মোবাইল ব্যাংকিং-এ দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্বে বাংলাদেশ

আপডেট: ২০১৮-০৭-১৮ ১৩:৪৮:১৪


গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম। শুধু দেশেই নয়, মোবাইল ব্যাংকিং কর্মসূচির প্রসারে পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। গ্লোবাল ফিনডেক্স সূচক-২০১৭ তে এ তথ্য উঠে এসেছে।

mobile-banking_sbবাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংক পরিক্রমা জুলাই-২০১৮ সংখ্যায় বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ব্যাংক পরিক্রমার চলতি সংখ্যায় এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংকিং সেবার বাইরে থাকা ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনার মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল ফিনডেক্স সূচক-২০১৭ এ উল্লেখ করা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবধারীর সংখ্যা ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যার নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবধারীর সংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র ৩ শতাংশ তিন বছরের ব্যাবধানে ২০১৭ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ শতাংশে।

গ্লোবাল ফিনডেক্সের তথ্য অনু্যায়ী, মোবাইল ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে রেমিটেন্স গ্রহণকারীর সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ কেবল দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে নয় বরং এগিয়ে রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যেও।

এর আগে ২০১৪ সালে মোবাইল ব্যাংকিং প্রসারে ভূমিকা রাখার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অ্যালায়েন্স ফর ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন পলিসি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। অ্যালায়েন্স ফর ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক রেগুলেটরদের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, যেটি বিশ্বব্যাপী আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ জোরদার করার জন্য কাজ করছে।
ওই সময় বাংলাদেশে ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বাড়াতে বড় ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ২০০৯ সালে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগদানের পর থেকেই আর্থিক সেবার বাইরে থাকা জনসাধারণকে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেন। তিনি আর্থিক অন্তর্ভুক্তির অংশ হিসেবে প্রথমে গরিব কৃষকদের দশ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ করে দেন।

এ প্রসঙ্গে ড. আতিউর রহমান বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। যার ফল এখন পুরো বাংলাদেশ পাচ্ছে। ফাইন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের রোল মডেল।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিনই বাড়ছে মোবাইল ব্যাংকিং লেনদেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বর্তমানে দৈনিক গড় লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার ওপরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ (মার্চ পর্যন্ত) তথ্য অনুযায়ী, দেশে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) বা মোবাইল ব্যাংকিয়ের নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা ৬ কোটি এক লাখ ৫২ হাজার।
এর মধ্যে সক্রিয় গ্রাহক রয়েছে দুই কোটি দুই লাখ ৬২ হাজার। এসব গ্রাহক প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ১১ কোটি টাকা লেনদেন করেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্ট সংখ্যা আট লাখ চার হাজার ৬১০ জন।

গ্লোবাল ফিনডেক্স সূচক-২০১৭ অনুসারে সারা বিশ্বে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব সংখ্যা ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে বেড়ে দ্বিগুণে উন্নীত হয়েছে। এই সময়ে লেনদেনের পরিমাণও বেড়েছে ১১ শতাংশ।

গ্লোবাল ফিনডেক্স সূচকের তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় উল্লেখযোগ্য প্রসার হয়েছে সাব-সাহারা আফ্রিকায়। ২০১৭ সালে সারা বিশ্বে যেখানে ২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব রয়েছে, সেখানে সাব-সাহারা আফ্রিকায় রয়েছে ১২ শতাংশ লোকের।

উল্লেখ্য, ২০১১ সাল থেকে প্রতি তিন বছর পর বিশ্বব্যাংক এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। বিশ্বের ১৪০টি’রও বেশি দেশের ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি লোকের আর্থিক লেনদেনের ওপর জরিপ চালিয়ে এই ডাটাবেজ তৈরি করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ডাটাবেজটি প্রণয়নের সময় গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে অন্যতম বাধার কারণগুলোকেও।

গ্লোবাল ফিনডেক্স সূচকের তথ্য বলছে, বিশ্বের ৬৯ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ অর্থাৎ ৩.৮ বিলিয়ন লোকের কোনও না কোনও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা মোবাইল ব্যাংকিং সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানে হিসাব রয়েছে। বিভিন্ন দেশে গৃহীত সরকারি নীতি, ডিজিটাল পরিশোধ ব্যবস্থা, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট নির্ভর তরুণ প্রজন্মকেই ২০১৭ সালের সূচকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

এতে উল্লেখ করা হয়েছে, আর্থিক প্রযুক্তির এই ক্ষমতার দ্বারা সাব-সাহারা আফ্রিকায় পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি যেখানে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা ব্যবহার করছে মোট জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশ। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০১৪ সালে যেখানে ৪২ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক লোক টাকা পাঠানো বা ওঠানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করত এখন তার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ শতাংশে।

গ্লোবাল ফিনডেক্স সূচকের হিসাব বলছে, উন্নত বিশ্বের প্রায় সকল নাগরিকের (৯৪ শতাংশ) ব্যাংক হিসাব থাকলেও উন্নয়নশীল দেশে ব্যাংক হিসাব ৬৩ শতাংশ নাগরিকের। ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় হিসাব সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে ৩২ শতাংশ থেকে ৭০ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ভারতে হিসাবধারীর সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ (৮০ শতাংশ) হয়েছে।

ভারতে হিসাব সংখ্যা বাড়ার পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে ২০১৪ সালে মোদি সরকার কর্তৃক গৃহীত প্রধানমন্ত্রী জন-ধন-যোজনা প্রকল্প, যার ফলে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগণ এবং নারীদের হিসাব সংখ্যা বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। পাকিস্তান বা ইথিওপিয়ার মতো কিছু কিছু দেশে সামগ্রিকভাবে হিসাব সংখ্যা বাড়লেও নারীরা বাদ পড়ার ফলে গড় হিসাবে পিছিয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশও রয়েছে এসব দেশেরই কাতারে যেখানে নারীদের চেয়ে পুরুষরা এগিয়ে আছে। যদিও বাংলাদেশে ব্যাংক হিসাবধারীর সংখ্যা ২০১১ (৩২ শতাংশ) সালের তুলনায় ২০১৭ সালে (৫০ শতাংশ) উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। বাংলাদেশের এই সাফল্যের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক গৃহীত আর্থিক অন্তর্ভুক্তিমূলক নানা ধরনের কার্যক্রম।

আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণ কার্যক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে হতদরিদ্র, কৃষক, মুক্তিযোদ্ধা, গার্মেন্টসকর্মী, সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মীসহ সমাজের বিভিন্ন সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী ও শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য ব্যাংকে হিসাব খোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।

বিনা খরচার এ সব হিসাবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হওয়া ১১১টি ছিটমহলে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিক এবং সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত পথশিশু ও কর্মজীবী শিশু-কিশোররাও।

জানা গেছে, সুবিধাবঞ্চিতদের ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনতে ২০১০ সালে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পরের বছর পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা করে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা চালু হয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মোবাইল অপারেটরভিত্তিক হলেও বাংলাদেশে এ সেবা ব্যাংকভিত্তিক। ব্যাংকগুলো বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এ সেবা দিচ্ছে।

দেশের বর্তমানে ৫৭টি ব্যাংকের মধ্যে ২৯টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অনুমোদন নিয়েছে। তবে বর্তমানে কার্যক্রম আছে ১৮টি ব্যাংকের। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করলেও এখন সবচেয়ে এগিয়ে আছে ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ।