শিক্ষক নিজেই বোঝেন না সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি

প্রকাশ: ২০১৬-১১-২২ ১০:৪৩:৩৩


jscবরিশাল অঞ্চলে দুর্দশা সর্বোচ্চ মাত্রায়, পদ্ধতি বোঝেন না ৯২ ভাগ শিক্ষক। সদ্যসমাপ্ত জেএসসি পরীক্ষায় গাইড বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়নের প্রমাণ পেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জোরালো অভিযোগ : শিক্ষকরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণই পাননি।

সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি প্রণয়নের ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও অধিকাংশ শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতিই বোঝেন না। এ কারণে এসব শিক্ষক নোট-গাইড থেকে প্রশ্ন করেন। আবার কোনো কোনো শিক্ষক অন্য স্কুলের প্রশ্ন ধার নেন। এমন শিক্ষকের সংখ্যা বরিশাল অঞ্চলে ৯২ ভাগ। সরকারি হিসাবে সারাদেশে এ সংখ্যা ৪৫ ভাগ। আর শিক্ষক নেতাদের হিসাবে এই সংখ্যা প্রায় ৮০ ভাগ।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সর্বশেষ একাডেমিক সুপারভিশন প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, প্রতিটি স্কুলের শিক্ষকেরা যাতে সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং বাহিরে থেকে প্রশ্নপত্র যাতে সংগ্রহ করতে না পারেন সে বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে শিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে চিঠি পাঠানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষকরা সৃজনশীল বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি। এ কারণে প্রশ্ন প্রণয়ন করতে পারছেন না। অথচ এদের ওপর প্রশ্ন করতে দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়। স্কুল-কলেজের অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায়ও গাইড বই থেকে প্রশ্ন না করার ব্যাপারে কয়েক দফা সরকারি নির্দেশনা জারি করা হয়। ওই নির্দেশনা উপেক্ষা করলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের এমপিও (বেতনের সরকারি অংশ) বাতিল করার কথাও বলা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বরিশাল অঞ্চলের ৫৪৩ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি নিয়ে পর্যালোচনা করা হয়। দেখা যায়, ৫৪৩ টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ২৭ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজেরা প্রশ্ন প্রণয়ন করেন। অন্য বিদ্যালয়ের সহায়তায় প্রশ্ন করেন ১৭ টি বিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা। বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করেন ৪৯৯ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা।
কুমিল্লার ৪২৬ টি প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে দেখা যায়, ১৩৬ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রশ্ন করতে অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তা নেন। বাইরে থেকে প্রশ্ন সংগ্রহ করে পরীক্ষা নেন ৬৪ টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা। নিজেরা প্রশ্ন করতে পারেন ঢাকা বিভাগে এমন প্রতিষ্ঠানের হার ৬৫ ভাগ, ময়মনসিংহে ৪৫ ভাগ, সিলেটে ৫৪ ভাগ, চট্টগ্রামে ৫০ ভাগ, রংপুরে ৫২ ভাগ, রাজশাহীতে ৮০ ভাগ, খুলনায় ৬১ ভাগ, বরিশালে ৫ ভাগ, কুমিল্লায় ৫৩ ভাগ। সারাদেশের হিসাবে এ সংখ্যা ৪৫ ভাগ।
নতুন এ পদ্ধতি  চালুর পর ৬ বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। এ বিষয়ে শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে শিক্ষা অধিদপ্তর দাবি করছে। সৃজনশীল পদ্ধতি জানার জন্য বিদেশেও প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক সরকারি কর্মকর্তা। শিক্ষক প্রশিক্ষণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এরপরও শিক্ষকরা কেন এ বিষয়টি বুঝছেন না। শিক্ষকরাই যদি না বোঝেন তাহলে শিক্ষার্থীদের কী পড়াবেন? আবার প্রশ্ন করতে না পারলে খাতা মূল্যায়নই বা কীভাবে করবেন। তাহলে কী শিক্ষকরা পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পাননি!
সম্প্রতি সমাপ্ত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় গাইড বই থেকে প্রশ্ন প্রণয়নের প্রমাণও পেয়েছে মন্ত্রণালয়। এ কারণে প্রশ্নপত্র প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
২০১০ সালে এসএসসিতে দুটি বিষয়ে সৃজনশীল দিয়ে দেশে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হয়। পরে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর প্রজ্ঞাপন দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। এইচএসসিতেও বর্তমানে প্রায় সব বিষয় সৃজনশীলের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাছাড়া প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকেরও প্রায় সব বিষয়ে পর্যায়ক্রমে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে। একের পর এক বিভিন্ন বিষয় সৃজনশীলের আওতায় আসায় প্রায়ই প্রতিবাদে রাস্তায়ও নামছে শিক্ষার্থীরা।
সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ না দিয়েই ২০১৩ শিক্ষাবর্ষে নবম শ্রেণির গণিত বিষয়ে চালু হয় সৃজনশীল পদ্ধতি। ফলে প্রশিক্ষণ না পাওয়া ‘দুর্বল’ শিক্ষকরা অনুমান করে শ্রেণিকক্ষে সৃজনশীল পদ্ধতিতে গণিত পড়িয়েছেন, নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্ন প্রণয়নও করেন। ওই বছর ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্কুলে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় প্রায় ৮০ ভাগ ছাত্র-ছাত্রী গণিতে ফেল করে সৃজনশীলের কারণে। তা ছাড়া ২০১৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় ফল বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ছিল সৃজনশীল কয়েকটি বিষয়। গণিতে সৃজনশীল চালুর পর স্কুলের পরীক্ষার ফলাফলে দিশেহারা হয়ে পড়েন শিক্ষার্থী ও অভিভাবক। পাবলিক পরীক্ষায়ও যাতে এ পরিণতি না হয় সেজন্য তারা নিজেরাই উদ্যোগী হন এবং ছুটতে থাকেন কোচিং সেন্টার, প্রাইভেট আর নোট-গাইডের পেছনে।
রাজধানীর রফিকুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, ক্লাসে যারা শেখাবেন, সেই শিক্ষকদের বড় একটি অংশ সৃজনশীল পদ্ধতিটা পুরোপুরি বোঝেন না। স্কুল পরীক্ষার প্রশ্ন করতে তারা দ্বারস্থ হন গাইড বইয়ের। প্রশ্ন হুবহু তুলে দেন গাইড বই থেকে। অনেক শিক্ষক সৃজনশীল প্রশ্ন তৈরি করেন গাইড বইয়ের নমুনা প্রশ্ন সামনে রেখে। বাইরে থেকে প্রশ্ন কিনেও পরীক্ষা নেয় অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
সালমা বেগম নামে এক অভিভাবক বলেন, সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীদের মুখস্থপ্রবণতা,  নোট-গাইড ও কোচিং এবং প্রাইভেটনির্ভরতা কমানো। কিন্তু বাস্তবে আগে নোট-গাইড কিনত ছাত্র-ছাত্রীরা আর সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর এখন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকরাও কিনছেন নোট গাইড।
সৃজনশীল পদ্ধতি নিয়ে একটি সেমিনারে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, শিক্ষকরা সৃজনশীলতা  বোঝেন না। সৃজনশীলতা না বোঝার কারণে শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়ই ঝুঁকছেন গাইড বইয়ের দিকে। অভিভাবক ছুটছেন কোচিং সেন্টারের দিকে, প্রাইভেট টিউটরের দিকে। সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি হওয়ার কারণেই এই বিপত্তি হয়েছে। আমাদের শিক্ষা পদ্ধতি সৃজনশীল হলে সমস্যা থাকবে না।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন বলেন, বরিশালের সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত মাস্টার ট্রেইনার রয়েছে। এর পরও কেন শিক্ষকরা প্রশ্ন করতে পারছেন না, এটা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, শিক্ষকদের কিছু সমিতি রয়েছে যারা অন্য শিক্ষকদের প্রশ্ন কিনতে বাধ্য করেন, বিষয়টি এমনও হতে পারে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি বলেন, দেশে এখনও ৮০ ভাগ শিক্ষক সৃজনশীল পদ্ধতি বোঝেন না, প্রশ্ন করতে পারেন না। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। নানাদিক থেকে তারা বঞ্চিত। সৃজনশীল পদ্ধতি পুরোপুরি আশ্বস্ত করতে আরো ১০ বছর লাগবে বলে মনে করেন তিনি। সূত্র: ইত্তেফাক