কুরআন শরিফের কসম করা যাবে কী?

ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৮-০৮-০৭ ০৯:০৯:২৬


আমরা অনেক সময় নিজেদের কথা বা কাজের সত্যতা প্রমাণ করার জন্য কসম করে থাকি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মর্যাদাবান জিনিস নিয়ে কসম খাই। কারো নামে কসম করার অর্থ তাকে সম্মান দেওয়া ও তার সত্তাকে পবিত্র জ্ঞান করা। এ জাতীয় সম্মানের হকদার একমাত্র আল্লাহ তা‘আলা।

অথচ যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অন্য কোনো সত্তা বা বস্তুর নামে কসম বা শপথ করে সে মূলত আল্লাহর সম্মান ও অধিকারে ওই সত্তাকে শরিক ও অংশীদার করল। এজন্য এটা শিরক হবে। তাছাড়া আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা কবিরা গুনাহ, তবে তা শিরক নয়।

শিরক কবিরা গুনা থেকেও বড়, চাই সেটা ছোট শিরক হোক। কেউ যদি পীর অথবা অন্য কোন বুযুর্গের নামে কসম করল, সে পীর অথবা ওই ব্যক্তিকে আল্লাহর সমকক্ষ স্থির করল; কেউ যদি নবী-অলি-বুজর্গের নামে কসম করে সে তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করল। যা কুফরী, হারাম।

অনুরূপভাবে আল্লাহ ও তার গুণাগুণ ব্যতীত কোনো বস্তুর নামে যে কসম করল, সে আল্লাহর অধিকার তথা বিশেষ সম্মানে ঐ বস্তুকে শরিক করল। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে শপথ করল সে কুফরি করল,অথবা শিরক করল”। ( তিরমিযি: (১৫৩৫, আবু দাউদ: ৩২৫১)

ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন: “আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে সত্য কসম অপেক্ষা আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করব, এটা আমার নিকট অধিক প্রিয়”। (মুসান্নাফ আব্দুর রাজ্জাক: (১৫৯২৯)

ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“তোমরা তোমাদের পিতাদের নামে কসম কর না। যে আল্লাহর নামে কসমকরে তার উচিত সত্য বলা, আর যার জন্যআল্লাহর নামে কসম করা হল তার উচিত সন্তুষ্টি প্রকাশ করা, আর যে আল্লাহর নামে সন্তুষ্টি প্রকাশ করল না, তারসাথে আল্লাহর সম্পর্ক নেই”। (ইবনে মাজাহ: ২১০১)

আর কসমের সাথে যদি অপরের হক জড়িত হয়, তাহলে অপর ব্যক্তি তথা কসমগ্রহণকারী ও বিচারকের নিয়ত গ্রহণযোগ্য হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “তোমার সাথী যার উপরতোমাকে সত্যারোপ করছে তার উপর তোমার কসম সংগঠিত হবে”। অপর বর্ণনায়আছে, “কসম গ্রহণকারীর নিয়তের উপর কসম সংগঠিত হয়”। (মুসলিম: ১৬৫৪)

কুরআনুল কারিমের উপর কিংবা তার ভিতর হাত রেখে কসম করা বিদআতের অন্তর্ভুক্ত ; তবে কসমের কঠোরতা বুঝানো ও মিথ্যা কসমকারীকে ভীতি প্রদর্শন স্বরূপকেউ কোন কোন ওলামায়ে কেরাম তার অনুমতি প্রদান করেছেন।

সৌদি আরবের বড় আলেম শেখ সালেহ উসাইমিন রাহিমাহুল্লাহুকে কুরআনুল কারিমের কসম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে উত্তরে তিনি বলেন: “আল্লাহ তা‘আলার নাম কিংবা তার সিফাত ব্যতীত কোনো বস্তুর কসম করা বৈধ নয়, কেউ যখন আল্লাহর নামে কসম করে, তখন তার সামনে কুরআনুল কারিম উপস্থিত করা জরুরি নয়।

কুরআনুল কারিমের কসম করার রীতি নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে,কিংবা তার সাহাবীদের যুগে, এমনকি কুরআন লিপিবদ্ধ হওয়ার পরও ছিল না। তাই প্রয়োজনের মুহূর্তে কুরআনুল কারিম উপস্থিত করা ছাড়া আল্লাহর নামে কসম করাই শ্রেয়।

এ বিষয়ে প্রসিদ্ধ ইমাম ইবনে কুদামাহ মাকদিসি বলেন, কুরআনুল কারিমের উপর হাত রেখে কসম করার রীতিকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন: “শাফেঈ বলেন: আমি তাদেরকে দেখেছি মুসহাফের উপরহাত রেখে কসম মজবুত করতেন।

ইবনে মাজিনকে দেখেছি কুরআনুল কারিম দ্বারা কসম মজবুত করতেন। শাফেঈ রাহিমাহুল্লাহর সাথীগণ বলেন: কুরআনুল কারিম উপস্থিত করে কসম মজবুত করা জরুরি, কারণ তাতে আল্লাহর কালাম ও তার নামসমূহ রয়েছে।

ইমাম ইবনে কুদামাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন: কসমের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যার নির্দেশ প্রদান করেছেন এবং তার খোলাফায়ে রাশেদাহ ও তাদের বিচারকগণ যা করেছেন তার উপরএটা সীমালঙ্ঘন ও বাড়াবাড়ি, যার পশ্চাতে মজবুত ভিত্তি ও কোনো দলিলনেই। অতএব ইবনে মাজিন কিংবা কারো কর্মের কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তারসাথীদের কর্ম কখনো ত্যাগ করা যায় না”। (আল-মুগনি: (১২/১১৯)

ইমাম কুরতুবি রাহিমাহুল্লাহ বলেন: “ইবনুল আরাবি বলেছেন, কুরআনুল কারিমের উপরহাত রেখে কসম করা বিদআত, কোনো সাহাবী এরূপ করেননি”। (তাফসিরুল কুরতুবি: (৬/৩৫৪)

দ্বিতীয়ত কসম করার জন্য কুরআনুল কারিম কেন, আল্লাহ তা‘আলার নাম কিংবা তার সিফাতের কসম করা হয় না কেন, যা বৈধ এবং যাতে পাপের কোনো আশঙ্কা নেই! তাই কসমের প্রয়োজন হলে আল্লাহর নামে কসম করতে হবে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: “যার কসম করতে হয়, সে যেন আল্লাহর নামে কসম করে, অথবা চুপ থাকে”।( বুখারি: (২৬৭৯)

উল্লেখ্য, তাওরাত, ইঞ্জিল ও জাবুরেরউপর হাত রেখে কসমকরা কোনো মুসলিমের পক্ষে জায়েয নয়,কারণ এসব কিতাব সংশ্লিষ্ট নবীদের উপর আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে নাযিলকরেছেন, সেরূপ অক্ষত ও অবিকৃত অবস্থায় বিদ্যমান নেই। দ্বিতীয়ত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামেরশরিয়ত তার পূর্বের সকল শরিয়ত মানসুখ বা রহিত করে দিয়েছে।

যদি অনৈসলামিক দেশের ঘটনা হয় এবং বিচারক মুসলিমকে তাওরাত বা ইঞ্জিলের উপর কিংবা উভয় কিতাবের হাত রাখতে বাধ্যকরে, তাহলে সে বলবে আমার থেকে কুরআনুল কারিমের কসম গ্রহণ করুন,আমি তার উপর হাত রাখব, যদি বিচারক তারকথা না শুনে তাহলে সে অপারগ, অক্ষম ও মজলুম গণ্য হবে, তখন তার পক্ষে তাওরাতবা ইঞ্জিলের উপর কিংবা উভয়কিতাবের উপর হাত রাখতে সমস্যা নেই, তবে কসমের সময় এসব কিতাবের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার নিয়ত করা যাবে না।

কসম ভাঙ্গার কাফফারা: কুরআনুল কারিম বা আল্লাহর নাম বা তার কোনো সিফাতের নামে কসম করার পর যদি কসম থেকে ফেরত আসতে চায়, অথবা কসম ভঙ্গ করতে চায়, তাহলে কসমের কাফফারা দেওয়া জরুরি। কসমের কাফফারা হচ্ছে দশজন মিসকিনকে খাবার দেওয়া, অথবা তাদেরকে পরিধেয় বস্ত্র দান করা, অথবা একজন মুমিন গোলামকে মুক্ত করা,যদি এর কোনোটার সামর্থ্য না থাকে, তাহলে তিন দিন সিয়াম রাখা।

কাফ্ফার বিষয়ে কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন : “আল্লাহ তোমাদেররকে পাকড়াও করেন না তোমাদের অর্থহীন কসমের ব্যপারে,কিন্তু যে কসম তোমরা দৃঢ়ভাবে করসে কসমের জন্য তোমাদেরকে পাকড়াওকরেন। সুতরাং এর কাফফারা হল দশজনমিসকীনকে খাবার দান করা-মধ্যম ধরণেরখাবার, যা তোমরা স্বীয়পরিবারকে খাইয়ে থাক, অথবা তাদের বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস-দাসী মুক্তকরা। অতঃপর যে সামর্থ্য রাখে না তবে তিন দিন সিয়াম পালনকরা। এটা তোমাদের কসমের কাফফারা- যদি তোমরা কসম কর, আরতোমরা তোমাদের কসম হেফাজত কর।এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য তারআয়াতসমূহ বর্ণনা করেনযাতে তোমরা শোকর আদায় কর”। (মায়েদা : ৮৯)

কাফফার বিষয়ে হাদীসে এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:“আল্লাহর শপথ, আমি কোনো কসমকরে যদি তার বিপরীতে কল্যাণ দেখি – ইনশাআল্লাহ, অবশ্যই আমি আমার কসমের কাফফারা দেই এবং ভালো কাজটি করি;অথবা ভালো কাজটি করি পরে আমার কসমের কাফফারা দেই”। (বুখারি: (৬৬২৩)

নবী সাল্লাল্লাহু‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন:“যে কসম করল অতঃপর তারসে যেন তার কসমের কাফফারা দেয় এবং কাজটি করে”। মুসলিম: (১৬৫১) কসম পুরণ করা না হলে এটাই কসম থেকে বের হওয়ার পদ্ধতি।