আগামী দুই মাসের মধ্যে সংকট কাটিয়ে উঠবে ফারমার্স ব্যাংক

প্রকাশ: ২০১৮-০২-১৫ ০১:২১:১৩


এম এ জামান

farmas অনিয়মের অভিযোগে নাজুক অবস্থায় থাকা ফারমার্স ব্যাংক আগামী দুই মাসের মধ্যে সংকট কাটিয়ে উঠবে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ পাওয়া সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রদীপ কুমার দত্ত। তিনি বলেন, সংকট উত্তোরণে ব্যাংকটিতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটির প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে এবং স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই সে সুফল পাওয়া যাবে।
প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, বর্তমানে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন ৪০১ কোটি টাকা। আমরা এ মূলধনকে ১৫০০ কোটি টাকা করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। এ জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী নিয়োগ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও বিষয়টি পজেটিভ হিসাবে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। খুব দ্রুত অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আমরা আশা করছি। এ ছাড়াও ব্যাংকটিকে একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে নিয়ে যেতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকার একটি বন্ড ইস্যু করা হয়েছে। এগুলোকে অতিসত্তর বিক্রির অফার দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, একটি ব্যাংকের মূল চালিকাশক্তি হলো ওই ব্যাংকের গ্রাহকরা। গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে না পারলে কোনো প্রতিষ্ঠানই ভালোভাবে রান করতে পারবে না। এ ব্যাংকে একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। এ কারণে কিছুটা হলেও গ্রাহকরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। গ্রাহকদের ভীতির কারণেই এ নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। ব্যাংকের অর্থ সংকট কাটাতে ফান্ড টিম এবং আমানতকারী ও গ্রাহকদের আস্থা ফেরাতে রিকভারি টিম নামে দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন।
প্রদীপ কুমার দত্ত বলেন, ব্যাংকটির বর্তমান চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এহসান খসরু নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছেন। সকলের সহযোগিতায় আমরা আগামি দুই মাসের মধ্যে ব্যাংকটিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে যেতে পারবো।
সূত্র জানায়, ফারমার্স ব্যাংককে এক হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন দিচ্ছে আইসিবির নেতৃত্বে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক। অর্থসংকটে পড়া এ ব্যাংটিকে বাঁচাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ মূলধনের মধে ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) একাই জোগান দেবে ৪৫০ কোটি টাকা। বাকি টাকা তিনটি ব্যাংক বিভিন্ন পরিমাণে মূলধন হিসেবে জোগান দেবে। এ অর্থ যোগ হলে ফারমার্স ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ দাঁড়াবে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এছাড়া আর্থিক ভিত শক্তিশালী করতে ৫০০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক যা বিক্রির অপেক্ষায় রয়েছে। ফারমার্স ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে গৃহীত এ সিদ্ধান্ত এখন বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগানের ব্যাপারে অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শামস-উল-ইসলাম বলেন, আমাদের হাতে বিনিয়োগ করার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ আছে। ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন জোগান দিতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। সরকার অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে যে পরিমান অর্থ চাওয়া হবে আমরা সেটাই দিতে পারবো।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক চাইলে আমরাও ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগান দিতে প্রস্তুত।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তারল্য সংকট কাটিয়ে ওঠা ও মূলধনের জোগান বাড়ানোর শর্তে ফারমার্স ব্যাংকের নতুন পর্ষদ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। আগে বিনিয়োগ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোও এখন ফারমার্স ব্যাংকে মূলধন জোগান দেবে। সোনালী, অগ্রণী ও জনতা ব্যাংক ছাড়াও আইসিবিকে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে।
তবে ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন যোগান দেওয়ার বিরোধীতা করছেন সিবিএ নেতারা। তারা বলছেন, ফারমার্স ব্যাংকের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিনিয়োগ করা নিরাপদ নয়।
উল্লেখ্য ফারমার্স ব্যাংকের পরিস্থিতির অবনতি হতে থাকলে গত বছরের শেষ দিকে ব্যাংকটির পর্ষদে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফারমার্স ব্যাংককে আর্থিক খাতের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে অর্থ মন্ত্রণালয়। এরপর ২৭ নভেম্বর ফারমার্স ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর। তিনি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। একই দিন পদত্যাগ করেন ব্যাংকটির অডিট কমিটির চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতীও। আরেক পরিচালক ড. মোহাম্মদ আতাহার উদ্দিন ভাইস চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এরপর ব্যাংকের পরিচালক মোহাম্মদ মাসুদকে চেয়ারম্যান ও মারুফ আলমকে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হয়। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির সব কমিটিও। এরপর ১৯ ডিসেম্বর ফারমার্স ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদ থেকে একেএম শামীমকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকটিকে নতুনভাবে দাঁড় করাতে পুনর্গঠিত পর্ষদকে তিন মাস সময় দিয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তার পরও ফারমার্স ব্যাংকের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় গত মাসের মাঝামাঝি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে আরেক দফা পরিবর্তন আসে।
ব্যাংকটির পর্ষদের সদস্য ও নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেস অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের চেয়ারম্যান চৌধুরী নাফিজ সারাফাত। নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন প্রাইম ব্যাংকের সাবেক এমডি এহসান খসরু। দ্বিতীয় দফায় এ পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের পরিস্থিতি সার্বক্ষণিক পর্যালোচনা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সমস্যা কাটিয়ে ওঠার জন্য ব্যাংকটির নতুন পর্ষদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তারা ব্যর্থ হলে ব্যাংকটিতে প্রশাসক বসানো হতে পারে।
জানা গেছে, ব্যাংকটিতে ছোট-বড় মিলে সোয়া লাখ আমানতকারীর পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি আমানত আটকা পড়েছে। এ নিয়ে আমানতকারীরাও রয়েছে দু:চিন্তায়।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা বলেন, আমানতকারীদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগ অব্যহত রয়েছে। আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের যে সুযোগ আছে প্রয়োজনে সবই করা হবে।
২০১৩ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নয়টি ব্যাংকের একটি দ্য ফারমার্স ব্যাংক। মোট ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগে ৪০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধন নিয়ে যাত্রা করে ব্যাংকটি। ফারমার্স ব্যাংকের মোট ৪০ কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তার শেয়ার ২৯ কোটি ৩৬ লাখ ১০ হাজার। প্রতিটি শেয়ারের অভিহিত মূল্য ১০ টাকা হিসাবে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ রয়েছে ২৯৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা, যা ব্যাংকটির মোট শেয়ারের ৭৩ দশমিক ১১ শতাংশ। বাকি ১২টি প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর মূলধন ১০৮ কোটি টাকা।
সর্বশেষ গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির গ্রাহক আমানত ৫ হাজার ১২৫ কোটি টাকা এবং আন্ত:ব্যাংক আমানত ৫৩৫ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যাংকটির শাখার সংখ্যা ৫৪টি যার মধ্যে ২৮টি লোকসানে। এটিএম বুথের সংখ্যা ১১টি। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি মোট ঋণ বিতরণ করেছে চার হাজার ৪১৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত বছর প্রায় এক হাজার ৮৩৯ কোটি ৭৯ লাখ টাকা বিতরণ করেছে। ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফারমার্স ব্যাংকের মোট আমানত সংগ্রহের পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার ৬৩ কোটি ৬১ লাখ টাকা। যা ২০১৫ সালে ছিল তিন হাজার ৪৮২ কোটি ৬৬ লাখ টাকা।
ফারমার্স ব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আইসিবি ছাড়াও রয়েছে ফার্স্ট বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড, ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ফার্স্ট জনতা ব্যাংক মিউচ্যুয়াল ফান্ড, পপুলার লাইফ ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ইবিএল ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইএফআইসি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, পিএইচপি ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, ইবিএল এনআরবি মিউচ্যুয়াল ফান্ড, এবি ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়াল ফান্ড, আইসিবি ইউনিট ফান্ড ও তামাম ডিজাইন লিমিটেড।
ফারমার্স ব্যাংক সম্পর্কে গত বছর ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমদ চৌধূরী বলেছিলেন, আর্থিক অনিয়ম ও চলমান সংকটের কারণে ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া উচিত। তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংকের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। কোনো ব্যাংক অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা ঠিক হবে না। বরং ব্যাংক ও আর্থিক খাতের অনিয়ম কমিয়ে আনতে একটি ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া হলে তা উদাহরণ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশে একবার কেউ ব্যাংকের লাইসেন্স পেলে তা বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু ফারমার্স ব্যাংকে যা হয়েছে, তাতে এ ব্যাংকের অবশ্যই মরে যাওয়া উচিত। এসব ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরো শক্তিশালী ভূমিকা দরকার।
এর আগে ২১ ডিসেম্বর ধুকতে থাকা ফারমার্স ব্যাংকে ব্যাপক অনিয়মের জন্য ব্যাংকটির প্রতিষ্ঠাতাদের দায়ী করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, ফারমার্স ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতারাই ব্যাংকটিকে লুটপাট করে শেষ করে দিয়েছে। (ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরই সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীর)। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কোনো ব্যাংকের পতন হয় না। ফারমার্স ব্যাংক বর্তমানে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কেয়ারে আছে। সঙ্কট কাটাতে একটু সময় লাগবে।