পণ্য পরিবহন বৃদ্ধির তুলনায় বন্দর পিছিয়ে
প্রকাশ: ২০১৭-০৩-১১ ১৭:৫২:২০
বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র (ডব্লিউটিসি) উদ্বোধনের ১৩ মাস পেরিয়ে গেলেও এই কেন্দ্রের ক্লাব ও হোটেল চালু হয়নি। কেন্দ্রটি ঘিরে ব্যবসায়ীরাও যে সুফল পাওয়ার প্রত্যাশা করেছিলেন, তা পেতে দেরি হচ্ছে। দেরি হওয়ার আসল কারণ কী?
মাহবুবুল আলম: বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র উদ্বোধন হয়েছে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি। তবে ভবন নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান কনকর্ড চেম্বারকে বুঝিয়ে দিয়েছে গত নভেম্বরে। সেই হিসাবে পুরো অবকাঠামোর কাজ হয়েছে মাত্র চার মাস আগে। তিনটি বেজমেন্টসহ ২১ তলা উঁচু ভবনটির দুটি অংশ রয়েছে। ভবনটির অর্ধেক অংশজুড়ে চেম্বার কার্যালয়সহ বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের সুযোগ-সুবিধাসম্পর্কিত অবকাঠামো আছে। বাকি অর্ধেক অংশ আন্তর্জাতিক মানের হোটেলের জন্য বরাদ্দ। হোটেলের অংশ ভাড়া দেওয়ার জন্য তিনটি আন্তর্জাতিক হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। চার তারকা মানের হোটেল করতে হলে অন্তত শতকোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। যাঁরা এই বিনিয়োগ করবেন, তাঁরা এখন সম্ভাব্যতা যাচাই করছেন। ব্যবসায়ীদের টাকায় এই ভবন নির্মিত হয়েছে। ফলে হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তাই একটু দেরি হচ্ছে।
হোটেল ভাড়া দেওয়া হলেও বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রে যে ক্লাব হওয়ার কথা, সেটি তো চেম্বার করবে। ক্লাব চালু করতে দেরি হওয়ার কারণ কী?
মাহবুবুল আলম: ক্লাব পরিচালনা করবে চেম্বার। এ জন্য ক্লাবের সদস্যপদ পেতে আগ্রহী ব্যবসায়ীদের কাছে আবেদন আহ্বান করা হবে। ক্লাবের সদস্যপদের জন্য মানদণ্ড ঠিক করাসহ বেশ কিছু কাজ বাকি আছে। আশা করি, জুন মাসে ক্লাবের সদস্যপদের আবেদনপত্র বিতরণ করা হবে, অর্থাৎ প্রাথমিক কার্যক্রম চালু হবে। শুধু চট্টগ্রাম চেম্বারের সদস্যরা নন, সারা দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁরা নির্ধারিত মানদণ্ড পূরণ করতে পারবেন, তাঁরাই এই ক্লাবের সদস্য হতে পারবেন। কারণ এই ক্লাবের সদস্য পদধারী ব্যবসায়ীরা বিশ্বের ৯০টি দেশের তিন শতাধিক ক্লাব ব্যবহার করতে পারবেন। ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে এই বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্র চালুর মাধ্যমে। এখন ক্লাব ও হোটেল চালু হলে তা পূর্ণতা পাবে। তাঁদের বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না।
চট্টগ্রামে ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা এখন কেমন?
মাহবুবুল আলম: বন্দর সুবিধাসহ ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর। তবে বন্দরের সুবিধা কাজে লাগিয়ে যেভাবে চট্টগ্রামে শিল্পকারখানা হওয়ার কথা ছিল তা হয়নি। স্বাধীনতার পর শুধু চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল হয়েছে। ২০০৯ সালে শিল্পকারখানায় গ্যাসের সংযোগ না পেয়ে এখানে বিনিয়োগ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীরা প্রথম ধাক্কা খান। গ্যাসের সংকট তো আছেই, এর পাশাপাশি ঢাকা অঞ্চলের তুলনায় জমির দাম চট্টগ্রামে বেশি। এমনও হয়েছে, কারখানায় অবকাঠামো নির্মাণের চেয়ে জমি কেনায় বেশি খরচ হয়েছে। আবার শিল্পকারখানা গড়তে বা ব্যবসা-বাণিজ্যের নানা কাজে ঢাকায় দৌড়াতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। এসব কারণে অনেক উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম থেকে সরে গিয়ে ঢাকা অঞ্চলে কারখানা করেছেন। এ কারণে চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন খুব বেশি বিনিয়োগ তুলনামূলক কম হয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী, চট্টগ্রামকে ঘিরে যে তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, তাতে বিদেশিদের পাশাপাশি স্থানীয় উদ্যোক্তারা সহজে কারখানা করতে পারবেন। মিরসরাই ও আনোয়ারায় তিনটি অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং টানেলের মাধ্যমে কর্ণফুলীর দুই পারের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হলে সম্প্রসারণ হবে শিল্পাঞ্চলেরও। পাইপলাইনে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি হলে ২০১৯ সালের শুরু থেকেই চট্টগ্রামে বিনিয়োগের সম্ভাবনাও বাড়বে।
চট্টগ্রামে নতুন উদ্যোক্তা আসছেন না। নতুন উদ্যোক্তা উঠে না আসার কারণ কী?
মাহবুবুল আলম: নতুন উদ্যোক্তাদের প্রথম সমস্যা অর্থায়ন। ব্যাংকগুলো নতুন উদ্যোক্তাদের অর্থায়ন করে না। আমরা দীর্ঘদিন ধরে চেম্বার থেকে দাবি জানিয়ে আসছি যে নতুন উদ্যোক্তাদের জামানতবিহীন প্রাথমিকভাবে অন্তত ১০ লাখ টাকার ঋণ দেওয়া হোক। যদি এমন ১০০ উদ্যোক্তাকে ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে ৯০ জন উদ্যোক্তা উঠে আসতে পারবেন। এই উদ্যোক্তারাই একসময় বড় হবেন। নতুন উদ্যোক্তাদের আকৃষ্ট করার জন্য সুযোগ-সুবিধা রাখা দরকার। তাঁরা যাতে এক জায়গা থেকে ব্যবসা-বাণিজ্যসংক্রান্ত সেবা পান বা ওয়ান স্টপ সার্ভিস পান, সেই সুযোগ করে দিতে পারে সরকার।
ব্যবসায়ীরা ইদানীং অভিযোগ করছেন, বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহনের খরচ আগের তুলনায় বেড়েছে। তাঁরা আর আগের মতো সেবা পাচ্ছেন না। বন্দরের পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন তাঁরা। বন্দরের সেবার মান এখন কেমন?
মাহবুবুল আলম: পণ্য পরিবহন বৃদ্ধির সমান্তরালে বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি না পাওয়ায় আগের মতো সেবা মিলছে না। বন্দরে জেটি ও বহির্নোঙরে পণ্য খালাস হয়। বহির্নোঙরে বড় জাহাজ থেকে পণ্য স্থানান্তরের জন্য লাইটার জাহাজের সংকট রয়েছে। সংকটের কারণে গত বছরের শেষার্ধে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আর কনটেইনার হলে জেটিতে এনে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করতে হয়। যেভাবে পণ্য পরিবহন বাড়ছে, সেভাবে বন্দরে জেটি, ইয়ার্ড ও যন্ত্রপাতি বাড়েনি। ফলে কনটেইনার জাহাজগুলো জেটিতে ভেড়ানোর জন্য সাগরে অপেক্ষা করতে হয়। এখন অস্ট্রেলিয়াসহ অনেক দেশ থেকে রপ্তানিকারকেরা বাংলাদেশে পণ্য পাঠাতে কনটেইনারের জন্য বাড়তি ভাড়া নিচ্ছে। পণ্যের মূল্যের সঙ্গে ভাড়াও আদায় করে নেওয়ায় এটা তেমনভাবে চোখে পড়ছে না। এসব সংকট মোকাবিলার জন্য স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পণ্য পরিবহন যেভাবে বেড়েছে, সেই তুলনায় বন্দর অনেক পিছিয়ে আছে। হাতে সময়ও নেই। প্রস্তাবিত বে টার্মিনাল দ্রুত বাস্তবায়নের কথা বলছি আমরা। তা না হলে পণ্য পরিবহনে সামনে বিপর্যয় হবে।