যেসব হেভিওয়েটরা ছিটকে গেলেন
নিজস্ব প্রতিবেদক আপডেট: ২০১৮-১২-০৩ ১০:৪৭:০৪
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরাই বেশি বাদ পড়েছেন। বাদ পড়ার তালিকায় আছেন দলটির চেয়ারপার্সন কারাবন্দি খালেদা জিয়াসহ বেশ কয়েকজন প্রবীণ নেতা।
দুর্নীতির দায়ে দুই বছরের বেশি দণ্ড পাওয়া, ঋণখেলাপি বা বিলখেলাপি হওয়া, হলফনামায় সই না করাসহ নানা ত্রুটির কারণে বাছাইয়ে বাদ পড়েছেন প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেয়েও দলের প্রার্থী হিসেবে যেসব নেতা মনোনয়নপত্র দাখিল করেছিলেন তাঁরাও বাদ পড়েছেন।
এ ছাড়া বিএনপির প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে ইচ্ছুক জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কয়েকজন নেতাও আছেন বাদ পড়ার তালিকায়। বিএনপির যেসব নেতা উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার মেয়র পদ ছেড়ে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন, তাঁদের কয়েকজনের মনোনয়নপত্রও বাতিল করা হয়েছে।
গতকাল রবিবার ছিল মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের শেষ দিন। গত রাতে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে জানানো হয়, সব মিলিয়ে ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিলকারী তিন হাজার ৬৫ জন প্রার্থীর মধ্যে বাদ পড়েছেন ৭৮৬ জন।
মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ার পর দেশের কোনো আসনেই একক প্রার্থী পাওয়া যায়নি। এবার সবচেয়ে কম প্রার্থী হয়েছেন মাদারীপুর-১ আসনে। ওই আসনে প্রার্থী দুজন। আর সবচেয়ে বেশি হয়েছেন কুমিল্লা-৩ আসনে। এই আসনে প্রার্থীসংখ্যা ১৭।
ইসি সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নিজ নিজ রিটার্নিং অফিসারের কাছ থেকে বাতিল আদেশের সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করে সোম, মঙ্গল ও বুধবার ইসিতে আপিল করতে পারবেন সংক্ষুব্ধ প্রার্থীরা।
এ ক্ষেত্রে রিটার্নিং অফিসারদের বৈধ ও অবৈধ উভয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেই আপিল করা যাবে। তবে বৈধ মনোনয়নপত্রের বিরুদ্ধে আপিল ইসি এখতিয়ারে নিতে পারবে কি না তা আইনে স্পষ্ট নয়।
খালেদা জিয়া ছাড়া বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের বাদপড়া প্রার্থীদের মধ্যে আছেন রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু, নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তার, আমানউল্লাহ আমান, বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী, গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী ও তাঁর পুত্র সামির কাদের চৌধুরী, আসলাম চৌধুরী, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, সাবেক মন্ত্রী এনামুল হক, সাবেক মন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও তাঁর ছেলে ব্যারিস্টার মীর হেলাল উদ্দীন, সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের, সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা, ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে ইশরাক হোসেন, মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, সাবেক সংসদ সদস্য মোস্তাফা কামাল পাশা, গোলাম মাওলা রনি, সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়া, সাবেক সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভুইয়া, সাবেক এমপি আলহাজ মো. মতিউর রহমান তালুকদার, সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের ভাই কে এম মুজিবুল হক প্রমুখ।
অন্য দলের বাদপড়া প্রার্থীদের মধ্যে আছেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা, সংসদ সদস্য এ এ আওয়াল, কুড়িগ্রাম-৪ আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাকির হোসেন, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী, গণজাগরণ মঞ্চের ইমরান এইচ সরকার।
দলের মনোনয়ন ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে যাঁরা মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন তাঁদের মনোনয়নপত্রও বাতিল করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন মেহেরপুর-১ আসনের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ও কুষ্টিয়ার সাবেক এমপি আফাজ উদ্দিন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া জামায়াতের বেশ কয়েকজন প্রার্থীরও মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে। এঁদের মধ্যে যশোর-১ আসনে জামায়াতের শুরা সদস্য মাওলানা আজিজুর রহমানও রয়েছেন। বগুড়ার আলোচিত প্রার্থী হিরো আলমও আছেন বাতিলের তালিকায়।
ইসি সূত্রে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে মনোনয়নপত্র দাখিলকারী তিন হাজার ৬৫ জনের মধ্যে রাজনৈতিক দলের দুই হাজার ৫৬৭ জন এবং স্বতন্ত্র ৪৯৪ জন। ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৬৪ আসনে ২৮১ জন, বিএনপি ২৯৫ আসনে ৬৯৬ জন, জাতীয় পার্টি ২১০ আসনে ২৩৩ জন এবং অন্যান্য দলের এক হাজার ৩৫৭ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। বাছাই শেষে এখন প্রার্থী দাঁড়াল দুই হাজার ২৯৭ জনে।
সূত্র মতে, জমাপড়া মনোনয়নপত্রের মধ্যে রংপুর বিভাগে ৩৫৩টির মধ্যে ৯১টি, রাজশাহী বিভাগে ৩৫৫টির মধ্যে ৯৬টি, খুলনা বিভাগে ৩৯১টির মধ্যে ৯০টি, বরিশাল বিভাগে ১৮৩টির মধ্যে ৯০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ২৩১টির মধ্যে ৬২টি, ঢাকা বিভাগে ৭৩১টির মধ্যে ১৯২টি, সিলেট বিভাগে ১৮৩টির মধ্যে ৪৪টি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৭৭টির মধ্যে ১৭৩টি বাতিল হয়। ৩৫টি নির্বাচনী এলাকায় কোনো মনোনয়নপত্র বাতিল হয়নি।
আসনগুলো হলো ঠাকুরগাঁও-২, দিনাজপুর-৫, জয়পুরহাট-২, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩, নওগাঁ-৩, নাটোর-৩, পাবনা-২ ও পাবনা-৪, কুষ্টিয়া-৩, বাগেরহাট-৩, খুলনা-১, খুলনা-৩, খুলনা-৪ ও খুলনা-৫; সাতক্ষীরা-৩, পটুয়াখালী-৪, ভোলা-৩, বরিশাল-৪ ও বরিশাল-৫, পিরোজপুর-২, টাঙ্গাইল-৫, জামালপুর-২, নেত্রকোনা-৩, ঢাকা-১২ ও ঢাকা-১৩, নরসিংদী-৪, গোপালগঞ্জ-২, মৌলভীবাজার-৪, কুমিল্লা-৭, চাঁদপুর-৩, ফেনী-২, নোয়াখালী-৫, লক্ষ্মীপুর-৩ ও কক্সবাজার-১।
ফেনী-১, বগুড়া-৬ ও বগুড়া-৭—এই তিন আসন থেকেই বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং অফিসাররা। আদালতে দণ্ডিত হওয়ায় তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। ফলে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আর প্রার্থিতা রইল না খালেদা জিয়ার। এসব আসনে খালেদা জিয়ার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কায় বিকল্প প্রার্থী দিয়ে রেখেছিল বিএনপি।
এর মধ্যে ফেনী-১ আসনে খালেদা জিয়ার বিকল্প হিসেবে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবদলের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম এবং বগুড়া-৬ আসনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন।
তবে বগুড়া-৭ আসনে খালেদা জিয়াসহ বিএনপির দুই প্রার্থীরই মনোনয়নপত্র বাতিল হওয়ায় এই আসনটিতে দলটির আর কোনো প্রার্থী নেই। এ আসনে বিএনপির বিকল্প প্রার্থী ছিলেন গাবতলী উপজেলার চেয়ারম্যান মোরশেদ মিল্টন। উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগের প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত হয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে নাজিমুদ্দীন রোডে পুরনো কারাগারে আছেন খালেদা জিয়া। নিম্ন আদালত এ মামলায় তাঁকে পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিলেও উচ্চ আদালত তাঁর সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেছেন। এ ছাড়া জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায়ও খালেদার সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।
গতকাল সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলনে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার ও রিটার্নিং অফিসার জানান, ঢাকা-৫ থেকে ঢাকা-১৮ পর্যন্ত ১৫টি আসনে ২১৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৬১ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ এবং ৫২ জনের বাতিল করা হয়েছে।
ঢাকা-৫ আসনে বাতিল হয়েছে বিএনপির অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়ার মনোনয়নপত্র। ঢাকা-৬ আসনে বিএনপির ইশরাক হোসেনের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে ঋণখেলাপি হওয়ায়। ইশরাক ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার ছেলে। ঢাকা-১৭ আসনে সাবেক মন্ত্রী ও বিএনএর চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মনোনয়নও বাতিল করা হয়েছে।
ঋণখেলাপি হওয়ায় ঢাকা-৭ আসনের বিএনপি প্রার্থী নাসিমা আক্তার কল্পনা, ঢাকা-৯ আসনের বিএনপি প্রার্থী আফরোজা আব্বাসের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। ঢাকা-১৬ আসনে বাতিল করা হয়েছে বিএনপির মোয়াজ্জেম হোসেন ও গণফোরামের ফরিদুল আকবরের এবং ঢাকা-১৭ আসনের বিএনপির শওকত আজীজ, বিকল্পধারার আরিফুল হক, গণফোরামের খন্দকার ফরিদুল আকবর, আওয়ামী লীগের রুবেল আজীজের মনোনয়নপত্র।
ঢাকা-১ আসনে উপজেলা চেয়ারম্যান পদ ছাড়ার পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় বিএনপির খোন্দকার আবু আশফাকের এবং সাবেক সংসদ সদস্য ফাহিমা হোসাইন জুবলীর মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার। ফলে এই আসনে বিএনপির কোনো প্রার্থী থাকল না।
এ ছাড়া ঢাকা-৭ আসনে ১৯ জন প্রার্থীর মধ্যে ১৫ জনকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে চারজনের মনোনয়ন। ঋণখেলাপি হওয়ায় বিএনপির প্রার্থী নাসির উদ্দিন পিন্টুর স্ত্রী নাসিমা আক্তারের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
চট্টগ্রামে বাদ মীর নাছির, মোরশেদ খান, গিয়াস কাদেরসহ ৮ প্রভাবশালী : আমাদের চট্টগ্রাম অফিস জানায়, চট্টগ্রামে গতকাল বিএনপির আট হেভিওয়েট প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। এঁরা হলেন চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে মোস্তফা কামাল পাশা, চট্টগ্রাম-৪ আসনে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ আসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী) আসনে সাবেক প্রতিমন্ত্রী মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও তাঁর ছেলে মীর হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) সামীর কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) ও চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া) আসনে সামীর কাদেরের বাবা গিয়াস কাদের চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৮ (চান্দগাঁও-বোয়ালখালী) আসনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম মোরশেদ খান এবং চট্টগ্রাম-৯ আসনে নগর বিএনপির সহসভাপতি শিল্পপতি সমসুল ইসলাম। সামীর কাদের চৌধুরী হলেন মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাতিজা।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বাছাইয়ে বাদ পড়েন আসলাম চৌধুরী ঋণখেলাপি হওয়ায়। ২৭ ব্যাংকে প্রায় ৪৮৯ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহ, নাশকতাসহ ৬৮ মামলায় বর্তমানে জেলে থাকা এই বিএনপি নেতার।
দুপুর সোয়া ১টায় মীর মো. নাছির উদ্দিন ও তাঁর ছেলে মীর মো. হেলাল উদ্দিনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সময় তাঁদের মামলার ব্যাপারে রিটার্নিং অফিসারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ওই আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের আইনজীবী আবুল হাশেম।
ফলে ওই আসনে জঙ্গি অর্থায়নের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে টিকে গেছেন। মীর নাছির মনোনয়নপত্রে তাঁর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা স্থগিত ও একটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছিলেন।
মনোনয়নপত্র বাতিলের পর এক প্রতিক্রিয়ায় মীর নাছির বলেন, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের ইশারায় এটা করা হয়েছে। মামলার ব্যাপারে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেননি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর আইনজীবী। মনোনয়নপত্র বাতিলের বিরুদ্ধে তিনি নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন।
এম মোরশেদ খানের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ না দেওয়া এবং বিদ্যুৎ বিল ও খেলাপি হওয়ার কারণে। হলফনামায় জাপানের টোকিও থেকে স্নাতকোত্তর উল্লেখ করলেও তাঁর সঙ্গে কোনো সনদ জমা দেননি।
রিটার্নিং অফিসার ও বিভাগীয় কমিশনারের কাছে শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ না দেওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সব সনদ পাকিস্তানি সেনারা পুড়িয়ে ফেলেছে বলে জানান। তবে রিটার্নিং অফিসার এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি। এ ছাড়া ৩১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকার অভিযোগও তোলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
মোরশেদ খানের আইনজীবী জানান, এই বিল ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক টেলিকম বাংলাদেশের নামে এবং এসংক্রান্ত হাইকোর্টের একটি স্থগিতাদেশ জমা দেন। তবে বিষয়টি আমলে না নিয়ে মনোনয়নপত্র বাতিল করে নির্বাচন কমিশনের আপিলের পরামর্শ দেন রিটার্নিং অফিসার।
ফাঁসি কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ভাই বিএনপি নেতা গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে। একই সঙ্গে গিয়াসপুত্র সামির কাদের চৌধুরীর মনোনয়নপত্রও বাতিল ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ইলিয়াস হোসেন।
সন্দ্বীপের সাবেক সংসদ সদস্য বিএনপি নেতা মোস্তফা কামাল পাশার মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে বিদ্যুৎ বিল খেলাপির কারণে। তবে চট্টগ্রাম-৯ কোতোয়ালি আসনে বিএনপি নেতা এবং ইলিয়াস ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমসুল আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ঋণখেলাপির কারণে। হলফনামায় কোনো ঋণ নেই উল্লেখ করলেও মনোনয়ন বাছাইয়ের সময় একাধিক ব্যাংকের প্রতিনিধি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাংক ঋণের কাগজপত্র হস্তান্তর করেন রিটার্নিং অফিসারের কাছে।
রাজশাহীতে সেখানে ছয়টি আসনে তথ্য গোপন, মামলা জটিলতা, হলফনামায় স্বাক্ষর জালসহ নানা কারণে বিএনপি, আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ২৩ জনের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। এদের মধ্যে বিএনপির তিনজন হেভিওয়েট প্রার্থী রয়েছেন। তাঁরা হলেন সাবেক মন্ত্রী এনামুল হক, সাবেক এমপি নাদিম মোস্তফা ও চারঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান আবু সাইদ চাঁদ। রাজশাহীর ছয়টি আসনের জন্য মনোনয়ন দাখিল করেছিলেন ৫৩ জন প্রার্থী।
গতকাল রাজশাহী জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই শেষে ২৩ জনের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। ফলে এখন পর্যন্ত রাজশাহীতে প্রার্থী রইলেন ৩০ জন।
রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে হলফনামায় তথ্যে গরমিল থাকায় বিএনপি মনোনীত ব্যারিস্টার আমিনুল হক ও বিএনপির আরেক প্রার্থী শাহাদাত হোসেন, স্বতন্ত্র প্রার্থী সালাহ উদ্দিন বিশ্বাস, সুজা উদ্দিন, সাইদুর রহমান, শহিদুল করিম শিবলী ও জামায়াত নেতা মজিবুর রহমান ও বাসদের আফজাল হোসেনের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে আটজনের মধ্যে দুজনের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। তাঁরা হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মাসুদ রানা ও এনপিপির সাইফুল ইসলাম স্বপন। রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে ঋণখেলাপের কারণে বাদ পড়েছেন জাতীয় পার্টির প্রার্থী শাহবুদ্দিন বাচ্চু এবং বিএনপির মতিউর রহমান মন্টু। হলফনামায় তথ্যে গরমিল এবং মামলা জটিলতায় বাদ পড়েছেন স্বতন্ত্র (জামায়াত প্রার্থী) মাজিদুর রহমান, আতিকুর রহমান ও সাবেক এমপি মিরাজ মোল্লা।
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনে হলফনামায় গরমিল থাকায় প্রার্থিতা বাতিল করা হয় বিএনপির আব্দুল গফুর ও যুক্তফ্রন্টের সরদার সিরাজুল করিমের। রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে ঋণখেলাপ ও হলফনামায় মামলার তথ্য না দেওয়ায় বাদ পড়েন সাবেক এমপি বিএনপি নেতা অ্যাডভোকেট নাদিম মোস্তফা।
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুলের স্বাক্ষর জাল করে মনোনয়ন দাখিল করায় বিএনপি নেতা আবু বাক্কার সিদ্দিক ও হলফনামায় তথ্যে গরমিল থাকায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের রুহুল আমিন এবং আওয়ামী লীগের প্রার্থী ওবায়দুর রহমানের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়।
রাজশাহী-৬ (চারঘাট-বাঘা) আসনে উপজেলা চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগপত্র গৃহীত না হওয়ায় এবং হলফনামায় তথ্যে গরমিল থাকায় বিএনপি মনোনীত আবু সাঈদ চাঁদ এবং হলফনামায় তথ্যে গরমিল থাকায় বাংলাদেশ মুসলিম লীগের আব্দুর রাজ্জাকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।
ঋণখেলাপি হওয়ায় পটুয়াখালী-১ আসনে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। রিটার্নিং অফিসার মো. মতিউল ইসলাম চৌধুরী জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকাভুক্ত ঋণখেলাপি হওয়ায় তাঁর মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর-১ আসনের বর্তমান এমপি এবং জাকের পার্টির প্রার্থী এম এ আওয়ালের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে ঋণখেলাপি হওয়ায়। এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর-২ আসনে বিকল্পধারার শাহ আহম্মদ বাদলের ১৯ হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল বাকি থাকার কারণে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
ঋণখেলাপি হওয়ায় কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে। তিনি টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) ও টাঙ্গাইল-৮ (বাসাইল-সখীপুর) আসন থেকে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। হলফনামায় স্বাক্ষর না থাকায় পটুয়াখালী-৩ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী গোলাম মাওলা রনির মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ-১ আসনে গণফোরাম প্রার্থী ড. রেজা কিবরিয়া এবং সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে।
ড. রেজা কিবরিয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমি দীর্ঘদিন দেশের বাইরে কর্মরত ছিলাম বিধায় বিলটি যথাসময়ে পরিশোধ করা হয়নি। ইতিমধ্যে বকেয়া বিলটি পরিশোধ করা হয়েছে। আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বগুড়া-৪ আসনের আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে সমর্থক হিসেবে ভোটারের স্বাক্ষর জাল করার অভিযোগে।
এ বিষয়ে হিরো আলম বলেন, আমার ক্ষমতা নেই। তাই আমারটা বাতিল করা হয়েছে। এতে আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। নির্বাচনী এলাকায় মোট ভোটার তিন লাখ ১২ হাজার ৮৬ জন। সে অনুযায়ী তিন হাজার ১২১ জনের স্বাক্ষরই যথেষ্ট। কিন্তু আমি তিন হাজার ৫০০ জনের স্বাক্ষর নিয়ে তা জমা দিয়েছি।
কুড়িগ্রাম-৪ আসনে গণজাগরণ মঞ্চের নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী ইমরান এইচ সরকারের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। মনোনয়নপত্রে এক শতাংশ ভোটারের তালিকায় ত্রুটি থাকায় জেলা প্রশাসক ও রিটার্নিং অফিসার মোছা. সুলতানা পারভীন তাঁর মনোনয়নপত্রটি বাতিল করেন। তবে ইমরান এইচ সরকার জানিয়েছেন, এর বিপরীতে তিনি আপিল করবেন।
আদালতে দণ্ডের কারণে খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ ভুঁইয়া ফের নির্বাচন থেকে ছিটকে পড়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে একই কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়েছিল তাঁর। অন্যদিকে ১৭ বছর পর এই প্রথম নির্বাচনী দৌড় থেকে বাদ পড়ল পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)।
কুষ্টিয়া-১ (দৌলতপুর) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না থাকায় সাবেক এমপি আফাজ উদ্দিন আহমেদের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। মেহেরপুরের দুটি আসনে ১০ জনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
যাঁদের মনোনয়ন বাতিল করা হয়েছে তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মেহেরপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান, জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট মিয়াজান আলী ও শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট ইয়ারুল ইসলাম। এঁরা দলের মনোনয়ন না থাকার পরও দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন।
মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর না থাকায় নাটোর-১ আসনে সাম্যবাদী দলের বীরেন্দ্রনাথ সাহা এবং নাটোর-২ আসনে মামলায় সাজা হওয়ার কারণে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলা বিএনপির সভাপতি রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়।
কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসনের সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদের ভাই ও বিএনপি মনোনীত প্রার্থী কে এম মুজিবুল হকের মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে আয়কর সনদ না থাকায়। তবে কে এম মুজিবুল হকের অভিযোগ, নথি থেকে আয়করের সনদটি গায়েব করার মাধ্যমে আমার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়েছে।
সৈয়দ আশরাফের মনোনয়ন অবৈধ ঘোষণার দাবি : এদিকে কিশোরগঞ্জ-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের মনোনয়নপত্র যথাযথ আইন মেনে দাখিল করা হয়নি এ অভিযোগ এনে তাঁর মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছেন বিএনপির মনোনীত প্রার্থী রেজাউল করিম খান চুন্নু।
বরিশাল জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের আলোচিত তিনজনসহ ৯ জনের মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাতিল হওয়া প্রার্থীদের মধ্যে বরিশাল-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) মনোনিত প্রার্থী চিত্রনায়ক মাসুদ পারভেজ সোহেল রানা রয়েছেন। তাঁর গ্রামের বাড়িতে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তিনটি মিটারের অনুকূলে চার হাজার ১৪৮ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে আপত্তি জানানো হয়।
যদিও গতকাল যাচাই-বাছাইয়ের দিন সকালে সোহেল রানার বকেয়া বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করেছেন। এই আসনের অন্য আলোচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্যাপ্টেন এম মোয়াজ্জেম হোসেনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দাখিল করা ভোটার তালিকায় মৃত্যু ব্যক্তির নাম থাকায় তাঁর মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হয়।
একই আসনের অন্য আলোচিত প্রার্থী শেরেবাংলার দৌহিত্র ফাইয়াজুল হক রাজু মনোনয়নপত্রের সঙ্গে দেওয়া ভোটার সমর্থকদের তালিকার একজন ভোটারকে রিটার্নিং অফিসারের তদন্ত দল খুঁজে না পাওয়ায় তাঁর মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করা হয়।