দেশীয় আইসিটি পণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট ও আয়কর অব্যাহতির দাবি
প্রকাশ: ২০১৭-০৬-১৬ ১৬:৩৯:৩৫
প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত বা সংযোজনকৃত ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির দাবি জানিয়েছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। সেইসঙ্গে তারা দীর্ঘমেয়াদে ট্যাক্স হলিডে চেয়েছেন। তাদের মতে, ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে আমদানি পণ্যের সঙ্গে শুরুতেই পেরে উঠবে না স্থানীয় উদ্যোক্তারা। আর দীর্ঘমেয়াদে আয়কর অব্যাহতি পেলে ওই টাকা পূনঃবিনিয়োগের মাধ্যমে এই শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে। তাদের মতে, প্রস্তাবিত কর কাঠামো বহাল থাকলে দেশে মোবাইল ফোন শিল্প গড়ে উঠবে না এবং সরকারের ভিশন ২০২১ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হবে।
উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদিত বা সংযোজনকৃত ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনে সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অন্যদিকে আমদানিকৃত পণ্যের ক্ষেত্রে কোনো সরবরাহ ভ্যাট নেই। এ অবস্থায় কম্পিউটার এন্ড মোবাইল ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (প্রস্তাবিত) সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে। পাশাপাশি, উদীয়মান এ শিল্পে দেশীয় প্রতিষ্ঠানকে কমপক্ষে ১৫ বছরের জন্য আয়কর অব্যাহতির সুবিধা ঘোষণারও দাবি জানিয়েছে এসোসিয়েশনটি।
এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এসএম রেজোয়ান আলম জানান, বাংলাদেশে আইসিটি পণ্য বিশেষত ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন শিল্প বিকাশের লক্ষ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে এসব পণ্যের আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ বা কাঁচামাল আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণের পাশাপাশি ভ্যাট প্রত্যাহারের করা হয়েছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে সম্পূর্ণ তৈরি ল্যাপটপ বা মোবাইল ফোন আমদানি শুল্ক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। পাশাপাশি, রয়েছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। কিন্তু, দেশে তৈরি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে সরবরাহ পর্যায়ে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করেছে এনবিআর। অন্যদিকে, সম্পূর্ণ তৈরি আমদানিকৃত এসব ডিজিটাল পণ্যকে সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হয়েছে। এ ধরনের শুল্ক ও কর নীতি স্থানীয় আইসিটি শিল্পের বিকাশে বড় বাঁধা বলে মনে করেন তিনি।
দেরিতে হলেও এখাতে নজর দিয়েছে বলে এ্যাসোসিয়েশন এর পক্ষ থেকে সরকারকে ধন্যবাদ জানানো হয়েছে। তবে তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট খাতের সুষ্ঠু বিকাশে সরকারকে আরো বিনিয়োগ বান্ধব প্রণোদনা ও নীতি সহায়তা দিতে হবে। তাছাড়া এক্ষেত্রে এখনো কোনো ধরনের নীতিমালা ঘোষণা করেনি সরকার। এ সেক্টরের স্ট্যান্ডার্ড বা মান নিয়ন্ত্রণ বিষয়েও কোনো দিক নির্দেশনা নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এ বিষয়ে লক্ষ্যনীয় কোনো প্রস্তুতিও নেই।
ওই এ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ফাহিম রশিদ জানান, ভারতে মোবাইল ফোন আমদানির উপর ১৭.৯৭ শতাংশ শুল্কারোপ রয়েছে। কাঁচামাল আমদানির উপর গড় শুল্কহার দুই শতাংশেরও কম! তারা এ শিল্পের জন্য পরিকল্পিতভাবে ৩০ বছরের ট্যাক্স হলিডে ঘোষণা করেছে। ভিয়েতনামের কথা বলাই বাহুল্য। একসময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি বিনিয়োগ এবং পর্যাপ্ত শিল্পোদ্যোগের মাধ্যমে এগিয়েছে অনেক দূর। মোবাইল ফোন ওইএম (অরিজিনাল ইক্যুয়েপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার) করেও তারা আয় করছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। অন্যদিকে বাংলাদেশে এ ধরনের শিল্পে বিনিয়োগ করলে আমাদের ৩৫ শতাংশ হারে করপোরেট ট্যাক্স দিতে হবে। তাহলে আমরা দাঁড়াব কীভাবে। এ শিল্প সুরক্ষা পাবে কীভাবে। তিনি এক্ষেত্রে ভারতের মতো ট্যাক্স হলিডে দাবি করেছেন।
খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বে জটিল প্রযুক্তির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের মতো আইসিটি শিল্প। উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন অতী সূক্ষ্ম এবং সংবেদনশীল যন্ত্রাংশ, দক্ষ জনবল এবং নিঁখুত মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা- এই তিনটি মূল ভিত্তির উপরে এ শিল্প প্রতিষ্ঠিত। দেশের তথ্য-প্রযুক্তি খাতের সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে আরো গতি সঞ্চার করতে দেশেই ল্যাপটপ ও মোবাইলফোন শিল্প স্থাপণের মতো সাহসী উদ্যোগ নিয়েছেন বেশ কয়েকজন দেশীয় উদ্যোক্তা। তাদের মধ্যে কেউ কেউ সরকারি নীতি সহায়তার আশ্বাস পেয়ে ইতোমধ্যে কারখানার অবকাঠামো নির্মাণ, যন্ত্রপাতি স্থাপন, গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগ স্থাপনসহ বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করেছেন। এখন শুধু অপেক্ষা পুরো দমে কারখানা চালু করার। কিন্তু, তাদের এ মহৎ উদ্যোগের সফল বাস্তবায়নের পথে বড় বাঁধা হয়ে দাড়িয়েছে সরবরাহ পর্যায়ে বিদ্যমান ভ্যাট।
উদ্যোক্তারা জানান, দেশীয় আইসিটি শিল্পের বিকাশে প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব সুবিধা প্রদান করা হয়েছে, তা থেকে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা লাভবান হতেন। কিন্তু, আমাদনিকৃত আইসিটি পণ্যেকে সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাটমুক্ত রাখা হয়েছে; অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট রাখা হয়েছে। ফলে বিনিয়োগে আগ্রহ হারাচ্ছেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। তারা এ শিল্পে বিনিয়োগ করার যে পরিকল্পনা করছিলেন তা আলোর মুখ দেখছে না বলে মনে করা হচ্ছে।
তারা জানান, দেশের উদীয়মান এ খাতে দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। পাশাপাশি, প্রযুক্তি স্থানান্তরের ক্ষেত্রেও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এ শিল্প। এতে করে, শুরুর দিকে দেশীয় আইসিটি উৎপাদন বা সংযোজন শিল্পে নিয়োজিত কর্মীবাহিনীর প্রোডাকটিভিটি হবে তুলনামূলক কম। আবার, প্রযুক্তি স্থানান্তরের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত বিদেশী কোম্পানির তুলনায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে উপচয়ও বেশি থাকবে। অর্থাৎ, চীনের প্রতিষ্ঠিত একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে একটি ব্যাচ উৎপাদনের সময় যদি ১ শতাংশ পণ্য নষ্ট হয়, সদ্য উৎপাদনে আসা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সমপরিমান পণ্য উৎপাদনে ৭ থেকে ৮ শতাংশ নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে করে, প্রাথমিক পর্যায়ে দেশীয় প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত বা সংযোজনকৃত ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোনের উৎপাদন খরচ বেশি পড়বে।
তাদের মতে, এ অবস্থায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের আইসিটি পণ্য বাজারে সরবরাহের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ, অন্যদিকে সরবরাহ পর্যায়ে আমদানিকৃত পণ্যকে ভ্যাটমুক্ত রাখায় শুরুতেই মুখ থুবড়ে পড়বে স্থানীয় উৎপাদন। হুমকিতে পড়বে এ খাতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের বিশাল বিনিয়োগ।
এসোসিয়েশনের মতে, বর্তমানে দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৩ কোটি। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি। এদের বেশির ভাগই ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন মোবাইলের মাধ্যমে। মোবাইল ফোন ও এর এক্সেসরিজের বাৎসরিক প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বাজার রয়েছে বাংলাদেশে। যার পুরোটাই বর্তমানে আমদানি নির্ভর।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরি হলে লাভবান হবে সরকার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং জনগণ। কারণ বছরে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। রপ্তানি আয় বাড়বে। ব্যাপক কর্মসংস্থান ও দক্ষ জনবল তৈরি হবে। আনুষঙ্গিক ব্যাকওয়ার্ড শিল্প গড়ে উঠবে। গড়ে উঠবে সফটওয়্যঅর শিল্পের বিশাল বাজার। সর্বোপরি ফোন ব্যবহারকারীরা সাশ্রয়ী মূল্যে পাবেন উন্নত মানের ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ হ্যান্ডসেট।