রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা

প্রকাশ: ২০১৭-০২-১৯ ১০:১৩:১৮


Pmপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে একটি সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশে মিয়ানমারের শরণার্থীদের অস্থায়ী পুনর্বাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন। গতকাল শনিবার হোটেল ব্যারিসার হফ-এ ৫৩তম নিরাপত্তা সম্মেলনের সাইড লাইনে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলের সঙ্গে এক মধ্যাহ্ন ভোজসভায় তিনি এই আহ্বান জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারের শরণার্থীদের পুনর্বাসনের বিষয়টি মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে; কিন্তু পর্যটন শহর কক্সবাজারে তাদের অবস্থান ও কর্মকাণ্ডের কারণে সেখানকার পরিবেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্যানিটেশন ব্যবস্থার বিপর্যয় ঘটছে— যা তাদেরও অমানবিক জীবন যাপনে বাধ্য করছে। তাই বাংলাদেশ সরকার তাদের একটি উন্মুক্ত, স্বাস্থ্যকর এবং নাগরিক সুবিধা সম্বলিত স্থানে সরিয়ে নিতে চায়। এ জন্য জার্মানি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, প্রায় ঘণ্টাকালব্যাপী এই দ্বি-পাক্ষিক বৈঠকে নেতৃবৃন্দ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়াবলী, ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণের মাধ্যমে দুইদেশের সম্পর্ক জোরদার, উন্নয়ন, শরণার্থী সমস্যাসহ নানা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রী জার্মান চ্যান্সেলরকে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিষয়ে অবহিত করেন। বৈঠকের পর দেশে বিদ্যমান মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট সিস্টেমের আরো আধুনিকায়ন দুইদেশের মধ্যে একটি সমাঝোতা স্মারক এবং দুইদেশের মধ্যে সন্ত্রাস প্রতিরোধের লক্ষ্যে একটি যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জার্মান সরকার ও জনগণের সমর্থনের কথা স্মরণ করে সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মারকেলকে দুঃসময়ে জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ধন্যবাদ জানান। স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে দারিদ্র বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন, স্বাস্থ্যসেবা ও স্যানিটেশন, লিঙ্গ সমতা এবং নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য সাফল্যসমূহ জার্মানির চ্যান্সেলরকে অবহিত করেন। শেখ হাসিনা মারকেলকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানালে মারকেল তা সাদরে গ্রহণ করেন এবং ভবিষ্যতে দুই দেশের সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরে আসার আগ্রহও প্রকাশ করেন।
দেশের শিল্পায়ন ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে সারাদেশের একশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় তাঁর সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী জার্মানির উদ্যোক্তাদের এই সুযোগ গ্রহণ করে বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নতুন অংশদারিত্ব সৃষ্টিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে শ্রমিকদের কল্যাণে তাঁর সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ তুলে ধরার পাশাপাশি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধা প্রদানের কথাও জানান।
জার্মানির চ্যান্সেলর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সন্তুষ্টি প্রকাশ করে দুইদেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদ্যমান চমত্কার সম্পর্ক আগামীর দিনগুলোতে আরো দৃঢ় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। দুইদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত এদিনের সমঝোতা স্মারকের আওতায় জার্মানি বাংলাদেশকে প্রায় ৫০ লাখ ই-পাসপোর্ট সরবরাহ করবে এবং ‘জেডিআই’ অনুযায়ী উগ্র চরমপন্থার বিরুদ্ধে উভয় দেশ একযোগে উদ্যোগ গ্রহণ করবে এবং সন্ত্রাস দমনের বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক বিনিময় করবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, মুখ্য সচিব ড. কামাল আব্দুল নাসের চৌধুরী, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক, স্বরাষ্ট্র সচিব ড. কামাল উদ্দিন এবং জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ইমতিয়াজ আহমেদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
জলবায়ু পরিবর্তন এখন নিরাপত্তারও হুমকি
জলবায়ু পরিবর্তনকে নিরাপত্তার অন্যতম হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করে সেদিকে মনোযোগী হতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জার্মানির মিউনিখে সিকিউরিটি কনফারেন্সে গতকাল শনিবার এক প্যানেল আলোচনায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কীভাবে আঞ্চলিক থেকে শুরু করে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে হুমকি হিসেবে আসছে, তা তুলে ধরেন তিনি।
১৯৬৩ সালে স্নায়ুযুদ্ধের পটভূমিতে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সের যাত্রা শুরু হলেও পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে এই সম্মেলন বিশ্ব নিরাপত্তা ও বিভিন্ন পরিবর্তনের প্রেক্ষিত নিয়ে আলোচনা করে থাকে। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব এখন এক অনিশ্চিত যাত্রার পথে রয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তার ধারণা কতগুলো মৌলিক পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন নতুন উপাদান হয়ে এসেছে। খাদ্য, পানি ও অভিবাসন- জলবায়ু পরিবর্তনের তিনটি সরাসরি প্রভাবের কথা উঠে আসে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের আলোচনায়। শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে খাদ্য উত্পাদন ও খাদ্যের মান- দুটোই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়; জীবন ও জীবিকার জন্য নিরাপদ ও সুপেয় পানির সঙ্কট বেড়ে চলেছে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিকভাবে লাখ লাখ মানুষ বাসস্থান স্থানান্তরে বাধ্য হচ্ছে। এটির সরাসরি প্রভাব রয়েছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পদের ওপর, যা নিরাপত্তায় নতুন উদ্বেগ।
জলবায়ু পরিবর্তনের এসব প্রভাবের কারণে সম্পদের উপর চাপ ক্রমে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এটা অস্থিরতা, সহিংসতা ও সংঘাতও বয়ে আনতে পারে। সব ক্ষেত্রেই জাতীয় নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণে জলবায়ু পরিবর্তনসহিষ্ণু শস্য ব্যবস্থা এবং পানির যথাযথ ব্যবহার ও কার্যকর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পানি ব্যবস্থাপনায় একটি বৈশ্বিক তহবিল গঠনের জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি দেশের ব্যর্থতা সবার অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে। তাই নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়া প্রয়োজন। একে বৈশ্বিক ইস্যু হিসেবে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সমাধানও বৈশ্বিক হওয়া উচিত্।’
বর্তমান বিশ্বে নিরাপত্তা আলোচনার ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক কনফারেন্স’ হিসেবে বিবেচিত এই সম্মেলনে বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্র বা সরকার প্রধান হিসেবে প্রথমবারের মতো অংশ নিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশে সরকারের নিজস্ব উদ্যোগে নানা পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি কার্বন নিঃসরণ কম রেখে উন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়ার কথা বলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নিজেদের সম্পদ থেকে ২০০৯ সালে আমরা ৪০০ মিলিয়ন ডলারের ‘ক্লাইমেট চেইঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড’ প্রতিষ্ঠা করেছি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমাদের সাফল্য অনেক দেশ অনুসরণ ও পুনরাবৃত্তি করছে। আমরা উপকূলীয় ৯০০ কিলোমিটার এলাকায় গ্রিনবেল্ট প্রকল্প হাতে নিয়েছি। সারাদেশের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে প্রায় সাড়ে চার মিলিয়ন সোলার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘সোলার নেশন’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে সম্মেলনে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী। প্যানেল আলোচনা শেষে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, তিনি কীভাবে জলবায়ুর বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবেলা করবেন। আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ। বাংলাদেশ এই সমস্যা নিজেরাই মোকাবেলা করতে পারবে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দেশকে সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে উন্নত দেশগুলোর পক্ষ থেকে যে অঙ্গীকার করা হয়েছিল, তার ভবিষ্যত্ কী তা শেখ হাসিনা জানতে চান।