আরও দু’ডজন কোম্পানি তালিকাচ্যুতির শঙ্কায়

নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০১৮-০৭-২২ ০৯:২০:০১


গত সপ্তাহে বন্ধ দুই কোম্পানি রহিমা ফুড ও মডার্ন ডাইংয়ের তালিকাচ্যুতির পর এ তালিকা দীর্ঘ হওয়া নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়েছে শেয়ারবাজারে। এ নিয়ে আশঙ্কার মধ্যে রয়েছেন অনেক বিনিয়োগকারী। বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আরও প্রায় দুই ডজন কোম্পানি ডিএসই থেকে তালিকাচ্যুত হওয়ার পর্যায়ে আছে।

এমন শঙ্কা থেকে রুগ্‌ণ ও দুর্বল মৌলভিত্তির বেশকিছু কোম্পানির শেয়ার ছেড়ে দিতে মরিয়া অনেক বিনিয়োগকারী। এ কারণে বৃহস্পতিবার এমন অনেক কোম্পানির শেয়ারের ক্রেতা ছিল না। কেননা তালিকাচ্যুত হওয়ায় রহিমা ফুড ও মডার্ন ডাইংয়ে প্রায় ১৮৩ কোটি টাকার (সর্বশেষ বাজার মূল্যের হিসাবে) বিনিয়োগ আটকে যাওয়ায় এবং আদৌ কয়েক হাজার বিনিয়োগকারী তা ফেরত পাবেন কি-না- এমন শঙ্কার কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

এমন প্রেক্ষাপটে তালিকাচ্যুতির সম্ভাবনা আছে- এমন কোম্পানির শেয়ারের বিক্রেতা বেড়েছে। বিপরীতে আগ্রহী বিনিয়োগকারীর সংখ্যা হাতেগোনা পর্যায়ে নেমেছে। এতে গত বৃহস্পতিবার এ ধরনের অন্তত ২৭ কোম্পানির শেয়ারের বড় দরপতন হয়। ওইদিনের সার্কিট ব্রেকারের সর্বনিম্ন দরে কেনাবেচা হওয়ার পাশাপাশি অন্তত ১৫ শেয়ার ক্রেতাশূন্য হয়েছিল।

তবে শিগগির আরও কোম্পানি তালিকাচ্যুতির বিষয়ে এখনই মুখ খুলতে রাজি নয় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। সংশ্নিষ্টরা জানিয়েছেন, বছরের পর বছর যেসব কোম্পানির বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ আছে বা লভ্যাংশ দিচ্ছে না, সেগুলোকে ‘জঞ্জাল’ হিসেবেই দেখছেন তারা। শেয়ারবাজারকে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে ‘জঞ্জালমুক্ত’ কার্যক্রম শুরুর কথা বলেছেন তারা।

ডিএসইর একটি সূত্র জানায়, রহিমা ফুড ও মডার্ন ডাইংকে তালিকাচ্যুতির আগেই অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে মুন্নু সিরামিক, মুন্নু স্টাফেলার্স ও বিডি অটোকারসহ কয়েকটি কোম্পানির লেনদেন স্থগিতের পরিকল্পনা ছিল ব্যবস্থাপনা বিভাগের। তবে এতে ভালো ফল পাওয়া নাও যেতে পারে- এমন ভাবনা থেকে ডিএসইর পর্ষদ তালিকাচ্যুতির সিদ্ধান্ত নেয়।

কর্মকর্তারা জানান, ডিএসইর এ সিদ্ধান্তকে অনেকে ফোন করে স্বাগত জানিয়েছেন। একই সঙ্গে বছরের পর বছর বন্ধ থাকা বা লভ্যাংশ না দেওয়া কোম্পানির বিষয়েও একই সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি করেছেন।

বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তালিকাভুক্ত অন্তত ১৬ কোম্পানির উৎপাদন ও ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ আছে। আংশিক ব্যবসায়িক কার্যক্রমে আছে আরও কয়েকটি। আর গত পাঁচ বছরে বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দেয়নি এমন কোম্পানি অন্তত সাতটি। আবার উৎপাদন বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালু থাকলেও অন্তত পাঁচ বছর লভ্যাংশ দেয় না এমন কোম্পানি আছে আরও সাতটি। গত চার বছরের মতো এ বছরও লভ্যাংশ না দিলে এমন কোম্পানি সংখ্যা ১১ ছাড়াবে।

তালিকাভুক্তি প্রবিধান (লিস্টিং রেগুলেশনস) অনুযায়ী, কোনো কোম্পানির উৎপাদন বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম অন্তত তিন বছর বন্ধ থাকলে কিংবা টানা পাঁচ বছর শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দিলে, সেগুলোকে তালিকাচ্যুত করতে পারে স্টক এক্সচেঞ্জ। অবশ্য তালিকাভুক্তির পাঁচ বছর অতিক্রান্ত না হলে তালিকাচ্যুত করা যায় না।

যেসব কোম্পানির উৎপাদন বা ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ আছে বলে জানা গেছে, সেগুলো হলো- বিচ্‌ হ্যাচারি, বিডি ওয়েল্ডিং, সিএনএ টেক্সটাইল, দুলামিয়া কটন, এমারেল্ড অয়েল, গোল্ডেন সন, জুট স্পিনার্স, কেএন্ডকিউ, খুলনা প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, লিগ্যাসি ফুটওয়্যার, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক্ক, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, নর্দার্ন জুট ম্যানুফ্যাকচারিং, সমতা লেদার, সুহৃদ ইন্ডাস্ট্রিজ, সোনারগাঁও টেক্সটাইল ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। এ ছাড়া আংশিক ব্যবসায়িক বা উৎপাদন কার্যক্রমে আছে বিডি অটোকার, বিডি সার্ভিসেস, ঢাকা ডাইং, ইমাম বাটন ও মেট্রো স্পিনিংয়ের।

আর গত পাঁচ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ না দেওয়া কোম্পানিগুলো হলো- বেক্সিমকো সিনথেটিক্স, দুলামিয়া কটন, ইমাম বাটন, ইনফরমেশন সার্ভিসেস, জুট স্পিনার্স, কেএন্ডকিউ, মেঘনা কনডেন্সড মিল্ক্ক, মেঘনা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ, প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স, সমতা লেদার, সাভার রিফ্যাক্টরিজ, শ্যামপুর সুগার মিলস, সোনারগাঁও টেক্সটাইল, শাইনপুকুর সিরামিক্স ও ঝিলবাংলা সুগার মিলস।

তালিকাচ্যুতির তালিকায় এগুলোর থাকার শঙ্কার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বলেন, বিনিয়োগের বদলে যারা জুয়া খেলতে চান শঙ্কাটা তাদের, প্রকৃত বিনিয়োগকারীদের নয়। গত বৃহস্পতিবারের লেনদেনই তার প্রমাণ।

তিনি বলেন, ব্যবসায় নেই বা লভ্যাংশ দিচ্ছে না এমন কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে রাখার অর্থ হচ্ছে নতুন বিনিয়োগকারীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলা। এর অবসান হওয়া প্রয়োজন। দেরিতে হলেও ডিএসই এ প্রতারণা থেকে বের হতে কাজ শুরু করেছে।

মিনহাজ মান্নান আরও বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশগুলো এমনকি পাকিস্তানের শেয়ারবাজার যতটা বিদেশি বিনিয়োগ পায়, তার সামান্যও আমরা পাই না। আবার দেশের মধ্যে অন্তত এক কোটি মানুষের বাজারে বিনিয়োগের ক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগকারীর ১৫ লাখের বেশি নয়। এর কারণ আস্থাহীনতা।’ তিনি আরও বলেন, এখানে খারাপ শেয়ারও কেনাবেচা হয়। যে বাজারে মরা গরুর মাংস বিক্রি হয়, সে বাজারে প্রকৃত ক্রেতা যান না। শেয়ারবাজারও তেমনই। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সহায়তা অব্যাহত থাকলে শেয়ারবাজারকে জঞ্জালমুক্ত করতে সময় লাগবে না বলে জানান তিনি।

ডিএসইর পদক্ষেপটি সময়োপযোগী আখ্যায়িত করে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, এতে ‘কুইক মুনাফা’ সন্ধানী বিনিয়োগকারীরা সাময়িক ক্ষতির শিকার হলেও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকেও সতর্ক হবেন। আবার কোনো বন্ধ বা লভ্যাংশ না দেওয়া কোম্পানির মালিকরাও সতর্ক হবেন।

তবে এ বিষয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করতে রাজি নয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি। সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র সাইফুর রহমান বলেন, ডিএসইর তালিকাচ্যুতির সিদ্ধান্তটি খতিয়ে না দেখে কিছু বলা সম্ভব নয়।