আওয়ামী লীগের তৃণমূলে দ্বন্দ্বে নিহত ৭, তৎপর কেন্দ্র

প্রকাশ: ২০১৭-০৫-০৮ ১০:১৭:৪৭


B-bariaবিগত এক মাসে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘটিত সংঘর্ষে তৃণমূল আওয়ামী লীগের সাতজন নিহত হয়েছেন। এসব ঘটনায় আহত প্রায় দুই শতাধিক। তবে দলটির নেতারা বলছেন, সকল সংঘর্ষের ঘটনা রাজনৈতিক বলা যাবে না।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ এলাকাতেই মূল দলের নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার সঙ্গে সমর্থক বা রাজনৈতিক অনুসারী হিসেবে যুক্ত হচ্ছেন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। নিজ নিজ আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা জড়িয়ে পড়ছেন সংঘর্ষে। ফলে এসব হতাহতের ঘটনা বাড়ছে।

তৃণমূলের অন্তর্কোন্দল আর প্রাণহানির ঘটনায় অস্থির হয়ে পড়েছেন কেন্দ্রের নেতারা। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এমন সংঘাতে বিব্রত আওয়ামী লীগের সভানেত্রীসহ কেন্দ্রীয় নেতারা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনের আগে সবকিছু সহনীয় পর্যায়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছেন। দলের সাধারণ সম্পাদককে দ্বন্দ্ব নিরসনে দায়িত্ব দিয়েছেন তিনি।

সভানেত্রীর নির্দেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলার নেতাদের মাঝে বিদ্যমান দ্বন্দ্ব নিরসনের উদ্যোগ হিসেবে ছয় জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বিগত মাসের শেষ সপ্তাহে এবং চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত এসব বৈঠকে তৃণমূল নেতাদের বিবাদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে তিনি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছেন।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লায় আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় শনিবার (৬ মে) প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত হন আমির হোসেন রাজন নামে এক ছাত্রলীগ নেতা। দাউদকান্দি উপজেলার পশ্চিম মাইজপাড়া মসজিদের সামনে তার ওপর সশস্ত্র হামলা চালায় প্রতিপক্ষের লোকজন। রাজনের দুই পা-হাতসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে মারাত্মক আহত করা হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ঢামেক হাসপাতালে নেয়ার পথে শনিবার দুপুরের দিকে মৃত্যু হয়।

গত ১৮ এপ্রিল কুমিল্লায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় ফারুখ (২৮) ও সাইদুর রহমান (২৬) নামে দু’জন নিহত হন। মুরাদনগর উপজেলার রহিমপুর এলাকার ওই ঘটনায় কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন।

পরের দিন ১৯ এপ্রিল নরসিংদী আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনায় শারফিন মিয়া (২০) ও মাসুদ (৩০) নামে দু’জন নিহত হন। রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ী গ্রামে সংঘটিত ওই ঘটনায় আহত হন অন্তত ২০ জন।

এরও আগে ১৩ এপ্রিল নোয়াখালীতে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে নূর আলম (৩৫) নামে একজন নিহত হন। হাতিয়া উপজেলার ওই সংঘর্ষের আহত হন অন্তত ১০ জন।

২২ এপ্রিল শরীয়তপুরে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষে ১২ জন গুলিবিদ্ধ ও ২৫ জন আহত হন। একই দিন ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে বোয়ালমারী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ (ওসি) ২৫ জন আহত হন।

৩০ এপ্রিল ফরিদপুরের সালথার আটঘর ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সালথার আটঘর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সোহাগ খানের বাড়িতে কানাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সমর্থকরা হামলা চালায়। এতে জিয়া শেখ নামে একজন নিহত হন। নিহত জিয়া শেখ আওয়ামী লীগের কর্মী। ওই ঘটনায় আহত হন কমপক্ষে ৩০ জন।

মুন্সীগঞ্জে ২ মে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে গুলিবিদ্ধসহ উভয়পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন।

৩ মে পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। উপজেলার মজিদবাড়িয়া ইউনিয়নের সুলতানাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এ ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ১০ জন আহত হন।

২৮ এপ্রিল ময়মনসিংহের গফরগাঁও উপজেলার পাগলা বাজারে বিবাদমান আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ১০ জন আহত হন। ১৫ এপ্রিল পাবনার কসাইপট্টি এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে গোলাগুলি ও বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় চারজন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ১০ জন আহত হন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য বলেন, বেশির ভাগ স্থানে দেখা যাচ্ছে মূল দল আওয়ামী লীগ নেতাদের নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা নিয়ে দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন। মূল দলের সঙ্গে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সমন্বয় না থাকাই সংঘর্ষের মূল কারণ।

তারা বলেন, অঙ্গ-সংগঠনগুলোর প্রধানদের সঙ্গে খুব শিগগিরই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বসবেন। সংগঠনগুলো যেন মূল দলের সঙ্গে সমন্বয় করে চলে এবং নিজেদের যেন সংগঠনের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখার নির্দেশনা দেয়া হবে। মূল দলের নেতাদের নেতৃত্বের প্রতিযোগিতার সঙ্গে যেন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা যুক্ত না হন সে বিষয়েও গুরুত্ব দেয়া হবে বলে তারা জানান।

তৃণমূল আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে এক মাসে সাত কর্মী হত্যা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিজানুর রহমান শেলী বলেন, ‘এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। যখন একটি রাজনৈতিক শক্তি অত্যন্ত প্রবল হয়ে ওঠে, সেই প্রভাবে যখন অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দল বলেন, শক্তি বলেন সেখানেই বড় শক্তির ভেতরে অন্তর দ্বন্দ্ব দেখা দেবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।’

তিনি বলেন, ‘দলের মূল আদর্শ বাদ দিয়ে কেমন করে তাড়াতাড়ি ক্ষমতার কিছু অংশ পাওয়া যায়, কী করে লাভবান হওয়া যায়, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল থাকলে। আওয়ামী লীগের মতো একটা বড় দলের সামনে নির্বাচন আসছে, এমনিই বড় দল তারা। নানা রকম ভাগাভাগি নিয়ে ঈর্ষা, হিংসা, প্রতিযোগিতা, সংঘর্ষ-সংঘাত হতেই থাকবে। সেখানে যদি সত্যিকারের আদর্শবাদী আকাঙ্খা তাদের মাঝে থাকে, নেতৃত্ব যদি তাদের সেদিকে পরিচালিত করতে পারে তাহলে সংঘাত-সংঘর্ষ, মৃত্যু ও আহত হওয়ার ঘটনা কমিয়ে আনা যেত।’

তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ হচ্ছে একটি শক্তিশালী বিরোধী দল। বিরোধী দল যদি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী না হয়, অথর্ব হয়ে থাকে বা দুর্বল করে রাখা হয় তাহলে গণতন্ত্রে সমান সমান অধিকার থাকে না। তখন দলের মধ্যেই নিজস্ব চ্যালেঞ্জ গড়ে ওঠে। সংঘর্ষ-সংঘাতের ঘটনা গড়ে ওঠে।’

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল-আলম হানিফ এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের দেশে প্রায় প্রতিটি মানুষই কোনো না কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সেটা আওয়ামী লীগ হোক, বিএনপি হোক কিংবা অন্য কোনো দলের হোক। কিছু থাকেন কর্মী, নেতা আবার সাধারণ সমর্থকও থাকেন। সামাজিক বা গোষ্ঠীগত বা জমিজমা নিয়ে সংঘাত হলেও সেটা রাজনৈতিক রঙ দেয়া হয়। এগুলো এভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে দেখা গেল সংঘর্ষ হয়েছে, প্রাথমিকভাবে বলা হয় আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ।’

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘দলের আদর্শবিবর্জিত লোকজন যারা আছে তারা এসব সংঘাতে জড়াচ্ছে। আমরা দলের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ করছি। আগামী ২০ তারিখে (মে) আমাদের বর্ধিত সভায় এ নিয়ে আলোচনা হবে।’

সূত্র:  জাগো নিউজ

সানবিডি/ঢাকা/