তীব্র নগদ অর্থের সংকটে বিমান

আপডেট: ২০১৮-০৭-১৮ ১২:৩৪:৩৩


টিকিট বিক্রি ও কার্গো পরিবহন থেকে কাঙ্ক্ষিত আয় হচ্ছে না। যদিও ব্যয় বেড়েছে বহরে যুক্ত হওয়া উড়োজাহাজের ঋণের কিস্তি পরিশোধ বাবদ। ভাড়ায় আনা উড়োজাহাজের খরচসহ জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য এ ব্যয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আয়-ব্যয়ের এ ব্যবধান তীব্র নগদ অর্থের সংকটে ঠেলে দিয়েছে রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসকে। সংকট কাটাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখতে তাই ভাঙতে হচ্ছে এফডিআর।biman-l

কয়েক বছর ধরে বিমানে নতুন উড়োজাহাজ যুক্ত হতে থাকায় এ বাবদ সংস্থাটির ব্যয়ের অংক বড় হয়েছে। এরই মধ্যে ছয়টি বোয়িং উড়োজাহাজ যুক্ত হয়েছে বিমানের বহরে। আগামী ২০ আগস্ট যুক্ত হচ্ছে একটি বোয়িং ৭৮৭-৮ (ড্রিমলাইনার) উড়োজাহাজ। নভেম্বরে যুক্ত হবে আরো একটি ড্রিমলাইনার। চুক্তি অনুযায়ী প্রতিটি উড়োজাহাজের জন্য কিস্তিতে অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে বিমানকে। কিস্তি হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকা এরই মধ্যে পরিশোধ করা হয়েছে। বহরে যুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় থাকা চারটি উড়োজাহাজের জন্যও কিস্তি পরিশোধ করছে সংস্থাটি।

উড়োজাহাজ ক্রয় বাবদ কিস্তি পরিশোধের পাশাপাশি বীমার অর্থও পরিশোধ করতে হচ্ছে বিমানকে। পাশাপাশি বহরে যুক্ত হতে যাওয়া ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজের জন্য বৈমানিক, কেবিন ক্রু, প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণের পেছনেও ব্যয় করতে হচ্ছে বড় অংকের অর্থ। নতুন উড়োজাহাজগুলোর ইন ফ্লাইট এন্টারটেইনমেন্ট, গ্রাউন্ড সার্ভারসহ অন্যান্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে বিমানকে। যদিও এসব ব্যয়ের বিপরীতে টিকিট বিক্রি ও কার্গো পরিবহন খাত থেকে কাঙ্ক্ষিত আয় হচ্ছে না, যা সংস্থাটিকে নগদ অর্থ সংকটে ফেলে দিয়েছে।

নগদ অর্থ সংকটের বিষয়টি উল্লেখ করেছেন বিমান পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) ইনামুল বারীও। গত ৬ জুন বিমান শ্রমিক লীগ (সিবিএ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, দু্ই মাস ধরে বিমানের আয় কম। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করতে হয়েছে বিমানকে। যাত্রীসেবার মান বাড়াতে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং খাতে ১০০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কিনেছে বিমান। বিমানের বহরে রয়েছে লিজে আনা সাতটি উড়োজাহাজ। এর মধ্যে তিনটি এসিএমআই পদ্ধতিতে লিজে সংগ্রহ করা। এসিএমআই পদ্ধতিতে যে সংস্থা উড়োজাহাজ সরবরাহ করে, তারাই উড়োজাহাজের পাশাপাশি ক্রু, মেনন্টেইন্যান্স ও ইন্স্যুরেন্সের বিষয়টিও নিশ্চিত করে। এসব কারণে এসিএমআই পদ্ধতিতে আনা উড়োজাহাজের বিপরীতে উচ্চমূল্য পরিশোধ করতে হয়। বাকি চারটি উড়োজাহাজ দীর্ঘমেয়াদে ড্রাই লিজে সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া ইজিপ্ট এয়ারলাইনসের কাছ থেকে দুটি বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ পাঁচ বছর মেয়াদে লিজ নিয়েছিল বিমান, যা সম্প্রতি ফেরত দেয়া হয়েছে। এ দুটি উড়োজাহাজের জন্য বিমানকে বড় অংকের লোকসান গুনতে হয়েছে।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, গত কয়েক মাসে বিমানকে বেশকিছু খাতে বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এজন্য অর্থ সংকট তৈরি হয়েছে। সাময়িক এ সংকট মেটাতে ব্যাংকে থাকা বিমান ফ্লাইট ক্যাটারিং সেন্টার (বিএফসিসি) ও পোলট্রি বিভাগের মোট ১০০ কোটি টাকার এফডিআর ভেঙেছে বিমান। তবে এ সংকট শিগগিরই কেটে যাবে। কারণ হজ ফ্লাইট থেকে বিমান নগদ অর্থ আয় করবে।

তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, বিপণন বিভাগের দুর্বলতা ও নিষেধাজ্ঞার কারণে কার্গো পরিবহন থেকে আয় কমে যাওয়াও সাম্প্রতিক সময়ে তারল্য সংকটের অন্যতম কারণ। আর কর্মকর্তাদের দুর্নীতি তো আছেই।

এদিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অন্তত ছয়বার জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। ফলে বিমানের পরিচালন ব্যয়ও গেছে বেড়ে, যদিও প্রতিযোগিতায় থাকতে একই সময় বিভিন্ন রুটে কম ভাড়ার বিভিন্ন অফার ঘোষণা করেছে বিমান। বিপণন বিভাগের দুর্বলতায় গত অর্থবছরে টিকিট বিক্রি থেকে প্রত্যাশিত আয় করতে ব্যর্থ হয়েছে সংস্থাটি। এ অবস্থায় গত বছরের নভেম্বর থেকে বিভিন্ন অফার ও মূল্য কমিয়ে আগাম টিকিট বিক্রি করে নগদ অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে সংস্থাটি।

কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে আর্থিক ক্ষতির বিষয়টি বিমানের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায়ও একাধিকবার উঠে এসেছে। সংস্থাটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষায় দেখা গেছে, কেবল নন-শিডিউলড ফ্রেইটারের কার্গো হ্যান্ডলিং থেকেই ২০১৬-১৭ সময়কালে (দুই বছরে) ৭৬ কোটি টাকা জমা হয়নি বিমানের কোষাগারে। তবে অডিটে ধরা পড়ার পর গত ফেব্রুয়ারি থেকে বিমানের অ্যাকাউন্টে জমা হতে শুরু করেছে নন-শিডিউল ফ্রেইটারের কার্গো হ্যান্ডলিং বাবদ আদায় হওয়া অর্থ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত চার মাসে এ খাত থেকে বিমানের অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে ২০ কোটি ২৪ লাখ ৬৩ হাজার ৩৪২ টাকা। সে হিসাবে ২০০৮ সাল থেকে দীর্ঘ নয় বছরে আদায়যোগ্য প্রায় ৭০০ কোটির অধিক টাকা বিমানের অ্যাকাউন্টে জমা হয়নি। এসব অর্থ জমা হলে বিমানে নগদ অর্থ সংকট অনেকটা এড়ানো যেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

যুক্তরাজ্যের কার্গো নিষেধাজ্ঞা থাকার প্রভাবে এ খাতে প্রতিষ্ঠানটির আয় কমেছে বলে বিমানের আর্থিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে কার্গো খাতে সংস্থাটির আয় হয়েছে ২৪৪ কোটি টাকা। যদিও আগের অর্থবছরে এ খাতে ৩১৫ কোটি টাকা আয় করেছিল বিমান।

উল্লেখ্য, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিমান রাজস্ব আয় করেছে ৩৮১ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৭৭ কোটি টাকা বেশি। এ সময়ে সংস্থাটি কার্গো পরিবহন করেছে ৩৩ হাজার ৫৪২ টন, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১৮ শতাংশ কম।