সোমেশ্বরী নদীতে বালু লুটের মহোৎসব, হুমকির মুখে বালিজুরি সেতু-বসতবাড়ি
আপডেট: ২০২৪-১০-২০ ১৫:১৫:১০
শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার সীমান্তবর্তী সোমেশ্বরী নদী থেকে বেপরোয়াভাবে বালু লুটের মহোৎসব চলছে। নির্বিচারে ড্রেজার মেশিনে নদীর পাড় কেটে অবাধে বালু উত্তোলনে বালিজুরি সেতুটি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পরেছে, দেখা দিয়েছে নদী ভাঙ্গন।
ইজারা বহির্ভুত এলাকা থেকে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের ফলে কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ খাড়ামুড়া গ্রামে নদী ভাঙ্গনের আশঙ্কা করছেন গ্রামবাসীরা। বালু উত্তোলন ও অবাধে পরিবহনের কারণে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে দুমড়ে মুচড়ে একাকার হয়ে গেছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।
উপজেলা ভুমি অফিস সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছর সোমেশ্বরী নদীর ঝিনাইগাতী উপজেলার তাওয়াকোচা মৌজায় ৭.২৭ একর এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের জন্য ইজারা দেয়া হয়। জেলা প্রশাসনের পক্ষ টেন্ডারের মাধ্যমে একবছরের জন্য বালু উত্তোলনের অনুমতি লাভ করে শ্রীবরদী উপজেলার সামীম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আক্তার হোসেন। তবে সামীম, আল আমিনসহ আরো কয়েকজন শেয়ারদার বালু উত্তোলন ও দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন।
জানা গেছে, আল আমীনের বাড়ি শ্রীবরদীতে। তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টারে চাকরি করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তার পিতা সুলতান আলমের নামে বালু মহাল ইজারা নিয়ে তিনি চাকরির পাশাপাশি বালুর ব্যবসা চালিয়ে আসছেন। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে চাকরির সুবাদে তিনি বালু উত্তোলনের নিতিমালা উপেক্ষা করে অবাধে বালু লুটপাট চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন আল আমিন।
বালিজুরি গ্রামের সাইফুল ইসলাম, আব্দুর রহিম,তাওয়াকোচা গ্রামের ইউপি সদস্য রহমত আলীসহ আরো অনেকেই জানান, ইজারাকৃত এলাকার নদীতে বালু নেই।
ফলে ইজারাদারের লোকজন লিজ এলাকার বাইরে থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করে আসছেন। লিজ এলাকার বাইরে শতাধিক একর জমি থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা গেছে, লিজ এলাকার বাইরে বালিজুরি, খাড়ামুড়া, রাঙ্গাজানসহ বিভিন্ন স্থানে শতাধিক ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবাধে বালু লুটপাট চালিয়ে আসছে।
দিনেরাতে এসব ড্রেজার মেশিনের সাহায্যে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু। অভিযোগ রয়েছে, ৫ আগষ্ট বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সরকার পতনের পর থেকে সোমেশ্বরী নদীতে বালু উত্তোলনের নিতিমালা ভঙ্গ করে শুরু হয় বালু লুটপাটের মহোৎসব।
অভিযোগে প্রকাশ,বালুদস্যুরা প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের ভয়ে কেউ মুখ পর্যন্ত খুলতে সাহস পান না। আবার কেউ মুখ খুললে তাদের বিরুদ্ধে করা হয় চাঁদাবাজির অভিযোগ। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তাকে পুঁজি করে অবাধে বালু লুটপাট চালিয়ে আসছে বালু খেকোরা।
খাড়ামুড়া ভারত সীমান্তের জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বসানো হয়েছে ড্রেজার মেশিন। বালুদস্যুদের ড্রেজার মেশিনের থাবায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়েছে সোমেশ্বরী নদী ও নদীর দু’পার। হুমকির মুখে পড়েছে বালিজুরি সেতু, খাড়ামুড়া, রাঙ্গাজান গ্রাম, বালিজুরি উচ্চ বিদ্যালয় প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠা। এসব ড্রেজার মেশিনে বালু উত্তোলনের পর ট্রাক ও মাহিন্দ্র যোগে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে।
বালু ব্যবসায়ীদের সাথে কথা হলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিট্রাক বালু ৩৫ হাজার টাকা করে বিক্রি করা হচ্ছে। প্রতিদিন ৫০/৬০ ট্রাক বালু বিক্রি করা হচ্ছে। বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রনকারিরা প্রতিট্রাক বালু থেকে ৮ হাজার টাকা করে রাজস্ব আদায় করে আসছেন। অবাধে বালু উত্তোলন ও পরিবহনের কারণে নদীর দু’পাশের রাস্তাঘাট ডেবে গিয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বালিজুরি সেতুর নিচ থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের কারণে সেতুটি হুমকির মুখে পড়েছে।
তাওয়াকোচা এলাকায় বালুর ট্রাকের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে একটি ঘর ভাড়া নেয়া হয়েছে। এ ঘরে বসে নেয়া হচ্ছে বালুর ট্রাকের রাজস্ব। তাওয়াকোচা ও বালিজুরি বাজারসহ আশপাশের এলাকায় জনগণের চলাচলের রাস্তার উপর স্তুপ করে রাখা হয়েছে বালু।
এতে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি পথচারীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এভাবে প্রতিদিন বিক্রি করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকা মূল্যের বালু। শুধু তাই নয় নদীর আশাপাশের এলাকায় বনের জমিতে গভীর গর্ত করে উত্তোলন করা হচ্ছে বালু।
পাড় কেটে অবাধে বালু লুটপাটের ফলে একদিকে যেমন পরিবেশের ভারসাম্য হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ছে। অপরদিকে প্রতিবছর সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণের রাজস্ব আয় থেকে। অবাধে বালু উত্তোলন ও পরিবহনের কারণে নদীর দু’পাশের রাস্তাগুলো ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পরেছে। বর্তমানে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা মূল্যের বালু উত্তোলন করে অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শুধু তাওয়াকোচা মৌজায় ৭ একর এলাকা থেকে বালু উত্তোলনের বিষয়ে অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বালু উত্তোলনের সাথে জরিত ইজারাদার সামীম আহমেদের সাথে কথা হলে তিনি দাবি করছেন খাড়ামুড়া, রাঙা জান ও বালিজুরি মৌজা থেকে ও বালু উত্তোলনের অনুমতি দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন অনেক সময় ড্রেজার মেশিন মালিকরা তাদের দিক নির্দেশনা অমান্য করে লিজ এলাকার বাইরে থেকে বালু উত্তোলন করেন।
এসব বালু লুটের বিষয়ে বিভিন্ন সময় পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করা হয়েছে। কিন্তু পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হবার পর অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ২/৪ দিন বন্ধ থাকে পরে আবার তা পুরোদমে শুরু হয়। কিন্তু সোমেশ্বরী নদীর লিজ এলাকার বাইরে থেকে বালু লুটপাট বন্ধ হয় না। পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযানও পরিচালনা করা হয়। ভাংচুর করা হয় বালু উত্তোলন যন্ত্র। এর পরেও নির্বিচারে বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না। অবস্থা দেখে মনে হয়, এসব দেখার যেন কেউ নেই।
শ্রীবরদী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ জাবের আহমেদ বলেন লিজ এলাকার বাইরে থেকে বালু লুটপাটের বিষয়টি তাদের জানা আছে। এ বিষয়ে গত মাসে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। ভাংচুর করা হয়েছে বালু উত্তোলন যন্ত্র। আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে। ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি। ঝিনাইগাতী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আশরাফুল আলম রাসেল ও বলেছেন একই কথা।
বিএইচ