জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসাবে ট্রাম্পের একতরফা স্বীকৃতি

প্রকাশ: ২০১৭-১২-০৭ ১১:৩৩:০৭


trump-jerusalemফ্রান্স, তুরস্ক, সৌদি আরবসহ অনেক মিত্র দেশের আহ্বানকে তোয়াক্কা না করে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতির ঘোষণা দিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তার এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে ওই অঞ্চলে নতুন করে অস্থিরতা তৈরি করতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বুধবার দুপুরে হোয়াইট হাউজে কূটনীতিকদের অভ্যর্থনা কক্ষে এক ভাষণে ট্রাম্প বলেন, “জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির এটাই সময় বলে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

“দুই দশকেরও বেশি সময়ের ছাড় দিয়েও আমরা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তির কাছাকাছি পৌঁছাতে পারিনি।”

জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত বিলম্বিত করতে এতদিন বিশেষ আদেশে পররাষ্ট্র দপ্তরকে আর্থিক ক্ষতি থেকে রক্ষা করে আসছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্টরা। মঙ্গলবারও ট্রাম্প ওই আদেশে সই না করায় তিনি দীর্ঘদিনের রেওয়াজ উল্টে এই ঘোষণা দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।

তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তরে পররাষ্ট্র দপ্তরকে নির্দেশ দিচ্ছেন বলেও জানান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট।

তিনি বলেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই ‘দুই রাষ্ট্র’ সমাধান চাইলে তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সায় থাকবে।

১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানীর স্বীকৃতি দিল।
মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদিদের কাছে পবিত্র নগরী জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে চায় ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ই। ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘোষণা দিলে তা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়ায় ‘মরণ ছোবল’ হবে বলে সতর্ক করেছিলেন ফিলিস্তিনের নেতারা।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে জেরুজালেমে মুসলমানদের পবিত্র স্থানগুলোর জিম্মাদার জর্ডান এ বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সতর্ক করে বলেছে, জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে তার পরিণতি হবে ‘ভয়াবহ’।

এই সিদ্ধান্ত ‘চরম সীমা’ অতিক্রম করবে বলে ট্রাম্পকে সতর্ক করেছিলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিজেপ তায়েপ এরদোয়ান। সৌদি আরবও এতে আপত্তি জানিয়ে বলেছিল, যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করবে।

ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে সায় নেই তাদের অন্যতম মিত্র যুক্তরাজ্যেরও।
মঙ্গলবার ট্রাম্পকে ফোন করে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন বেশ কয়েকটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, যাদের মধ্যে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোও ছিলেন।

পোপ ফ্রান্সিসও জাতিসংঘ প্রস্তাবনা অনুসারে জেরুজালেমের মর্যাদা সমুন্নত রাখার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

ইসরায়েল বরাবরই জেরুজালেমকে তাদের রাজধানী বলে দাবি করে আসছে। অন্যদিকে পূর্ব জেরুজালেমকে ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী করতে চান ফিলিস্তিনের নেতারা।

যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি ম্যানুয়েল হাসাসিয়ান বিবিসিকে বলেন, জেরুজালেম নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি প্রক্রিয়ায় ‘দ্বি-রাষ্ট্রিক সমাধান’ প্রচেষ্টায় ‘মরণছোবল’ এবং ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ শামিল।

এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে পার্লামেন্টে বলেছেন, জেরুজালেম নিয়ে যুক্তরাজ্য অবস্থান বদলায়নি।
“নগরীটির মর্যাদা নিয়ে অবশ্যই আলোচনা করা উচিত এবং এটিকে ইসরায়েল ও ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ভাগ করে দেওয়া উচিত।”

ওদিকে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে উল্লাস প্রকাশ করে অন্যান্য দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলের শিক্ষামন্ত্রী নাফতালি বেনেত্তে।

“এ পদক্ষেপে ইসরায়েলের শত্রুরা মেনে নিতে বাধ্য হবে যে, জেরুজালেম কখনও বিভক্ত হবে না,” বলেছেন তিনি।

ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান আরব, ইউরোপ ও জাতিসংঘের

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছে আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাতিসংঘ।

এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, বুধবার আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলো ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্তকে ‘অস্থিরতা কবলিত অঞ্চলটিতে উত্তেজনা আরো বাড়িয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ’ আখ্যায়িত করে এর নিন্দা জানিয়েছে।

ফিলিস্তিন বলেছে, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ওয়াশিংটন তার নেতৃত্বদানকারী ভূমিকার জলাঞ্জলি দিয়েছে।

জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইসরায়েলে যুক্তরাষ্ট্রের দূতবাস জেরুজালেমে সরিয়ে নেওয়ার ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা ঝুঁকির মুখে পড়বে বলে সতর্ক করেছে।

জেরুজালেম বিষয়ে কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতি পাল্টে দেওয়া ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্ররা।

ট্রাম্পের ‘একতরফা’ সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে ফ্রান্স, পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি বজায় রাখারও আবেদন জানিয়েছে দেশটি।

ব্রিটেন বলেছে, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শান্তি উদ্যোগের ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা রাখবে না এবং জেরুজালেমে ইসরায়েল ও ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের অংশীদারিত্ব থাকা উচিত।

জার্মানি বলেছে, জেরুজালেমের মর্যাদা শুধু দ্বি-রাষ্ট্রীক সমাধানের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র আরব রাষ্ট্রগুলোও ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ইসরায়েলে সঙ্গে প্রথম শান্তিচুক্তি করা মিশর ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, এতেও জেরুজালেমের আইনি মর্যাদা নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটবে না।

জর্ডান বলেছে, পূর্ব জেরুজালেমের ওপর ইসরায়েলি দখলদারিত্বকে দৃঢ় করায় ট্রাম্পের পদক্ষেপ ‘আইনি বৈধতা হারিয়েছে’।

লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আউন বলেছেন, জেরুজালেমের বিষয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত সঙ্কট সৃষ্টি করবে এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রচেষ্টার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বাসযোগ্যতাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে। এই সিদ্ধান্তে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে আর তাতে বৈশ্বিক স্থিতিশীলতাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি।

ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ‘দায়িত্বজ্ঞানহীন’ বলে মন্তব্য করেছে তুরস্ক। ট্রাম্পের এই ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দেশটির সরকার।

ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় তুরস্কের ইস্তাম্বুলে যুক্তরাষ্ট্রের কন্স্যুলেটের বাইরে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করে কয়েকশ প্রতিবাদকারী। কন্স্যুলেট ভবনের দিকে কয়েন ও অন্যান্য বস্তু ছুড়ে মারে তারা।

ট্রাম্পের পদক্ষেপকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিরসনে জাতিসংঘের দেওয়া প্রস্তাবের লঙ্ঘন অভিহিত করে এর ‘তীব্র নিন্দা’ করেছে ইরান। দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থিতিশীল করে ইসরায়েলের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যুদ্ধ শুরু করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

এসব প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “ইসরায়েলে প্রথম দিন থেকে এটি আমাদের লক্ষ্য ছিল, এটি শান্তির পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”