বাজেট বাড়ছে ২৬%, জনজীবনে চাপ আরো বেশি
প্রকাশ: ২০১৭-০৬-০১ ১৫:১৩:৫৪
স্বস্তিতে নেই জনজীবন। চালের দাম এ-যাবত্কালের সর্বোচ্চে। বাড়ছে গ্যাসের দামও। আবাসিকের পাশাপাশি সিএনজির বর্ধিত মূল্য বাড়িয়ে দেবে পরিবহন ব্যয়। বড় রাজস্ব আহরণের তাগিদ থেকে আরোপ হচ্ছে ১৫ শতাংশের একক ভ্যাটহার। এতে স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে পণ্যমূল্য। বাড়তি এ মূল্য বহন করতে হবে ভোক্তাদেরই, যা জনজীবনে চাপ আরো বাড়িয়ে দেবে।
এমনিতেই ব্যাংকে আমানতের সুদহার এখন ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। এর মধ্যেই আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক দ্বিগুণ করার প্রস্তাব থাকছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে বছর শেষে আমানত থেকে বাড়তি কোনো অর্থ পাবেন না গ্রাহক। এমন পরিস্থিতিতে চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৬ শতাংশ বাড়িয়ে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। জাতীয় সংসদে আজ টানা নবমবারের মতো বাজেট উপস্থাপন করবেন আবুল মাল আবদুল মুহিত।
পরবর্তী এক বছরে দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের একটি রূপকল্প থাকে বাজেটে। বেসরকারি বিনিয়োগে গতি আনতে পরিকল্পনা থাকে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির। তবে এর সবই নির্ভর করে রাজস্ব আহরণের ওপর। বাড়ানো হয় রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা। এবারো ৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে এনবিআরের সামনে। এনবিআরবহির্ভূত কর ও কর ব্যতীত প্রাপ্তিসহ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মোট রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি ১ লাখ ১২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকার মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য বাবদ আসবে ৫৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাকিটা দেশীয় ব্যাংক থেকে ঋণসহ অন্যান্য খাত থেকে সংগ্রহ করা হবে।
বরাবরের মতোই এবারের বাজেটেও অনুন্নয়ন ব্যয়ের অংকটা অনেক বড়। বেতন-ভাতা, ভর্তুকি, ঋণ পরিশোধসহ এ খাতে ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। ব্যয় কাঠামোর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাবদ ধরা হয়েছে সর্বোচ্চ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। এর পর বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও প্রতিরক্ষা খাতে বেশি ব্যয় বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ঋণ পরিশোধ ও ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ থাকছে ২৭ হাজার কোটি টাকা।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের গতি আগের মতো থাকলেও প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে এবার এডিপির আকার ধরা হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও চলতি অর্থবছরের ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়নের হার মাত্র ৫২ শতাংশ। আগামী অর্থবছরের এডিপিতে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ীসহ বড় কয়েকটি প্রকল্পের জন্য বড় অংকের বরাদ্দ থাকছে।
বাজেটের আয়-ব্যয়ের পরিসংখ্যানের চেয়েও এবার বড় হয়ে উঠেছে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের বিষয়টি। নানা জটিলতার কারণে এবার নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের দিকেই নজর সবার। ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে অর্থমন্ত্রী ভ্যাটহার ১৫ শতাংশ থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিলেও শেষ পর্যন্ত ওই হারই বহাল থাকছে বলে জানা গেছে। ভ্যাটহারের পাশাপাশি টার্নওভার ট্যাক্স, আমদানিতে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারসহ নানা বিষয় নিয়ে উত্কণ্ঠায় ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, বাজেটের আকারের চেয়ে বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে নতুন ভ্যাট আইন। আইনটি নিয়ে এনবিআর ও অর্থমন্ত্রী এখনো আমাদের স্পষ্ট কিছু জানাননি। বাজেটের আকার যা-ই হোক, টাকা ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেই নেবে সরকার। তবে ভ্যাটহার, প্যাকেজ ভ্যাট, ট্যারিফ ভ্যালু, সম্পূরক শুল্কসহ বেশকিছু বিষয়ে এখনো কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। এ ভ্যাট আইন নিয়ে স্থানীয় উদ্যোক্তারা শঙ্কায় রয়েছেন। আজকের বাজেটে ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী স্থানীয় শিল্পের সুরক্ষা দিয়েই ভ্যাট সম্পর্কে ঘোষণা আসবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক হলেও তার ছাপ নেই বেসরকারি বিনিয়োগচিত্রে। এবারের বাজেটে ব্যক্তিখাতকে উত্সাহ দিতে ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে বেশ কয়েকটি প্রস্তাব থাকছে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো, শিল্প স্থাপনে বিশেষ প্রণোদনা, ব্যাংকে সঞ্চয়ে কর বৃদ্ধি ও সঞ্চয়পত্রে সুদহার কমানোসহ ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগে কিছু প্রণোদনা রয়েছে। শেয়ারবাজারের জন্য নতুন ঘোষণা না থাকলেও বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ উত্সাহিত করতে অর্থনৈতিক অঞ্চলে কর ছাড়সহ নানা ঘোষণা থাকছে অর্থমন্ত্রীর বাজেটে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগে ভ্যাট অব্যাহতি দেয়ার প্রস্তাব রয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের দাবি অনুযায়ী ভ্যাটমুক্ত টার্নওভারসীমা ৩০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ ও টার্নওভার ট্যাক্সসীমা ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা করার ঘোষণা থাকছে বাজেটে। পাশাপাশি আবাসন, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণাও আসছে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায়।
তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে ২০১৫ সালে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সরকার। পরিকল্পনায় প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা, কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রবৃদ্ধি কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হতাশা ছিল বরাবরের মতোই। সাধারণত জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে কর্মসংস্থানের একটি যোগসূত্র রয়েছে। চলতি অর্থবছর প্রবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি হলেও কর্মসংস্থান সে অনুপাতে হয়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই বছরে মোট কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে ১৪ লাখ। অথচ ২০০২ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর কর্মসংস্থান হয় গড়ে ১৩ লাখ করে। ফলে এবারের বাজেটে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো বলছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রবৃদ্ধিনির্ভর অর্থনৈতিক উন্নয়ন একটি ব্যাধি হিসেবে দেখা দিয়েছে। কয়েক বছর ধরে প্রবৃদ্ধির হার বাড়লেও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তার প্রতিফলন নেই। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশে প্রবৃদ্ধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যে ধরনের উৎপাদনশীলতা দেখা যায়, আমাদের দেশে তা প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে না। আবার ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগেও এক ধরনের বন্ধ্যত্ব দেখা দিয়েছে। উন্নয়ন সবসময়ই মানবসম্পদকে কেন্দ্র করে হতে হবে।
সরকারের হিসাবে বর্তমানে ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ অনেক মন্থর হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন মোট বিনিয়োগ জিডিপির ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ২৩ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। অথচ আগের অর্থবছরগুলোয় মোট বিনিয়োগ জিডিপির ২৮ শতাংশের ঘরে থাকলেও বেসরকারি খাতের অবদান ছিল ২২ শতাংশের ওপরে। সরকারের নীতিসহায়তার অভাবে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগে মন্থরতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা। এবারের বাজেটে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণার প্রত্যাশায় রয়েছেন তারা।
জানতে চাইলে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ও আইনগত বিষয়গুলো অনুকূল থাকলেও জিডিপির অনুপাতে বিনিয়োগের হার কমে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বেসরকারি বিনিয়োগ। বিনিয়োগে গতি আনতে সরকারের যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিগুলো আছে, বিশেষ করে বিদ্যুৎ অবকাঠামোর মতো প্রকল্পগুলো দ্রুততার সঙ্গে শেষ করতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের মতো অবকাঠামোর পরোক্ষ অবকাঠামোয় নজর দিতে হবে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সহজলভ্য করার পাশাপাশি ব্যবসা শুরুর প্রক্রিয়াটা আরো সহজ করতে হবে। পাশাপাশি করের ক্ষেত্রে ভয়ভীতি না দেখিয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা বাজেটে প্রত্যাশা করছি।
২০১০ সালের ধসের ধাক্কা আজো সামলে উঠতে পারেনি দেশের পুঁজিবাজার। দেশের জিডিপির আকার ১৭ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়ালেও পুঁজিবাজারের বাজার মূলধন ৩ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে আটকে আছে। এবারের বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়েও অর্থমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণার আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেএম মাজেদুর রহমান বলেন, ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান সবার হাতেই বিনিয়োগযোগ্য অর্থ রয়েছে। ব্যাংক আমানতে সুদহার অনেক কম। তার পরও শেয়ারাবাজার পিছিয়ে রয়েছে। জিডিপিতে শেয়ারবাজারের বতর্মান অবদান ২১ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার সুযোগ রয়েছে। এ লক্ষ্যে আগামী বাজেটে বিনিয়োগকারীদের উেস কর প্রত্যাহারসহ বেশকিছু প্রস্তাবনা দিয়েছি। সেগুলো বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাজেট কাঠামোয় পুঁজিবাজার নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলে বাজার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সূত্র: বণিক বার্তা