একীভূত নয়, সংকটে থাকা ব্যাংক বাঁচাতে বহুমুখী পদক্ষেপ
সানবিডি২৪ প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০২৪-১১-১৩ ১২:৪৭:৪৫
- দুর্বল ব্যাংককে আরও বেশি তারল্য সহায়তার আহ্বান গভর্নরের
- ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে আমানত সংগ্রহে জোর
- রেমিট্যান্স বাড়ানোর মাধ্যমে সংকট উত্তোরণের উদ্যোগ
- করপোরেট গ্রাহক ও উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে বাড়তি আমানত বৃদ্ধির চেষ্টা
- বিশেষ গ্যারান্টিতে বন্ড ছেড়ে তহবিল সংগ্রহ করার জোর তৎপরতা
- বকেয়া বা খেলাপি ঋণ আদায়েও জোর তৎপরতা
- ডাবল বেনিফিট ডিপোজিট স্কিম চালু করেছে কয়েকটি ব্যাংক
বিগত সময়ে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল দেশের বেশকিছু ব্যাংক। বিশেষত, তারল্য সংকটে বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়েছে এসব ব্যাংক। আগের সরকার দুর্বল ব্যাংককে সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নিলেও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিগত দেড় দশকে বিভিন্ন ব্যবসায়ী ও শিল্পগ্রুপের লুটপাটের কারণে দুর্বল হওয়া এসব ব্যাংককে বাঁচাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। দুর্বল হয়ে পড়া এসব ব্যাংককে আরও বেশি তারল্য সহায়তা দিতে সবল ব্যাংকগুলোকে আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর।
গত সোমবার ১৭ ব্যাংকের এমডিদের বৈঠকে গভর্নর বলেছেন, যেসব ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতি ভালো তারা যেন দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আরও একটু বেশি সহায়তা করে। এরই মধ্যে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে সবল ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে অর্থ সহায়তা দিতে একটি নীতিমালা জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই নীতিমালার আলোকেই অতিরিক্ত তারল্য থাকা ব্যাংকগুলোকে আবারও অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নীতিমালা অনুযায়ী, সংকটে থাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ঋণের গ্যারান্টি দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে দেওয়া ঋণের টাকা ফেরত চাইলে সবল ব্যাংকগুলোকে তিন দিনের মধ্যেই তা ফেরত দেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো ব্যাংক ঋণ দেওয়ার জন্য কোনো টাকা নিতে পারবে না। কোন ব্যাংককে কত টাকার তারল্য-সহায়তা দেওয়া হবে, সেটি নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া দুই ব্যাংকের সমঝোতার ভিত্তিতে ঋণের সুদহার নির্ধারণ করা হবে।
এর আগে, বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যস্ততায় ১০টি সবল ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোকে ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। এসব ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য থাকায় তারা সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে ধার দিয়েছে। এসব ধার বা ঋণে গ্যারান্টি বা নিশ্চয়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু ঋণ সুবিধা পেয়েও এসব ব্যাংক ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। গ্রাহকের টাকাও ফেরত দিতে পারছে না। ফলে সংকটও কমছে না। তাই গতকাল নতুন করে ঋণ সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া, বৈঠকে ডলার বাজারের স্থিতিশীলতা নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কি না সেই বিষয়েও জানতে চেয়েছেন গভর্নর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স কাজ করছে। আপতত কোন ব্যাংক বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেই। না কোন ব্যাংক মার্জার করা হবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাঁচাতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা নানা কৌশল ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তারা জানান, সংস্কার করে ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী করা হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেমন নানামুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তেমনই ব্যাংকগুলোকেও পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোয় পর্যাপ্ত তারল্য রয়েছে। কয়েকটি ব্যাংক সংকটে আছে। এগুলোকে সহায়তা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেওয়া হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, তারল্য সহায়তা দিয়ে সবল করতে বিকল্প পথের সন্ধানও করা হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব উদ্যোগে আমানত সংগ্রহ করা। এ লক্ষ্যে কয়েকটি ব্যাংক চড়া সুদে আমানত গ্রহণ করছে। তারল্য সংকট মোকাবিলায় বিদেশি ঋণ বা বিনিয়োগ নিয়েও চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া বকেয়া বা খেলাপি ঋণ আদায়েও জোর তৎপরতা চালাচ্ছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জর্জরিত ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকট উত্তোরণে কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকখাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠনও করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে আর্থিক খাত বিষয়ে অভিজ্ঞ ছয়জনকে সদস্য করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরকে টাস্কফোর্সের সমন্বয়ক করা হয়েছে।
মূলত কয়েকটি গ্রুপ বিদেশে লুটপাট আর বিদেশে অর্থপাচার করে বিপাকে ফেলে দিয়েছে ব্যাংক খাতকে। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে বলেন, নতুন প্রশাসন তদন্ত করছে যে শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি পাউন্ডের সমপরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা বিদেশে সরানো হয়েছে কি না। যুক্তরাজ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের সাবেক সরকারের সহযোগীরা সম্পদ গড়েছেন বলে কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে।
৫ আগস্ট সরকার পতন হলে নতুন গভর্নর দায়িত্ব নিয়ে সংকটে পড়া ব্যাংকগুলোকে টাকা ছাড়িয়ে বা বিশেষ ছাড়ে সুবিধা দেওয়া বন্ধ করে দেন। এতে ব্যাংকগুলোয় সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছিল না। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গ্যারান্টিতে ৫ ব্যাংককে ৫ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছে। এতে সুদের হার ১১ থেকে ১২ শতাংশ। ব্যাংকগুলো নিজস্ব উদ্যোগে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নিতে গেলে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দাবি করছে। এত সুদ দিয়ে আমানত নিয়ে ব্যাংক চালানো কঠিন বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। এ কারণে অন্য ব্যাংক থেকে ধার নিতে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দুর্বল ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলো তারল্যের জোগান বাড়াতে বিকল্প পথের সন্ধান করছে।
এদিকে তারল্য সংকটের স্থায়ী সমাধানের জন্য আমানত সংগ্রহ করার ওপর জোর দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে। এর আলোকে ইতোমধ্যে চড়া সুদ দিয়ে আমানত সংগ্রহ করতে শুরু করেছে। চালু করেছে আকর্ষণীয় মুনাফার সঞ্চয় প্রকল্প। আল-আরাফাহ্ ব্যাংক ডাবল বেনিফিট ডিপোজিট স্কিম চালু করেছে। এতে সাড়ে ৫ বছরে জমা টাকা দ্বিগুণ হচ্ছে। মুনাফার হার ১৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ। শরিয়াভিত্তিক সঞ্চয়ী প্রকল্পে লাখ টাকা জমায় প্রতিমাসে মুনাফা দিচ্ছে এক হাজার টাকা। ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট হিসাবে মুনাফা দিচ্ছে ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ। এক্সিম ব্যাংক ৫ বছর ৪ মাসে দ্বিগুণ মুনাফা দিচ্ছে। লাখ টাকা আমানতে প্রতি মাসে এক হাজার টাকা মুনাফা দিচ্ছে। এনআরবি ব্যাংক আমানতের ওপর সর্বোচ্চ ১৩ দশমিক ৪৬, মেঘনা ব্যাংক সাড়ে ১১, সাউথ বাংলা অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক সাড়ে ১১, এনআরবিসি ব্যাংক ১০ এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ১১ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে। বেসিক ব্যাংক ১০ দশমিক ৬৭ এবং ইসলামী ব্যাংক সাড়ে ১০ শতাংশ মুনাফা দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যাংক সূত্র জানায়, ন্যাশনাল ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, আল-আরাফাহ ব্যাংক ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা ইতোমধ্যে বেশকিছু সাফল্য পেয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংক যুক্তরাজ্যের আর্থিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান থেকে ২০ কোটি ডলার ঋণ নেওয়ার চেষ্টা করছে। ১০ বছর মেয়াদে ৫ শতাংশে সুদে এ ঋণ নিতে ব্যাংকটি জেপি মরগ্যানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
সব ব্যাংকই প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এতে ব্যাংকে তারল্য প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব হবে। যে কারণে ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের কিছু বাড়তি সুবিধাও দিচ্ছে। এ কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহও রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে।
এদিকে ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্টে বাড়তি সুদ দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা আমানত নেওয়ার জন্য ব্যাংকগুলো আকর্ষণীয় সঞ্চয়ী প্রকল্প চালু করেছে। ফলে এসব হিসাবে বৈদেশিক মুদ্রা জমা হচ্ছে। এতে একদিকে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাংকগুলোয় তারল্যের জোগান বাড়ছে।
এএ