নূরের পরশে আঁধারের অবসান
:: আপডেট: ২০১৮-০৯-০৭ ০৯:১৪:১৮
নবেতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট যুগ ছিল আরবের আইয়ামে জাহেলিয়া। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ শতকে তৎকালীন আরব সমাজ সভ্যতা ও মানবিকতার সব মানদণ্ডে ছিল এক বর্বর আর পাশবিকতার মিশেলে অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজব্যবস্থার নির্মম প্রতিচ্ছবি।
মানুষের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা ও সংবেদনশীলতা ছিল সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। হেন অপরাধ নেই, যা তখন সমাজে সংঘটিত হতো না। মুখ থুবড়ে পড়ছিল সবধরনের ইতিবাচক মানসিকতা; যেন সর্বত্রই এক ঘোর অন্ধকারের অমানিশা নেমে এসেছিল।
মানবসভ্যতার ইতিহাস সেই সময়টাকে আইয়ামে জাহেলিয়া তথা অন্ধকারের যুগ হিসেবে চিত্রিত করেছে। ঐতিহাসিক পি কে হিট্টি ও নিকলসনসহ অধিকাংশ ইতিহাসবিদের মতে, এই অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়টি ছিল ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত ব্যাপৃত। সময়টি ছিল এক ভয়াবহ আঁধারের কৃষ্ণগহ্বর।
তার মানে কি এই যে, তৎকালীন দুনিয়ায় প্রতি প্রত্যুষে পূর্বদিগন্ত ভেদ করে সোনালি সূর্যের উদয় ঘটত না? সূর্যালোক সেই সমাজকে আলোকিত করত না? তাহলে কেন সেটি অন্ধকারের যুগ হিসেবে সংজ্ঞায়িত হলো? এ থেকে বোঝা যায়, সূর্যের আলো প্রকৃত আলো নয়, এটি কেবল চোখের আঁধার দূর করতে পারে। কিন্তু মানুষ ও মানবতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে থাকা অদৃশ্য-অস্পৃশ্য আঁধারের অবসানে সূর্যালোক কোনো উপকরণ হতে পারে না।
আর তাই সেই ভয়াল আঁধারকে দূরীভূত করার মহান লক্ষ্যে প্রকৃত অর্থেই একটি অনন্য সাধারণ ‘নূর’ তথা আলোকের আবির্ভাব অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। মানবতার বাস্তব তাগিদেই সেই নূরের বিচ্ছুরণ-বিকিরণ ঘটেছিল।
মহান আল্লাহ তাই ঘোষণা করেন- ‘কাদ জাআকুম মিনাল্লাহে নূর’ অর্থাৎ বিশ্বমানবতার জন্য আমি আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে এক নূর। সেই নূর মানে হলো আলো আর আলো বলতে এটি সূর্যের আলো নয়, চন্দ্রেরও আলো নয়; বরং এই নূর হলেন ‘নূরে মুহাম্মদি’ তথা বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)।
প্রিয় নবীর (সা.) কণ্ঠেও সেটি প্রতিধ্বনিত হয়েছে- ‘আওয়ালু মা খালাকাল্লাহু নূরি’ অর্থাৎ মহান আল্লাহ সর্বপ্রথম আমার নূর তৈরি করেছেন। পারস্যের কবি আত্তারের প্রতিভায় সেটি এভাবে চিত্রিত হয়েছে- ‘সাইয়েদুল কাউনাইন ওয়া খাতামুল মুরসালিন, আখের অমাদ বুদ ফাখরুল আওয়ালিন’ অর্থাৎ তিনি হলেন উভয় জাহানের (ইহজগৎ ও পরজগৎ) নেতা এবং সর্বশেষ রাসুল (সা.), তাঁর আগমন ঘটেছে সবশেষে; কিন্তু তিনিই ছিলেন সৃষ্টির প্রথম গৌরব।
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় হাবিবকে ‘সিরাজে মুনির’ তথা প্রদীপ্ত এক দীপশিখা হিসেবে অভিহিত করেছেন। আমাদের সাধারণ জ্ঞান বলে মনে হতে পারে যে, এত বড় মাপের একজন নবী যিনি মানবমণ্ডলীর মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদায় অভিষিক্ত, তাঁকে সূর্যালোকের তেজোদীপ্ততার সঙ্গে তুলনা না করে একটা দীপশিখা, যা টিম টিম করে জ্বলে- তার সঙ্গে কেন তুলনা করলেন। সূর্য যতই তেজোদীপ্ত হোক সে শতাব্দীকাল বা অনন্তকালের প্রচেষ্টায়ও কোনোদিন নতুন ছোট্ট আরেকটা সূর্যের জন্ম দিতে পারবে না; কিন্তু প্রদীপের কী ক্ষমতা দেখুন যে, একটামাত্র প্রদীপ থেকে শত-সহস্র বা অসংখ্য-অগণিত নতুন প্রদীপ আলো নিয়ে নিজেদের উদ্ভাসিত করতে পারবে এবং এতে করে মূল প্রদীপের কোনো সমস্যাই হবে না।
সে জন্য মহানবী (সা.) হলেন গোটা পৃথিবীর মানুষের জন্য এমন একটি নূর, যেটি হলো জ্ঞানের আলোকবর্তিকা; জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে অনন্তকাল ধরে সব মানুষ তাঁর কাছ থেকে আলোপ্রাপ্ত হয়ে নিজেদের অন্ধকার হৃদয়কে আলোকিত করতে পারবে। আর সে জন্যই আরবের অন্ধকার দূর করার মানসে সর্বোত্তম এই নূরের প্রয়োজন ছিল।
মহাজাগতিক প্রত্যাশার পারদ ভেঙে আরবের অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে তাই প্রতিশ্রুত সেই নূরের আবির্ভাব ঘটল। মানবতার ইতিহাস সেই নূরের পরশে পরিবর্তিত হয়ে ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করতে লাগল। কিন্তু মহাসত্যের শত্রুরা তা অতি সহজেই মেনে নেবে, তা আশা করাই বাস্তবতাবর্জিত। মহান আল্লাহর বাণীতে তা এভাবে ফুটে ওঠে- য়ুরিদুনা লিয়ুতফিউ নূরাল্লাহি বিআফওয়াহিহিম ওয়াল্লাহু মুতিম্মুনুরিহিম ওয়ালাও কারিহাল কাফিরুন’ অর্থাৎ তারা চায় ফুৎকার দিয়ে আমার নূরকে নির্বাপিত করে দেবে; কিন্তু মহান আল্লাহ তা আরও ব্যাপকভাবে আলোকোজ্জ্বল করে রাখবেন, যদিও অবিশ্বাসীরা তা অপছন্দ করে।
আল্লাহপাক তাঁর প্রিয় রাসুলকে (সা.) জ্ঞানের আলোক-মশাল দিয়ে প্রেরণ করেছেন। কেননা, তদানীন্তন যুগ ও সমাজ ছিল জেহালত তথা অজ্ঞানতা আর মূর্খতায় পরিপূর্ণ। সে জন্যই আল্লাহ প্রদত্ত নূরের প্রতি অবতীর্ণ হওয়া ঐশী বাণীর প্রথম নির্দেশনাটিই ছিল- ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাযি খালাক’ অর্থাৎ পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমায় সৃষ্টি করেছেন। পড়া, অধ্যয়ন করা, জ্ঞানের চর্চায় নিজেকে নিবেদিত রাখা এবং সেই জ্ঞানের আলোকে চলমান অন্ধকারাচ্ছন্নতাকে মূলোৎপাটন করাই হলো সেই নূরের অন্যতম মাহাত্ম্য। মূর্খতার আঁধার দূর করতে হলে জ্ঞানের আলোকই হলো তার প্রকৃত উপকরণ। আর সে জন্যই বলা হয়েছে- জ্ঞানই হচ্ছে নূর বা আলো এবং তার বিপরীতে অজ্ঞতা বা মূর্খতাই হচ্ছে অন্ধকার।
মূলত মূর্খতা-অজ্ঞতার কারণেই সেই সমাজ ছিল আঁধারে ঘেরা; স্রষ্টার পাঠানো মুহাম্মদি নূরের জ্ঞানসমৃদ্ধ আলোকচ্ছটায় সেই আঁধার শুধু তিরোহিতই হয়নি, বরং ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট যুগটি মানবেতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ যুগের মর্যাদা ও স্বীকৃতিও অর্জন করেছে।
মহানবী (সা.) ছিলেন শিক্ষা ও জ্ঞানের প্রকৃষ্ট বাতিঘর। তিনি হলেন মানবতার শিক্ষক। তিনি নূর হয়ে এলেন, জ্ঞানের মশাল প্রজ্বলিত করে সর্বব্যাপী বিস্তৃত আঁধারকে তাঁর আলোকমালায় উদ্ভাসিত করলেন। অথচ সে জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক বা প্রথাগত শিক্ষার্জন তাঁর ছিল না। এ জন্য ছিল না যে, পৃথিবীর মানুষের জ্ঞান খুবই সীমিত, সামান্য।
মহান আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি তোমাদের খুব সামান্যতম জ্ঞান দিয়েছি। সামান্যতম জ্ঞানের অধিকারী মানুষ সেই বিশ্বমানবকে কী শেখাবে বা কী পড়াবে, যিনি হবেন সমগ্র বিশ্বমানবতার শিক্ষক! তাই অসম্পূর্ণ বা অপরিণত জ্ঞানের অধিকারী মানুষের কাছ থেকে মহানবী (সা.) কিছু জানেননি, শেখেননি বা পড়েননি; মহান আল্লাহ নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজনীয় সব বিষয়ে তাঁর এই মহান দূতকে শিক্ষা ও জ্ঞান দিয়েছেন। আর প্রকৃত প্রস্তাবে কেবল আল্লাহর জ্ঞানই হচ্ছে পরিণত, পরিপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ।
মানবতার পরম সুহৃদ মুহাম্মদ (সা.) জ্ঞানে-গুণে, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে, দৈহিক অবয়বে, গঠনাকৃতিতে, ভাব-ব্যঞ্জনায়, অলৌকিকত্বে, ব্যক্তিত্বের সম্মোহনী জাদুময়তায়, আদর্শিক চেতনায়, ইমানে-ইনসাফে, আচার-ব্যবহারের মাধুর্যতায়, সল্ফ্ভ্রান্ত বংশপরম্পরায়, কর্মদক্ষতা-বিচক্ষণতায়, মহান কীর্তিতে-সাফল্যে- সর্বোপরি মানবতার সব দিক ও বিভাগের পরিপূর্ণতায় সর্বকালের সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানবের বাস্তব ও অনবদ্য দৃষ্টান্ত হিসেবে বিশ্ব ইতিহাসে অনন্য উচ্চতায় সমাসীন রয়েছেন। তাঁরই অসামান্য নূরের পরশে দূর হয়েছে সব আঁধার। তাই তো তিনি চির অম্মান তাঁরই নূরের রৌশনিতে।
লেখক ও গবেষক; অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়