নারী: বিজয় ও প্রেরনার বাতিঘর
আপডেট: ২০১৮-০৩-০৯ ১৪:৪৪:১৭
কোন কােলে একা হয়নিকো জয়ি পুরুষের তরবারী
প্রেরনা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে, বিজয়ী লক্ষী নারী।
… কাজী নজরুল ইসলাম।
নারী আমাদের সমাজের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমাজ বির্নিমাণে নারীর রয়েছে সমান অংশিদার। তাদেরকে কখনো ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। যারা নারী দিবসের আবিষ্কারক, তারাই নারীকে পণ্য বানিয়ে রেখেছে। নারীদের যোগ্য সম্মান দিচ্ছে না। নারীরা আজও তাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও কর্মক্ষেত্রে পুরোপুরি নিরাপদ নয়। কিছু স্বার্থনেশি মানুষ নারীদের সরলতার সুযোগ নিয়ে, তাদের নানা অধিকারের কথা বলে ঠকাচ্ছে। তারা নারীদের ভোগের সামগ্রী বানাচ্ছে। তাসলিমা নাসরিন যথার্থই বলেছেন, নিজেদের অধিকারের ব্যপারে সামান্য সচেতন হলে মেয়েরা নিশ্চয়ই বুঝতো যে জগতে যত নির্যাতন আছে মেয়েদের বিরূদ্ধে সবচেয়ে বড় নির্যাতন হল , মেয়েদেরকে সুন্দরী হওয়ার জন্য লেলিয়ে দেওয়া।
আমাদের প্রত্যকটা বিজয়ের পিছনে নারীর অবদান রয়েছে। ইসলামের বিজয়ের পিছনেও রয়েছে নারীর অবদান। হযরত খাদিজার ত্যাগ ও সম্পদ ইসলামকে আজকের এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের পিছনেও নারীদের অবদান রয়েছে। এভাবে আমাদের প্রত্যেকটা বিজয়ে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে নারী। তাই বিশেষ কোন দিনের মাধ্যমে তাদের স্মরণ করে তাদের ছোট করতে চাই না। নারী আমাদের মায়ের জাত, তাদের সর্বদা সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখি।
যারা নারী দিবসে বিশাল শ্লোগান আওরান, তারাই নারীর শ্রমে মূল্য দেন না। আমাদের দেশে নারী শ্রমিকদের যে মূল্যয়ন করা হয়। তা দেখলেই বুঝা যায়, নারীদের আমরা কতটা সম্মান বা মূল্যায়ন করি। নারী-পুরুষ দুই চাকার সাইকেলের মত। দুই চাকা সমান তালে না ঘুরলে যেমন সাইকেলের গতি রোধ হয়, তেমনি নারী-পুরুষ সমান তালে না হলে সমাজেন গতি কমে যাবে। পরিবারে শুরু হবে অশান্তি। সমাজ পাবে কুলাঙ্গার নাগরিক, রাষ্ট্র হারাবে সুনাগরিক।
নারী-পুরুষকে আমি কম্পিউটারের হার্ডওয়ার ও সফটওয়ারের সাথে তুলনা করি। পুরুষ হল হার্ডওয়ার এবং নারী হলো সফটওয়ার। হার্ডওয়ার যেভাবে সফটওয়ারে চারিদিক থেকে সুরক্ষা দেয়, তেমনি একজ পুরুষ নারীকে সার্বিক সুরক্ষা দিয়ে থাকে।
এখন যদি হার্ডওয়ার সফটওয়ারকে বলে তোমাকে দরকার নেই, আমি একাই এক’শ, তাহলে জীবনেও কম্পিউটার কাজ করতে পারবে না। আবার সফটওয়ারও যদি বলে আমার হার্ডওয়ারের দরকার নেই, আমি একাই চলবো, তাও সম্ভব না। হার্ডওয়ার ছাড়া সফটওয়ারের যেমন দাম নেই, তেমনি সফটওয়ার ছাড়া হার্ডওয়ারেরও দাম নেই।
আবার সফটওয়ার যদি মনে করে আমি হার্ডওয়ার হবো, তাহলে প্রযুক্তিতে গণ্ডোগোল শুরু হবে। যার জন্য কম্পিউটার তৈরী, তার উদ্দেশ্য ব্যহত হবে। প্রত্যেকে তার স্ব স্ব স্থানে একদম পারফেক্ট।
একজন নারী সমাজকে উপহার দিতে পারে যোগ্য সু-নাগরিক। সে জন্য দার্শনিক নেপলিয়ান বলেছিলেন, তোমরা আমাকে একটা শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটা শিক্ষিত জাতি দেবো।
নারী অধিকারের পুরধা মানবতার নবী হযরত মুহাম্মাদ (স) বলেছেন, প্রত্যেক নর-নারীর উপর জ্ঞান অর্জন করা (ফরজ) অত্যাবশক। একজন শিক্ষিত মা’ই পারেন একটা দেশের সুনাগরিক তৈরী করতে। এ জন্য মাকে হতে হবে শিক্ষিত, মার্জিত।
ইসলামের আগমনের আগে কন্যা শিশু জন্মদানকে পাপ বা অপমান মনে করা হতো। যে কারণে কন্যা জন্ম হওয়ার পর সে শিশুটির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার ছিল না। সামাজিক মান-সম্মানের অজুহাতে ছোট্ট কন্যা শিশুকে জীবন্ত কবর দিয়ে দেয়া হতো। সেই যুগে মানবতার মহানায়ক মুহাম্মদ (স) জীবন্ত কন্যা সন্তান হত্যা রহিত করে বলেছেন: ‘যার তিনটি কন্যা সন্তান থাকে বা তিনটা বোন থাকে বা দুটি কন্যা থাকে বা দুটি বোন থাকে; আর সে তাদের সঠিকভাবে লালন-পালন করে ও তাদের ব্যাপারে (অন্তরে) আল্লাহর ভয় রেখে কাজ করে; তার বিনিময় সে চিরস্থায়ী জান্নাতে পৌঁছে যাবে।’ (তিরমিজি)
প্রফেট মুহাম্মদ (স) আরো বলেন ‘আমি তোমাদের গুরুত্বের সঙ্গে এ নির্দেশ দিচ্ছে যে, তোমরা নারীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার কর। তোমরা আমার এ নির্দেশ গ্রহণ কর।’ (বুখারি)
ইসলাম নারীকে সর্বক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়েছে বেশি আর পুরুষকে দায়িত্ব ও কর্তব্য দিয়েছে বেশি। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ককে পোশাকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। পোশাকের সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক যত নিবিড়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ততটাই নিবিড় হওয়া চাই। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা তোমাদের পোশাক স্বরূপ এবং তোমরা তাদের পোশাক স্বরূপ।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-১৮৭)
নবী করিম (সা.) স্বামীকে অধিক ধৈর্যশীল ও সহিষ্ণু হতে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন, ‘তোমরা নিজ পত্নীদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহকে সাক্ষী রেখে তোমরা তাদের গ্রহণ করেছ এবং তাঁরই আদেশমতো তাদের তোমাদের জন্য বৈধ করে নিয়েছ। মুমিন স্বামী ইমানদার স্ত্রীর প্রতি বিদ্বেষ ভাব পোষণকারী হবে না। কারণ, স্ত্রীর কোনো ব্যবহারে মনে কষ্ট এলেও পুনরায় তার দ্বারাই এমন ব্যবহার পাবে, যাতে সন্তুষ্টি লাভ হবে।’ (মুসলিম)
নারীর ভালবাসা, একজন পুরুষকে সাফল্যের চূড়ায় পৌছে দিতে পারে। প্রত্যেকে-প্রত্যেকের প্রতি দায়িত্বশীল, নির্ভরশীল ও ভালবাসার সম্পর্ক থাকলে এ বন্ধন হবে চিরস্থায়ী। সামাজিক বন্ধন হবে অটুট।
আমরা নারী অধিকারের জন্য অনেক সচেতনতা দেখালেও নারীদের যোগ্য অধিকার দিতে পারিনি। নারী অধিকার তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে যখন আমাদের সমাজে নারীরা নির্ভয়ে চলাচল করতে পারবে। ধর্ষকের ভয় থাকবে না। নারীরা হবে নিরাপদ। আমরা যদি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, আমাদের দ্বারা কোন নারী ইভটিজিং এর শিকার হয় হবে না, সেই দিন নারী তার মর্যদা ফিরে পাবে। আসুন নারীকে সম্মান করি, মর্যদা দেই, তাহলে সমাজ তার গতি ফিরে পাবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কবি।