হত্যার পর ডাকাতির নাটক সাজান আর্জিনা
প্রকাশ: ২০১৭-১১-০৪ ১০:৪৩:৪৯
হত্যার পর ডাকাতির নাটক সাজান আর্জিনাবাড্ডায় নিহত প্রাইভেট কার চালক জামিল শেখ, স্ত্রী ও তার দুই সন্তান। ছবি: সংগৃহীত
সাবলেট থাকা শাহীনের সঙ্গে দীর্ঘ পরকীয়ার জেরেই গাড়িচালক জামিল শেখকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলায় খুন করা হয় জামিলের মেয়ে ৯ বছর বয়সী নুসরাতকেও।
শাহীন সস্ত্রীক জামাল শেখের বাসায় সাবলেট থাকত। আগে থেকেই জামালের স্ত্রী আর্জিনার সঙ্গে শাহীন মল্লিকের পরকীয়া চলছিল। সম্প্রতি তাদের অনৈতিক সম্পর্ক নিজ চোখে দেখে ফেলেন জামাল শেখ।
এরপর থেকেই জামাল শেখের সঙ্গে তার স্ত্রীর ঝগড়া চলছিল। শেষ পর্যন্ত জামাল শেখকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত পাকা করে শাহীন ও আর্জিনা। খুনের পর সাজানো ডাকাতির নাটক প্রচার করতে থাকে আর্জিনা।
বৃহস্পতিবার বাবা-মেয়েকে খুনের পর আর্জিনা এবং শুক্রবার ভোরে প্রযুক্তি সহযোগিতায় খুলনা থেকে গ্রেফতার শাহীন ও তার স্ত্রী মাসুমা খানমকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এ চিত্র পাওয়া যায়।
বাড্ডা থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, জোড়া খুনের ঘটনায় বাড্ডা থানায় হত্যা মামলা হয়েছে। নিহতের ভাই শামীম শেখ বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার নিহত জামিল শেখের স্ত্রী আর্জিনা বেগম ও সাবলেট হিসেবে ওই বাসায় থাকা ভাড়াটিয়া শাহীন মল্লিককে আসামি করে মামলাটি করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের বাড্ডা জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার আশরাফুল কবির বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে আর্জিনার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে শুক্রবার ভোরে খুলনা থেকে শাহীন ও তার স্ত্রী মাসুমা বেগমকে গ্রেফতার করা হয়।
শুক্রবার ভোরের দিকে প্রযুক্তি সহযোগিতার খুলনা নগরীর লবণচরা থানার মোহাম্মদনগর এলাকা থেকে শাহীন ও তার স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের ঢাকা নিয়ে আসা হয়।
পুলিশ বলছে, এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে রয়েছে পরকীয়া। ঘটনার ৩ দিন আগে আর্জিনার সঙ্গে শাহীনকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলেন জামিল শেখ। এরপর থেকেই পারিবারিক কলহ আরও বৃদ্ধি পায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার শাহীনকে নিয়ে স্বামীকে হত্যা করে ডাকাতির নাটক সাজায় আর্জিনা। মেয়েকে হত্যার পরিকল্পনা না থাকলেও ঘটনাচক্রে বাবাকে হত্যার দৃশ্য দেখে ফেলে নুসরাত।
পিতাকে খুন করার দৃশ্য দেখে মা ও শাহীনকে প্রশ্ন করতে থাকলে শাহীন নুসরাতকেও হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। শেষ পর্যন্ত নুসরাতকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
বুধবার রাতে বাড্ডার ময়নারবাগ কবরস্থানের পাশে ‘পাঠানবাড়ি’ নামের একটি চার তলা বাড়ির তৃতীয় তলায় প্রাইভেটকার চালক জামিল শেখ ও তার স্কুলপড়–য়া মেয়ে নুসরাত খুন হয়। জামিল শেখের আরও একটি সন্তান রয়েছে। শুক্রবার তাদের ময়নাতদন্ত করা হয়।
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, ভারি কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করে জামিলকে হত্যা করা হয়। আর নুসরাতকে হত্যা করা হয় শ্বাসরোধ করে।
পুলিশ বৃহস্পতিবার সকালে ওই বাসায় গিয়ে খাটের ওপর জামিল ও নুসরাতের লাশ পায়। জামিলের স্ত্রী আর্জিনা তখন তাদের ৫ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে সিঁড়িতে বসে ছিলেন।
জামিলের পরিচিত গাড়িচালক তুহিন হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার সকালে ওই বাসায় গেলে আর্জিনা তাকে ডাকাতির গল্প বলতে থাকেন। বলেছিলেন, রাতে ‘কয়েকজন এসে’ তার স্বামী আর মেয়েকে খুন করে গেছে।
কিন্তু তাজা রক্ত দেখে তুহিনের সন্দেহ হয়। খবর পেয়ে ছুটে আসে পুলিশ। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। এ সময় পুলিশ আর্জিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। ঘটনার পর থেকেই সাবলেট থাকা শাহীন ও তার স্ত্রী উধাও হয়ে যায়।
বিষয়টি পুলিশের কাছে সন্দেহ হয়। পরে তাদের গ্রেফতারে অভিযানে নামে পুলিশ। শাহীনের স্ত্রী মাসুমা প্রথমে তার স্বামীর পরকীয়ার বিষয়টি টের না পেলেও খুনের পর তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। পুলিশ বলছে, ঘটনাচক্রে মাসুমা জড়িয়ে গেছেন।
পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল কবির বলেন- জিজ্ঞাসাবাদে আর্জিনা জানায়, আগে তারা আরেকটি বাসার দ্বিতীয় তলায় ভাড়া থাকত। একই বাসার তৃতীয় তলায় থাকত শাহীনরা। তখনই তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ৪ মাস আগে বাসা বদলের সময় আর্জিনাই কৌশলে শাহীনদের সাবলেট নিয়ে আসে। এ পরকীয়ার জেরেই বৃহস্পতিবার ভোর রাতে জামিলকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, শাহীনের সঙ্গে আর্জিনার প্রেমের বিষয়টি মাসুমা শুরুতে জানত না। কিন্তু ঘটনাচক্রে সেও জড়িয়ে যায়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, আর্জিনার সঙ্গে শাহীনের প্রেমের বিষয়টি বাড়ির মালিক দুলাল পাঠানও তাদের বলেছেন। গত ৪ মাস ধরে তাদের মধ্যে ভয়ঙ্কর পরকীয়া চলছিল।
জামিলের ভাইয়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, দুই আসামি আর্জিনা বেগম ও শাহীন মল্লিক পরিকল্পিতভাবে ধারালো অস্ত্র ও শক্ত কোনো বস্তু দিয়ে আঘাত করে জামিল শেখকে হত্যা করে। আর নুসরাত জাহানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের আগে জামিল ও নুসরাতের লাশের সুরতহাল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, জামিলের কপালে একটি ও মাথায় পাঁচটি জখমের চিহ্ন ছিল। ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের ফলে ওই জখম হয়েছে বলে তার মনে হয়েছে। লাশের পাশে একটি কাঠের টুকরো পাওয়া গেছে, সেটাও আঘাত করতে ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে।
মামলার বাদী শামীম শেখ বলেন, ‘আর্জিনার পরিকল্পনায় তার পরকীয়া প্রেমিক আমার ভাই ও ভাস্তিকে হত্যা করেছে। আমি হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।’ যুগান্তর