আইনস্টাইনের মহাকর্ষ তরঙ্গের গবেষণায় ৩ বিজ্ঞানীর নোবেল
প্রকাশ: ২০১৭-১০-০৪ ১১:৩২:৩৩
যাদের গবেষণার কারণে আলবার্ট আইনস্টাইনের অপেক্ষবাদ তত্ত্বের সেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বাস্তবে শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, সেই তিন বিজ্ঞানী পদার্থবিদ্যায় চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস মঙ্গলবার এই পুরস্কারের জন্য রাইনার ভাইস, কিপ এস থর্ন ও ব্যারি বারিশের নাম ঘোষণা করে।
জার্মানিতে জন্ম নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক রাইনার কাজ করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)। ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অধ্যাপনা করেছেন কিপ থর্ন।
আইনস্টাইনের মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যে তাত্ত্বিক ধারণার বাইরে গিয়ে বাস্তবেও ধরা সম্ভব, তার প্রথম বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দাঁড় করিয়েছিলেন এই দুজন।
মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ডিটেক্টরের যে নকশা তৈরি করেছিলেন রাইনার, তার ভিত্তিতেই শুরু হয়েছিল লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েব অভজারভেটরি (লাইগো-ভিরগো) প্রকল্পের যাত্রা।
তবে এক সময় যখন এই প্রকল্প থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তের আশা ফিকে হয়ে যাচ্ছিল- সেই সময় ১৯৯৪ সালে লাইগোর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে একে এগিয়ে নেন ব্যারি বারিশ।
লাইগো-ভিরগোর এক সংবাদ সম্মেলনে গতবছর ফেব্রুয়ারিতে ব্ল্যাক হোলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) শনাক্ত করার যুগান্তকারী ঘোষণা দেওয়া হয়।
জার্মান পদার্থবিদ আইনস্টাইন ১৯১৫ সালে তার সাধারণ অপেক্ষবাদ তত্ত্বে এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধারণা দেন, যা স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়।
এই তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব কি না- সে বিষয়ে ১৯৭০ এর দশকেও বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন না। আবার অনেক তাত্ত্বিক সেসব দিনে ওই তরঙ্গের অস্তিত্বই খারিজ করে দিতেন।
অ্যাস্ট্রোনমি ম্যাগাজিনের এক নিবন্ধ বলছে, আইনস্টাইন নিজেও এক সময় ওই তত্ত্ব ‘ভুল’ বলে ভাবতে শুরু করেছিলেন।
শতবছর পর লাইগো-ভিরগোর গবেষকরা জানান, সূর্যের থেকে প্রায় ৩০ গুণ ভারী দুটি কৃষ্ণ গহ্বরের সংঘর্ষ থেকে উৎপন্ন মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ) তারা শনাক্ত করতে পেরেছেন। আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করার পদ্ধতি উদ্ভাবন ও গবেষণার জন্যেই তিন বিজ্ঞানী এবার নোবেল পেলেন।
মহাকর্ষ তরঙ্গ ধরার যে স্বপ্ন বিশ্বের ২০টিরও বেশি দেশের এক হাজারের বেশি গবেষকদের সমন্বিত প্রকল্পে চার দশকের চেষ্টায় বাস্তব হয়ে ধরা দেয়- যুক্তরাষ্ট্রের এ তিন বিজ্ঞানীকে তার পথিকৃত বলছে নোবেল কমিটি।
আলোর মতো গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষ তরঙ্গের মাধ্যমে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু পার্থক্য, মহাকর্ষ তরঙ্গ তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের মতো আলোর বিকিরণ আকারে ছড়ায় না, বরং স্থান নিজেই এক্ষেত্রে তরঙ্গায়িত হয়।
কোনো বালতির পানিতে হাত ডুবিয়ে তুললে পানির উপরিতলে যে মৃদু ঢেউ ধীরে ধীরে বালতির গোলাকার দেয়ালের দিকে ছড়িয়ে যায়, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ স্থানের মধ্যে সেরকম মৃদু ঢেউ তৈরি করে স্থানকে বাঁকিয়ে দেয়।
মহাবিশ্বের কোনো স্থানে উৎপন্ন এই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পৃথিবী পর্যন্ত আসতে আসতে দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এই তরঙ্গের কারণে পৃথিবীর স্থানিক বিকৃতি খুবই সূক্ষ হওয়ায় তা যথাযথভাবে পরিমাপ করা ছিল বড় রকমের চ্যালেঞ্জ।
নোবেল কমিটি বলছে, এই সূক্ষ মাপ-জোখে মহাবিশ্বের অন্যান্য যেসব সব তরঙ্গ ব্যাঘাত ঘটাতে পারে তা বিশ্লেষণ করে রাইনার ভাইস গত শতকের সত্তরের দশকে লেজার ভিত্তিক ইন্টারফেরোমিটারের মতো ডিটেক্টরের নকশা করেন।
এই ডিটেক্টর এসব ব্যাঘাতের ঝামেলা কাটিয়ে পৃথিবীর স্থানিক বিকৃতি পরিমাণ করতে পারে। আর এতে স্থানের বক্রতা প্রমাণিত হওয়ায় স্থাল-কালে বক্রতা তৈরি করা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের অস্তিত্বও নিশ্চিত হন বিজ্ঞানীরা।
এর আগে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করা সম্ভব হতে পারে বলে কিপ থর্ন ও রাইনার ভাইসের দৃঢ় সিদ্ধান্তে উপনীত হন বলেও নিজেদের ওয়েবসাইটে বলছে নোবেল কমিটি।
দেড় বছর আগে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তের ঘোষণাকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে একটি বড় ঘটনা অভিহিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আরশাদ মোমেন আশা করছেন, এ কাজের স্বীকৃতি ভবিষ্যতে তরুণদের পদার্থবিদ্যায় আরো আগ্রহী করে তুলবে।
বর্তমানে ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এই অধ্যাপক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ের গবেষণায় যারা কাজ করেন তারা সাধারণত স্বীকৃতির জন্য কাজ করেন না। তবুও বলা যায়, এই স্বীকৃতি তরুণদের পদার্থ বিজ্ঞান পড়ায় আগ্রহ বাড়াবে।”
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের দেওয়া তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের তাত্ত্বিক ধারণা বাস্তবে প্রথম শনাক্ত করে দেখিয়েছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ও ইতালিয়ান গুলিয়েলমো মার্কনি। আইনস্টাইনের দেওয়া তাত্ত্বিক ধারণায় ভর করে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্তের এই কাজকেও সেই মাপের একটি কাজ অভিহিত করে আরশাদ মোমেন বলছেন, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে মানুষ মহাকাশে বিভিন্ন মহাজাগতিক বস্তুর ম্যাপিং (অবস্থান শনাক্ত) করতে পারবে।
তিনি বলেন, “তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ শনাক্ত করা শেখার পর আমরা এখন আকাশের দিকে তাকিয়ে অবলোহিত রশ্নিসহ বিভিন্ন ধরনের রশ্মি শনাক্ত করতে পারি। এবার মহাকর্ষীয় তরঙ্গ চিহ্নিত করতে পারায় ভবিষ্যতে আমরা মহাকাশে বিভিন্ন গ্যালাক্সি ও ব্ল্যাক হোলসহ নানা ধরনের মহাজাগতিক বস্তু সহজেই শনাক্ত করতে পারব। এভাবে একসময় আমরা পুরো মহাবিশ্বের ম্যাপিং করতে পারব।”
এছাড়া বিগ ব্যাংয়ে মহাবিশ্ব তৈরির সময়ে যদি কোনো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপন্ন হয়ে থাকে সেটিও শনাক্ত করা যাবে বলে আশাবাদ জানান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।
রীতি অনুযায়ী আগামী ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে তিন বিজ্ঞানীর হাতে নোবেল পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। পুরস্কারের ৮০ লাখ সুইডিশ ক্রোনারের অর্ধেক পাবেন রাইনার ভাইস। বাকিটা ভাগ করে নেবেন থর্ন ও বারিশ।
পদার্থের টপোলজিক্যাল দশার গবেষণার জন্য তিন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ডেভিড জে ফাউলেস, এফ ডানকেন হোলডেইন ও জে মাইকেল হসট্রলিজ গতবছর পদার্থে নোবেল পেয়েছিলেন।
বুধবার রসায়ন, শুক্রবার শান্তি এবং আগামী ৯ অক্টোবর অর্থনীতিতে এবারের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হবে। আর সাহিত্য পুরস্কার কবে ঘোষণা করা হবে, সে তারিখ পরে জানানো হবে বলে নোবেল পুরস্কারের ওয়েবসাইটে জানানো হয়েছে।