেয়ে বেশি হিসাব বেড়েছে বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোতে। নতুন ব্যাংকগুলোও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। এই ছয়মাস সময়ে ব্যাংকগুলো ৮৫টি নতুন শাখাও খুলেছে। গত ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দেশে মোট ব্যাংক হিসাব ছিল ৭ কোটি ৯১ লাখ ১৪ হাজার ৩৯৬টি। গত জুন মাস পর্যন্ত তা বেড়ে হয়েছে ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭১৩টি। বাংলাদেশ ব্যাংক এর এক প্রতিবেদন থেকেই এই তথ্যগুলো জানা গেছে। ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন প্রক্রিয়া গত কয়েক বছরে আরো অনেক বেশি গতি লাভ করেছে।
গত জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক নতুন শাখা খুলেছে রাষ্ট্র মালিকানাধীন এবং বেসরকারি বিভিন্ন ব্যাংক। ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বা আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের প্রক্রিয়ায় ব্যাংকিং সুবিধার বাইরে থাকা মানুষকে ব্যাংকে আনার তত্পরতা শুরু হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবে ব্যাংকের গ্রাহক সংখ্যা বেড়েছে। মাত্র ১০ টাকা জমা দিয়ে ব্যাংকের হিসাব খোলার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় গ্রামীণ কিংবা শহুরে এলাকার নিম্ন আয়ের সাধারণ কৃষক শ্রমিক দরিদ্র মানুষও এখন ব্যাংকে ঢোকার সাহস করছেন এবং যথারীতি ব্যাংকে লেনদেন করছেন। একসময়ে তারা ব্যাংকের দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢোকার সাহস করতেন না, আর নিজের নামে হিসাব খুলে লেনদেন করার ব্যাপারটা ছিল অনেকটাই অসম্ভব।
এই সব সাধারণ দরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর স্বল্প সঞ্চয় ব্যাংক আমানত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মোটামুটি জমা ভালো ভূমিকা রাখছে। আজকাল বিভিন্ন ব্যাংকে বড় গ্রাহকের চাহিদা কম থাকায় বিভিন্ন ব্যবসায়িক কৌশল প্রয়োগ করে অনেক ব্যাংকই ছোট গ্রাহক খুঁজছে। সঞ্চয়ী মনোবৃত্তির কারণে অনেক মানুষ নানা সীমাবদ্ধতা, অভাব, দুঃখ দারিদ্র্য থাকলেও নিজেদের সঞ্চিত টাকা পয়সা নিরাপদে জমা রাখতে ব্যাংকে আসা যাওয়া করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে হিসাবের সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ৪২ লাখ ৮০ হাজার ৫৩৬টি। এ সময় ব্যাংক শাখার সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ৯৭৯টি। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ব্যাংক শাখার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪৫৮টি। এ সময়ে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট হিসাবের সংখ্যা গিয়ে পৌঁছে ৭ কোটি ৯১ লাখ ১৪ হাজার ৩৯৬টি।
এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে হিসাব দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ৬১ লাখ ২৬ হাজার ৪৩৪টি। বিশেষায়িত ব্যাংকের হিসাব ৪৩ লাখ ৮৮ হাজার ৪৬টি, বেসরকারি ব্যাংকের ৩ কোটি ৭৮ লাখ ২৬ হাজার ১৮৩টি। বিদেশি ব্যাংকের হিসাবের সংখ্যা ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৯৮৭টি ও নতুন ব্যাংকের ৩ লাখ ১৩ হাজার ৭৪৬টি। চলতি ২০১৬ সালের জুন মাসে সারাদেশে মোট ব্যাংক শাখার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৫৪৩টি। এ সময়ে ব্যাংক হিসাব হয়েছে ৮ কোটি ৯৭ লাখ ৭৭ হাজার ৭১৩টি। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকের হিসাব ৩ কোটি ৮৮ লাখ ২ হাজার ৬৯৭টি।
বিশেষায়িত ব্যাংকের হিসাব ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৭৭৩টি। বেসরকারি ব্যাংকের হিসাবের সংখ্যা হলো ৪ কোটি ২ লাখ ৮৭ হাজার ১৪৭টি। বিদেশি ব্যাংকের হিসাব ৪ লাখ ৯ হাজার ৯৬টি। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের প্রতি নতুন নতুন হিসাব খোলার চাপ রয়েছে। যে কারণে ব্যবসা থাকুক আর নাই থাকুক ব্যাংকগুলোকে নতুন নতুন গ্রাহকের হিসাব খুলতে হচ্ছে। এটাও ব্যাংক হিসাব বাড়ার একটি কারণ। এছাড়াও দ্রুত ডিজিটাইজেশনের ক্ষেত্রে সরকারের নেওয়া নীতি বাংলাদেশে আর্থিক সেবার দক্ষতা বাড়িয়েছে অনেক। ফলে একই সঙ্গে তা অনেক বেশি মানুষের কাছে আর্থিক সেবা (আর্থিক অন্তর্ভুক্তি) পৌঁছে দিতে সহায়তা করেছে।
সমাজের কেউ পিছিয়ে থাকবে না— তেমন লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সব শ্রেণি পেশার মানুষের জন্য ব্যাংকের দুয়ার খোলা রাখার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এটা অনেক সাধারণ মানুষকে ব্যাংকের কাছে টেনে এনেছে। এতে করে বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্টের সংখ্যা যেমন বেড়ে চলেছে তেমনিভাবে আমানতের পরিমাণও বাড়ছে ক্রমেই। সারাদেশে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর শাখা রয়েছে ৩ হাজার ৭১৫ টি। এর মধ্যে ২ হাজার ৬২৪ শাখা বা প্রায় ৭১ শতাংশ এখন অনলাইনের আওতায়। তিন মাস আগেও অনলাইন সেবা দিত ৬৫ শতাংশ শাখা। এক বছর আগে মাত্র ২৪ শতাংশ শাখায় ছিল অনলাইন সেবা। বেসরকারি ও বিদেশি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো দ্রুত সব শাখায় অনলাইন ব্যাংকিং সেবা প্রদানের জন্য নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
অনলাইন ব্যাংকিং এর প্রসারের কারণে দ্রুততার সঙ্গে লেনদেন করার সুবিধা বেড়েছে, এ কারণেও অনেক নতুন গ্রাহকের আগমন ঘটছে বিভিন্ন ব্যাংকে যারা নতুন হিসাব খোলার মাধ্যমে নিয়মিত লেনদেন করছেন। এ ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোঅপারেটিভ সোসাইটি, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানির নামে কোটি কোটি টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ধরা পড়ায় এখন আর কেউ পারতপক্ষে এ ধরনের আর্থিক বিনিয়োগে উত্সাহী হচ্ছেন না। এর আগে অধিক মুনাফা লাভের আশায় অনেকেই নানা প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এ ছাড়াও শেয়ার বাজার ব্যবসায় ক্রমাগত দরপতন বিনিয়োগকারীদের ব্যাংকমুখী করে তুলেছে।
যারা শেয়ার ব্যবসায় নিজেদের জমাকৃত অর্থ বিনিয়োগ করতে উত্সাহী ছিলেন তারা আজকাল ব্যাংকে তাদের জমাকৃত অর্থ আমানত হিসেবে রাখছেন। এ কারণে আজকাল ব্যাংকে হিসাব খোলার মাধ্যমে টাকা নিরাপদে রাখাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করছেন অনেক নারী-পুরুষ। এভাবেও ব্যাংকগুলোতে অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বাড়ার মাধ্যমে আমানতের পরিমাণ বাড়ছে।
সরকারি ব্যাংকগুলোর চেয়ে বেসরকারি ব্যাংকের সেবার মান অনেক উন্নত এবং আধুনিক। তারা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে ব্যাংকে গ্রাহকের সংখ্যা বাড়াতে তত্পর। বেসরকারি ব্যাংকের পারস্পরিক প্রতিযোগিতার কারণেও ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান। ফলে অ্যাকাউন্ট এবং আমানতের সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশে আর্থিক সেবার বিস্তৃতিতে আরো ব্যাংক ও ব্যাংক শাখার প্রয়োজন রয়েছে। তবে বিদ্যমান ব্যাংক শাখাগুলোতে সেবার মান উন্নতকরণ ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরো বেগবান করে তোলা যায়। সূত্র: ইত্তেফাক
সানবিডি/ঢাকা/এসএস