চাতাল সিন্ডিকেটে চালের বাজার

নিজস্ব প্রতিবেদক প্রকাশ: ২০১৮-০৭-২২ ০৮:৩২:৪৪


উত্তরাঞ্চলে চাতাল সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে চালের বাজার। এ চক্রের কারসাজিতে বাড়ছে অহেতুক মূল্য। মৌসুমের শুরুতে বন্যা ও বর্ষাকে দারুণভাবে কাজে লাগিয়ে কৃষকের ধান কম দামে কিনছে এরা। আবার ধান প্রক্রিয়াজাত করে অস্বাভাবিক বেশি দামে এ চালই ছাড়ছে বাজারে। এ চক্রের খুঁটি শক্তিশালী, এ জন্য স্থানীয় প্রশাসনও অনেকটা অসহায়। অন্যদিকে চাতাল মিল মালিকরা গোপনে প্রত্যন্ত গ্রামে ধানও মজুদ করেছে। বগুড়া, রাজশাহী ও নওগাঁর কৃষক ও প্রশাসনের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

অটো রাইস মিলারদের কর্মকাণ্ড জানতে গত ১১-১৩ জুলাই বগুড়া, রাজশাহী ও নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চল সরেজমিন পরিদর্শন করেন এ প্রতিনিধি। এ সময় কথা হয় সংশ্লিষ্ট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সাধারণ কৃষকদের সঙ্গে। প্রত্যেকেই চালের মূল্য বৃদ্ধির নেপথ্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী করেছেন অটো রাইস মিলারদের।

নওগাঁর গানিতিপুর থানার পসরা গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম জানান, এ বছর ধান ওঠার পরপর অনেক বৃষ্টি হয়েছে। এ জন্য পূর্ণাঙ্গভাবে ধান শুকানো সম্ভব হয়নি। এসব ধানই কম দামে বিক্রি করতে হয়েছে মিলারদের কাছে। একই গ্রামের কৃষক আলতাব বলেন, প্রতি মণ ধান সে সময় ৬০০-৭০০ টাকা ধরে লোকসান দিয়েই বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছি। কারণ বৃষ্টির মধ্যে এ ধান রাখার সুযোগ ছিল না। কৃষক জাহাঙ্গীর জানান, বৃষ্টি থাকার কারণে মিলাররা বড় ধরনের সুযোগ নিয়েছে। এ ধরনের বৃষ্টি ও বন্যা দেখা দিলে মিলাররা ধান কিনতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কারণ কৃষকও দুর্বল অবস্থানে থাকে ধান নিয়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে নওগাঁর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, অটো রাইস মিল মালিকদের চক্রটি খুবই শক্তিশালী। সম্প্রতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে মিল মালিকদের ওপর নজরদারির নির্দেশ আসে। এরপর তাদের নিয়ে একটি বৈঠক ডাকা হয়। কিন্তু ওই বৈঠকে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা অবস্থান নেয় মিলারদের পক্ষে। ফলে নজরদারি ও জবাবদিহিতা খুব বেশি নিশ্চিত করা যায়নি। তিনি বলেন, কতিপয় মিল মালিক রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছে। যেখানে হাত দেয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে।

অভিযোগ রয়েছে, প্রতিবছরই একটি নির্দিষ্ট মৌসুমে কম দাম দিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনে মিলাররা। এ জন্য তারা এমন একটি সময় বেছে নেয় যখন আবহাওয়া খারাপ থাকে। এ সুযোগে কৃষকের ধান নিজেদের কাছে এনে প্রক্রিয়াজাত করে আরও বেশি দামে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এতে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে চাতাল মিল মালিকদের কারসাজির কাছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক মিল মালিকের মজুদের গোপন আস্তানা রয়েছে প্রত্যন্ত গ্রামে। অনেক সময় প্রত্যন্ত গ্রামে গুদামে ধান রেখে দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়। বাইরে লেখা থাকে এ গুদামের পণ্য ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। সেখানে কোনো একটি ব্যাংকের নামও লেখা থাকে। এতে সাধারণ মানুষ দেখলে মনে করবে ব্যাংকের গুদাম। প্রকৃতপক্ষে তা ব্যাংকের নয়। মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে এসব করা হচ্ছে।

হিসাব করে দেখা গেছে, কৃষকের কাছ থেকে গড়ে সাড়ে ৬০০ টাকা মণে ধান ক্রয় করেছে মিলাররা। এক মণ ধানে ১৮ কেজি চাল পাওয়া যায়। ওই হিসাবে প্রতি কেজি চালের মূল্য দাঁড়াচ্ছে সবোঁচ্চ ২৩ টাকা। কিন্তু বৃহস্পতিবার ঢাকার বাজারে এ চাল বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা। অর্থাৎ ক্রয়-বিক্রয়ে পার্থক্য ২২ টাকা। বড় ধরনের এ মুনাফার একটি বড় অংশ নিচ্ছে মিলাররা। সামান্য অংশ আসছে পাইকার ও খুচরা পর্যায়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বগুড়ার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, মিলাররা অকল্পনীয় পরিমাণ ধান মজুদ করেছে। এসব মজুদ দেখার ও নজরদারির দায়িত্ব হচ্ছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। যে কারণে আমরা কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে খাদ্য মন্ত্রণালয় আরও সক্রিয় হলে এদের অবৈধ মজুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে।