বাজেট বৃদ্ধি যখন অর্থহীন হয়

:: আপডেট: ২০১৮-০৭-২২ ০৮:৫৪:৫৯


একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে এ খাতে সরকারি বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন- এ নিয়ে সভ্য সমাজে কোনো মতবিরোধ নেই; থাকার কথাও নয়। নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত খাত যেমন স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবেশকে তুলনামূলক বেশি গুরুত্ব না দিয়ে কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা একেবারেই অসম্ভব। তাই বাজেট প্রণয়নের সময় এলেই আমাদের তথাকথিত বিশেষজ্ঞরা অন্যান্য খাতের চেয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে তুলনামূলক বেশি বরাদ্দের দাবি করেন। অন্য কোনো দিক বিবেচনায় না নিয়েই এই দাবিটি পাকিস্তান আমল এবং বাংলাদেশ জন্মের ঠিক অব্যবহিত পরে সঠিক ছিল; এখন নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পর, পুরনো এমন একটি খাতে শুধু বাজেট বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়; হোক সেটা শিক্ষা খাত। বিদ্যমান ও পুরনো আমাদের এই শিক্ষা ব্যবস্থাটি কোন পথে কীভাবে চলছে, তা বিবেচনায় নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন উল্টো পথে কিংবা ভুল পথে চলমান একটি গাড়িতে আমরা যতই জ্বালানি বৃদ্ধি করি না কেন, লাভ নেই; গাড়িটি আরও দ্রুতগতিতে ভুল পথে অগ্রসর হবে। তেমনি ভারসাম্যহীন অবস্থায় উল্টো কিংবা ভুল পথে উন্নয়ন হওয়া কোনো খাতে আমরা যতই বাজেট বৃদ্ধি করি না কেন; কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। আদর্শিক ও কল্যাণকর মনে করা হলেও শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধির এই দাবিটি আবেগেই থেকে যাবে। যারা এ দাবি করেন তারা দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন দাঁড় করিয়েছেন যে, শিক্ষা এমন একটি খাত, যেখানে অন্য বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে শুধু বাজেট বৃদ্ধি করলেই এক সময় শিক্ষার উন্নয়ন হতে বাধ্য।

বর্তমান সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে খুবই আন্তরিক- এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এই আন্তরিকতার নমুনাও আমরা দেখি। বর্তমান সরকার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই শিক্ষার একমুখীকরণের কথা খুব জোরেশোরে শোনা গিয়েছিল। খুব যৌক্তিকভাবেই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের বাস্তবতায় কর্মমুখী কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। অপ্রয়োজনে খুব বেশি সংখ্যক সম্মান কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বেকার তৈরি করবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, সরকার আবেগের বশবর্তী হয়ে শিক্ষার মান নিশ্চিত না করে এর লাগামহীন প্রসার ঘটিয়ে যাচ্ছে। সমান্তরালভাবে কারিগরি শিক্ষারও প্রসার ঘটাচ্ছে। কখনও কখনও একমুখী শিক্ষার প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষা বিস্তারেও কম ভূমিকা রাখছেন না, যা মারাত্মক ধরনের স্ববিরোধিতার জন্ম দিচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা হয়েছে ভারসাম্যহীন।

উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) ২০১৬ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী জাতীয়, উন্মুক্ত ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বাদে বাংলাদেশে বর্তমানে মোট ৪১টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে। গত শতাব্দীর ১৯২১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই ৮০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল মাত্র ১০টি। আর বাকি ৩১টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে গত ১৭ বছরে। এই সময়ের মধ্যে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ব্যাপক হারে বিভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ১৯৯৫-২০১৬ সময়ে প্রতি বছর গড়ে বিভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৫টির বেশি আর শিক্ষক ৪৪৭ জন, যা দিয়ে বিভাগের সংখ্যায় বুয়েটের মতো দুটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায়। এই বিভাগ বৃদ্ধি হিসাবে নিলে গত ১৭ বছরে প্রকৃতপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় বৃদ্ধি পেয়েছে ৩১টিরও অনেক বেশি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় মানের প্রচুর শিক্ষক নিয়োগের চাহিদা তৈরি হয়েছে। পুরনো মাত্র ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে কী করে সম্ভব নিজেদের ঘাটতি পূরণ করে ৩১টির বেশি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো মানের শিক্ষক জোগান দেওয়া? এটি প্রায় অসম্ভব। আরও উল্লেখ্য, এই সময়ের মধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা আবার ১০০ ছাড়িয়েছে! এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র-শিক্ষকের শ্রমে দাঁড়িয়ে আছে। তাই বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ভালোমানের শিক্ষকের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতায় ভুগছে।

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকের চাহিদা ও জোগানের ঐতিহাসিক এই ভারসাম্যহীনতার পরিসংখ্যানিক বিশ্নেষণ করতে এ নিবন্ধের লেখক ও তার দুই ছাত্র রেজুয়ান আহমদ আর কাইয়ুম আরাফাত ১৯৯৫ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভাগ ও শিক্ষকের সংখ্যা নিয়ে একটি গবেষণা চালায়। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন থেকে এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। গত ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যাল্যগুলোতে মোট বিভাগ ছিল ২৩৪টি; এই সংখ্যাটি গত ১৮ বছরে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে হয়েছে ৯৫৫। একই সময়ে শিক্ষকও বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় বিভাগ বৃদ্ধির হারে। যেখানে ১৯৯৮ সালে মোট শিক্ষক ছিলেন ৮৩০৩ জন; মাত্র ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬ সালে মোট শিক্ষক ১৩,০৭২ জন। বিভাগ বৃদ্ধির হারে শিক্ষক বৃদ্ধি পাওয়া নিশ্চয় চাহিদা পূরণে যথেষ্ট নয় বরং অনাকাঙ্ক্ষিত। পরিসংখ্যানিক পদ্ধতিতে বিভাগ ও শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধির পারস্পরিক সম্পর্ক বিশ্নেষণে দেখা যায়, এ সম্পর্কের মাত্রা মাত্র ০ দশমিক ৬৫, যা মোটেও তাৎপর্যপূর্ণ নয়। যেখানে বিভাগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি ও ইতিবাচক সম্পর্ক রেখে শিক্ষক বৃদ্ধি পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে মোটামুটি সম্পর্কহীনভাবেই বিভাগ ও শিক্ষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

গত ১৯৯৫ সালে প্রতি বিভাগে গড়ে ১৭ জনের বেশি শিক্ষক ছিলেন। বিভাগপ্রতি শিক্ষকের এই গড় সংখ্যা ১৯৯৭-৯৮ সালে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়ে বাকি সময়টাতে ধারাবাহিকভাবে কমেছে; ২০১৬ সালে এসে প্রতি বিভাগে গড়ে ১৩ জন শিক্ষক আছেন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও এর বিভাগ বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বিভাগে (চাহিদা অনুযায়ী) মূল প্রোগ্রামের সমআকার ও বেশি গুরুত্বের (অতিরিক্ত আয়ের লোভ) সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে। এই সান্ধ্যকালীন কোর্স ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগামহীন অতিদ্রুত বৃদ্ধি হিসাবে নিলে ২০১৬ সালে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগপ্রতি ১৩ জন শিক্ষকের গড় সংখ্যাটা তা আরও কমে (অনুমানিক) ৫-৬ জন হয়ে যাবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এই সময়কালে বিভাগপ্রতি শিক্ষকের গড় সংখ্যাটা মোটামুটি ২৬ থেকে ৩০ জনের মধ্যেই ওঠানামা করেছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে এই সংখ্যাটা ছিল ২২ জনে, বুয়েটে এই সংখ্যাটা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৩৮ জনে দাঁড়ায়; বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ জন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ১০ জন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে অবশ্য এই সময়ে বিভাগের সংখ্যা মাত্র দুটি করে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিভাগপ্রতি শিক্ষকের সংখ্যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো; জাহাঙ্গীরনগর ও শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা রাজশাহীর মতো, খুলনা ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো। নতুন শতাব্দীতে এসে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিভাগপ্রতি শিক্ষকের সংখ্যায় সেগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ।

নতুন শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যতিক্রম শুধু বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগেই যে প্রতিষ্ঠানগুলোর একটা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছিল, যেমন ডুয়েট, কুয়েট, রুয়েট ও চুয়েট। গত ২০১৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগপ্রতি শিক্ষকের গড় সংখ্যা ৫, হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬, মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১১, পটুয়াখালীতে ৩, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারিতে ৬ ও সিলেট কৃষিতে ৪ জন করে; নোয়াখালী, কুমিল্লা ও কাজী নজরুল- এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০ জন করে। যশোর, বেগম রোকেয়া, গোপালগঞ্জ ও পাবনা- এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক বিভাগে গড়ে প্রায় ৬ জন শিক্ষক আছেন।

যখন যে দল দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকে না, সেই দল সমর্থিত শিক্ষকদের প্ল্যানিং কমিটি নিয়ন্ত্রিত বিভাগগুলোতে তারা ক্ষমতায় না আসা পর্যন্ত নিয়োগ আটকে রাখার জোর চেষ্টা চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা অনুযায়ী, যেখানে প্রতি বছর বিভাগের কমিটি অব কোর্সেসের মিটিং করে সিলেবাস আপডেট করা হয়, সেখানে বছরের পর বছর শিক্ষক আপডেট হচ্ছে না; তাও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে! যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আজ বিষয়ভিত্তিক পড়ার প্রতি অমনোযোগী হয়ে উঠেছে। এখন দেখি ছাত্ররা প্রথম বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই যদি হয় প্রকৃত অবস্থা, তাহলে শুধু শুধু কেন ছাত্ররা এত কষ্ট করে একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পাঁচ বছর পড়তে যাবে! শিক্ষার এ দুরবস্থা সামাজিক অবক্ষয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে আজ দেখছি, বুয়েট-মেডিকেলে পড়া ছাত্ররা অবৈধ টাকা ও ক্ষমতার মোহে তাদের নিজের স্বপ্নের (ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হওয়া) সঙ্গে প্রতারণা করে বিসিএস সম্পন্ন করে পুলিশ-প্রশাসনে চাকরি নিচ্ছে।

শুনেছি, সরকার পরিকল্পনা নিয়েছে, খুব দ্রুতই প্রতি জেলায় একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করবে। সরকার ভাবছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তো চলছেই! এক-দুই বছর সেশনজটে হলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা বের তো হচ্ছে! কোনো কোনো বিভাগে খুব আশ্চর্যজনকভাবে দুই-তিনজন শিক্ষক মিলেই পাঁচ-ছয়টি ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছেন কোনো রকম সেশনজট ছাড়াই। শিক্ষকদের বেতনের বাইরে পরীক্ষা নেওয়া সংক্রান্ত বিভিন্ন ধরনের পারিশ্রমিক থাকার কারণে সরকার উচ্চশিক্ষায় ভালো মানের শিক্ষকের চাহিদা ও জোগানের এই ভারসাম্যহীনতার সঠিক মাত্রা অনুধাবন করতে পারছে না। এমতাবস্থায়, শিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি শিক্ষার সঠিক উন্নয়ন না করে বরং ভারসাম্যহীনতাকেই তাড়িত করবে। সাধারণ, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার স্ববিরোধিতাকে আরও বেশি তাড়িত করবে এবং বিভাগপ্রতি শিক্ষকের গড় সংখ্যাটা আরও কমে যাবে।

সভাপতি, পরিসংখ্যান বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
rasel_stat71@yahoo.com