পুরুষের আবার সংবেদনশীলতা কিসের!
প্রকাশ: ২০১৫-১১-০২ ১২:৪৮:৪৯
ছেলেটা মাসল ফুলিয়ে বলল, ‘দে, যত জোরে পারস ঘুষি দে’।
নুরু বয়সে ছোট হলেও ভ্যান চালায়, তার গায়ে ওই বয়সেই চমকে যাবার মতন শক্তি। সে গায়ের জোরে ঘুসি দিল। মাসল ফুলিয়ে চ্যালেঞ্জ করা ছেলেটার মুখ বিকৃত হয়ে গেল ব্যাথায়। কিন্তু তা চোখের পলকের জন্য। সে সাথে সাথেই সামলে নিল। গ্রামগঞ্জে সেকালে এ এক অদ্ভুত খেলা। ছেলে ছোকরার দল নগ্ন বাহুতে মাসল ফোলায়। ফোলা মাসলের গোঁড়ায় গোল বলের মত খানিক শক্ত মাংসপিণ্ড ফুলে ওঠে। এই খেলার নিয়ম হচ্ছে চ্যালেঞ্জ জানানো, ওই শক্ত মাংসপিণ্ডের উপর অন্য একজন ঘুসি দিবে। যে ঘুসি খেয়েও তেমন ব্যাথা পাবে না, সে-ই বীর, সাহসী, শক্তিমান। আর ব্যাথা পেলে? লজ্জার আর শেষ নেই।
তো মাসল ফোলানো ছেলেটা ব্যাথা পেলেও মুহূর্তের ভেতরে সামলে নিল। নুরু তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট, ওর ঘুসি খেয়ে ব্যাথা পাওয়া লজ্জার কথা। সে তাই ব্যাথা চেপে হাসিহাসি মুখে বলল, ‘ধুর! কিচ্ছু হয় নাই’।
নুরু তার ব্যর্থতা মানতে নারাজ। সে তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘লন তায়, আরেক্ষান দেই। দেহি, আপনে কেমনে সহ্য করেন’।
চারপাশে মানুষ জড় হয়ে গেছে। এই খেলায় দারুণ মজা। মাসল ফোলানো ছেলেটা টের পাচ্ছে, তার মাসল জুড়ে যে চিনচিনে ব্যথা, তা ধীরে ধীরে সারা হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু এখন আর পেছানোর উপায় নেই। পেছালেই সে হেরে গেল। কিন্তু এতো লোকের সামনে হারা যাবে না। সে আবার মাসল ফুলিয়ে দাঁড়াল। নুরু ঘুসি দিল। আগের চেয়েও জোরে, অনেক জোরে। মাসল ফোলানো ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইল। প্রচণ্ড ব্যথায় তার মাথা ঘুরছে, সারা জগত ঘুরছে। সে এলিয়ে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়েই রইল। হারা যাবে না। হারলে লজ্জা। ভীষণ লজ্জা। ভীষণ।
কিন্তু রাতে ঘুমাতে গিয়ে সে আবিস্কার করল, তার হাতখানা সে নড়াতে পারছে না। ব্যাথায় টুকরো হয়ে আছে। কিন্তু সে কাউকে কিছু বলল না। এ বড় লজ্জার, ওইটুকু এক ছেলের কাছে সে হেরে যাবে! সকালে ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে সে আবিস্কার করল তার সারা গায়ে প্রচণ্ড জ্বর। তারা সারা শরীরজুড়ে তীব্র ব্যাথা। সে নড়তে অবধি পারছে না। ছেলেটা কাউকে কিছু বলল না। চুপিচুপি বাজারে গেল। দুটো ব্যাথার বড়ি কিনে নিয়ে এলো। খেলো। ব্যাথা সেরে গেল। সে ছাত্র ভালো। অনেকগুলো ভাইবোনের পরিবারে আর কেউ তেমন পড়াশোনা করে নি। তাকে নিয়ে তাই সবার আশা। তার নিজেরও ভীষণ স্বপ্ন। সে পড়তে বসল। শরীরটা আজ ফুরফুরে লাগছে। ব্যাথাটি আর নেই। আহা! সে রাতে খুশি খুশি মনে ঘুমাতে গেল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে গিয়ে আবিস্কার করল, তারা সারা শরীরজুড়ে জ্বর, তীব্র ব্যাথা। সে আবার চুপিচুপি বাজারে গেল, ব্যাথার ওষুধ খেল, ব্যাথা সেরে গেল, আবার রাত এলো, এবার রাতেই ব্যাথা শুরু হয়, সে রাতে একটা ওষুধ খায়। দিনে দিনে ওষুধের ডোজ বাড়তে থাকে। আরও বেশি, আরও। ছয় মাস চলে গেল! ছয় মাস! সে কাউকে কিছু বলে নি। সে হেরে যেতে চায় না, উফ কী লজ্জা! ওই টুকু ছেলের কাছে!
ছয় মাস বাদে সে বিছানায় পড়ে গেল। শরীরে ডান দিকটা সে নড়াতে পারে না। পুরো ডানদিক। তার ডান হাতের সেই মাসল থেকে ভয়ংকর ব্যাথা! সে কাকে বলবে? সে তার মাকে বলল। মা বকলেন, আগে কেন বলিস নি হতচ্ছাড়া! ছেলেটাকে নিয়ে যাওয়া হল পাশেই গঞ্জের ডাক্তারের কাছে। সেই ডাক্তার দেখলেন। দেখে কপাল কোঁচকালেন। এক্সরে করলেন। রিপোর্ট দেখে ভীত কণ্ঠে বললেন, ‘শহরে বড় মেডিকেলে নিয়া যান’।
শহরের বড় মেডিকেল থেকে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হল ঢাকায়। ডাক্তাররা বললেন, ‘এর হাত কেটে ফেলতে হবে। আর কোন উপায় নেই। যখন ঘুসি খেয়েছিল মাসলে, তখন তার মাসলের ভেতর হাড়ে টিউমার বেড়ে উঠছিল। সেই টিউমার ওই ঘুসিতে ভেঙে গলে গিয়েছিল। তারপর হাড্ডিতে পচন ধরেছিল। এখন হাত না কেটে ফেললে সারা শরীরে ছড়িয়ে পরবে…’
আর কোন উপায়? তার মা, বাবা, ভাইয়েরা আর্তনাদ করে উঠল। ডাক্তার বললেন, ‘ইন্ডিয়ার মাদ্রাজে নিয়ে যেতে পারেন’।
কিন্তু এতো টাকা? তার বাবা জমি বেচলেন, ভাইয়েরা পাগলের মত টাকা জোগাড়ে ছুটল। মাদ্রাজে দীর্ঘ চিকিৎসা হল। সেই চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে একটা পরিবারের কোমর ভেঙে গেল। ছেলেটা ফিরল দীর্ঘ বছর পর। তার ঝাঁকড়া চুলের মাথাখানা জুড়ে তখন চকচকে বিশাল টাক। চিকিৎসা আর হাইডোজের ওষুধে চুল পড়ে গেছে সব। তার হাতখানা কেমন খানিক বাঁকা হয়ে গেছে। সেই হাতে তেমন শক্তি নেই, তবে কাজ চলে যায়। ছেলেটা চুপ হয়ে গেল। একদম চুপ। যেন ঝড়ে ডানা ভাঙ্গা পাখি। সে কারো সাথে কথা বলে না, মেশে না। পড়াশোনা করবার মত অবস্থাও আর নেই। হাই ডোজের অসুধের কারণেই কি না কে জানে, তার মাথার ভেতর পড়াশোনা আর ঢোকে না। সে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। সে কি তবে হেরে গেল? জীবনের কাছে? নিয়তির কাছে? কিন্তু সেতো হারতে চায় নি। হারায় বড় লজ্জা, বড় লজ্জা!
তারপর? কতবছর কে জানে! ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। সে প্রবল প্রতিজ্ঞায় চোয়াল শক্ত করে আবার ফিরতে চাইল। সে হেরে যেতে চায় না। হেরে যাওয়ায় বড় লজ্জা। বাজারের ছোট্ট মুদি দোকানখানা নিয়ে দিন রাত পড়ে রইল। দিনের পর দিন। সেই দোকানে ফ্রিজ এলো, তাকভর্তি থরে থরে নতুন পণ্য এলো। ওই অজপাড়াগাঁয়ে সিলিন্ডারভর্তি গ্যাস এলো, বিকাশ এলো, ছোট্ট দোকান বড় হল, বড়, আরও বড়। ছেলেটা হেরে যেতে চায় নি। হারায় বড় লজ্জা! বড় লজ্জা!
কিন্তু ছেলেটা হেরে গেল।
বহু বছরবাদে সে যখন আবার খানিক জীবন ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছে। তার সামনের রাস্তায় রোজ হেঁটে যাওয়া মেয়েটাকে দেখে যখন বুকের ভেতর খানিক কেঁপে উঠেছে, তার হঠাৎ মনে হল, জীবন তাকে হারায় নি। হয়তো হারায় নি। সে পরিশ্রমী, সৎ, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই মেয়েটি কি তার হতে পারে না? এই এতো এত যুদ্ধ আর শংকা, কষ্ট ও ক্লান্তির গল্প যাকে সে বলবে। যার বুকে মাথা রেখে তার মনে হবে কিছুই হারায় নি, কিছুই না। জীবন তার যা নিয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি দিয়েছে। কিন্তু পারিবারিক বিয়ের প্রস্তাবটা ‘না’ হয়ে গেল। কারণ? ছেলেটি টাক। সব ঠিক আছে, কিন্তু মাথায় চুল নেই, ও ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে? কস্মিনকালেও না…’
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। হয়তো আয়নার সামনে, হয়তো নিজের সামনে, হয়তো জীবনের সামনে। তবে সে হেরে যেতে চায় নি। আবারও দিন গেল, রাত্রি গেল, মাস গেল, বছরও। কী অদ্ভুত! সে হেরেই চলেছে, একটা টাক মাথা পুরুষকে যেন কোন মেয়ের ভালবাসতে নেই, কাছে টানতে নেই, হাসিমুখে বলতে নেই, ভালোবাসি!
[[মেয়েদের এমন অজস্র গল্প, এমন অসংখ্য কষ্ট, এমন অগন্তি হেরে যাওয়ার কথা আমরা শুনি। প্রবল সহমর্মিতায় আর্দ্র হই। সেইসকল গল্পগুলো সকলেই জানি। কিন্তু সেই মাসল ফোলানো ছেলেটার মতন এমন গল্প ক’জন শুনি? ক’জন জানি! জানি না। শুধু জানিই না, বরং হাসি হাসি মুখে টিপ্পনী কেটে বলি, ‘কি রে! তোর ছাদেতো মাল নাই, দুইদিন পরতো পুরাই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। তাড়াতাড়ি বিয়া কর, পরে কিন্তু মাইয়া পাবা না মামা… বইল্যা রাখলাম…’
রেডিও, টেলিভিশন, নাটক, সিনেমায় টাকমাথা পুরুষ নিয়ে সে কি নির্লজ্জ তামাশা! হাসিহাসি মুখে সে কি ভয়াবহ আঘাত! তীব্র শ্লেষ! কদর্য কৌতুক! কিন্তু সেই একজন পুরুষ হয়তো তখন ভাবেন, নারী হয়ে জন্মালে বোধ হয় এমন কিছুতেও মানবিক সংবেদনশীলতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠত চারধার! খানিকটা সহানুভূতির কণ্ঠস্বর হয়তো শোনা যেত। হয়তো সকলে এসে বলত, এভাবে বর্ণবাদী হওয়া যাবে না! খবরদার!
কিন্তু টাকমাথা পুরুষের প্রতি আবার সংবেদনশীলতা কিসের? তারাতো নারী নয়। জগতের সকল সংবেদনশীলতা থাকুক নারীর জন্য। পুরুষের আবার সংবেদনশীলতা কিসের!!]]
ছেলেটা আজকাল পরচুলা পরে। পরচুলা পড়লেই সে আলাদা এক অন্য মানুষ! রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সেই চুল সে খুলে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। এই আলাদা দুটি মানুষকে দেখে, তখন সে কি ভাবে? হয়তো ভাবে, এ জগতে মুখ বড়, না মুখোশ? একটা জীবনের আর সকল প্রাপ্তি, যুদ্ধ, নিষ্ঠার চেয়ে যেখানে ‘বেশ’ বড় হয়ে ওঠে, সেখানে মুখের কী দরকার! মুখোশে ভরে উঠুক একটা মুখোশ জগত!
এই মুখোশের জগতে হেরে যাওয়ায় লজ্জা কি! ছেলেটা এখন হেরে যেতে জানে!
পুরুষ-বাদ/ সাদাত হোসাইন
২৯/১০/২০১৫ (ফেসবুক থেকে)