সময়ের দাবি বগুড়ায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা
আপডেট: ২০১৭-০৪-২৯ ১৮:০৫:৫১
ইতিহাস ঐতিহ্যের গৌরব উজ্জ্বল নগরী হলো বগুড়া জেলা। প্রাচীন কালেও বগুড়া জেলা তথা পুন্ড্রনগর ছিল শিক্ষা- সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক উন্নতির সূতিকাগার। একটি বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেই নয় মানুষের সৃজনশীলতার বিকাশ, আত্বিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে ভূমিকা পালন করে থাকে। যুগে যুগে সঞ্চিত অভিজ্ঞতা, নতুন নতুন আবিস্কার ও উদ্ভাবন শিক্ষার বিকাশের মাধ্যমেই বিকশিত হয়েছে।
বৃটিশ ভারতে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ এ অঞ্চল তথা বাংলা অঞ্চলের মুসলমানদের মাঝে বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হয়। মুসলমানদের ক্ষোভ ও দুঃখ মোচনের জন্য বড়লাট লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণার প্রায় এক যুগ পরে ১৯২১ সালের ১লা জুলাই পাশ্চাত্যের অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে থাকা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সচেতনতার ফলে ধর্ম ভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে।
এই রাষ্ট্র দুটি প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সুধী সমাজের ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির রাজনৈতিক চেতনার ফলই হলো আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৮২১ সালে বগুড়া জেলা গঠিত হলেও আজও সেখানে প্রতিষ্ঠা হয়নি কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বৃটিশ শাসনামলে ভারতে আধুনিক শিক্ষার প্রবর্তন হলেও বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশক পর্যন্ত বগুড়ার উচ্চ শিক্ষার জন্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না।
তৎকালীন সময়ে মাধ্যমিক শিক্ষা লাভের পর উচ্চ শিক্ষার জন্য বগুড়া জেলার ছাত্র-ছাত্রীদের পার্শ্ববর্তী জেলায় অবস্থিত রাজশাহী কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং অন্যান্য কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে হতো। উচ্চ শিক্ষা হাতের নাগালে না হওয়ায় এ সুযোগ কেবল সে সময়ের জমিদার, ভূ-স্বামী এবং অন্যান্য ধনী সম্প্রদায়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। ফলে মধ্যবিত্তসহ অপরাপর বগুড়ার শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত ছিল উচ্চ শিক্ষা থেকে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সে সময়ে কতিপয় শিক্ষানুরাগী, সমাজ সেবকের নিরলস প্রচেষ্ঠায় বগুড়ার শিক্ষার্থীদের জন্য সর্ব প্রথম ১৯৩৯ সালের ২ জুলাই প্রতিষ্ঠা পায় আজিজুল হক কলেজ। যা পরবর্তীতে সরকারি করণের মাধ্যমে রূপ লাভ করে বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ নামে। চল্লিশের দশক থেকে এ কলেজটি এ অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পূরন করে আসছে। যা বর্তমানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন। এছাড়া পরবর্তী আরও কয়েকটি অনার্স ও ডিগ্রি কোর্স চালু সম্বলিত কলেজ থাকলেও বগুড়ায় কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় নেই। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বগুড়ার চেয়ে কম অগ্রসর জেলাতেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এমনকি পার্বত্য অঞ্চলেও প্রতিষ্ঠা হয়েছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সে অঞ্চলের শুধু যে শিক্ষারই অগ্রগতি সাধিত হয় তা নয়।
শিক্ষার সাথে সাথে ঐ অঞ্চলে উন্নতি সাধিত হয় অর্থনৈতিক- রাজনৈতিক- সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে জেলায় গড়ে উঠবে শিক্ষিত রাজনৈতিক সচেতনতা বোধ সম্পূর্ণ জনসমাজ। যাদের মাধ্যমে পরিচালিত হতো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রাজনীতি। বিকশিত হত উন্নত গণতান্ত্রিকধারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচালিত হয় সাংস্কৃতিক নানাবিধ কর্মকান্ড। ছাত্র-ছাত্রীরা একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি যুক্ত হয় বহু রকমের সাংস্কৃতিক চর্চায়।
যেমন রোভার স্কাউট, বির্তক ক্লাব, আইটি ক্লাব, সঙ্গীত চর্চা, অভিনয়, চলচিত্র নির্মাণ, ফটোগ্রাফি, পরিবেশ সচেতনতা, পর্যটন, মডেল ইউনাইটেড নেশন, ভাষা প্রতিযোগিতা, গণিত অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড ও প্রভৃতি চর্চার মাধ্যমে পরিশীলত হয় ছাত্র-ছাত্রীদের মননশীলতা। সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে দূরভীত হয় সকল প্রকার গোড়ামী, অনাচার, কুচিন্তা ও কু-সংস্কার ফলে গড়ে উঠে উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন আলোকিত সমাজ। যা সুন্দরভাবে বিচিত্রভাবে, মহৎভাবে বাঁচতে শিখায় মানব মন্ডলী কে। আর এ সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র; ভিত্তিমূল হল বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গন।
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান চর্চার সাথে সাথে গড়ে উঠে উহার চারিপাশে নানা অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নানা চাহিদা মেটাতে গড়ে উঠে নানা ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। যেমন শিক্ষার্থীদের খাওয়ার জন্য হোটেল, বই-পুস্তক ও ফটোকপির দোকান, কাপড়ের দোকান ইত্যাদি। ফলে বিকশিত হতে থাকে অর্থনীতির চাকা। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উদ্যোক্তা হয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললে জেলায় শিল্পায়ন ঘটত। যা অত্র অঞ্চলের অর্থনৈতিক পরিমন্ডল কে পরিবর্তন ঘটাত। বগুড়া জেলার শিক্ষা সংস্কৃতি বিকাশ লাভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।
বগুড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার ফলে এ জেলার ছাত্র-ছাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছে উচ্চ শিক্ষা থেকে। বগুড়া থেকে দূরবর্তী জেলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা আর্থিক অনটনের অভাবে উচ্চ শিক্ষা নিতে পারছে না। ভৌগলিক দূরত্বের কারনে সেখানে থাকা-খাওয়া ও যাতায়াতের জন্য যে খরচ তা অনেক গরীব পরিবারের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না তাদের আর্থিক অসংগতির কারনে। ফলে এ অঞ্চলে উচ্চ শিক্ষার যে উন্নতি হওয়ার প্রয়োজন আজও তা সম্ভব হয়নি শুধুমাত্র এ জেলায় কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় না হওয়ার কারনে বিগত আওয়ামীলীগ (১৯৯৬-২০০১) সরকারে আমলে মাননীয় প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা বগুড়াসহ ১২টি জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন।
ঘোষণা মোতাবেক অন্যান্য জেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রাচীন ইতিহাস ঐতিহ্যর শহর বগুড়ায় আজও কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি। তাই বগুড়া বাসীর প্রাণের দাবী আশু বগুড়ায় বিশেষায়িত কোন বিশ্ববিদ্যালয় নয় একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। আশা করি বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকার খুব দ্রুতই পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী খ্যাত, পত্রিকার নগরী, উত্তরবঙ্গের মধ্যমণি তথা বগুড়ায় একটি সাধারণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
এম ফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উপদেষ্টা, বগুড়া জেলা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কল্যাণ সমিতি।
০১৭১৬-৩২৭৭৫৫
সানবিডি/ঢাকা/এসএস