ব্যাংক খাতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান বিশ্লেষকরা
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০১৯-০১-০৩ ১২:২৩:২১
ব্যাংক খাতে বিদ্যমান সমস্যার স্থায়ী সমাধান চান বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, ব্যাংক খাত বাঁচাতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত যতগুলো উদ্যোগ নিয়েছেন সেগুলোর সবই ছিল সাময়িক বা অস্থায়ী।
খেলাপি ঋণ কমানোর চলমান প্রক্রিয়ায় ‘ঋণ পুনর্গঠন’, ‘ঋণ পুনঃতফসিল’ ও ‘ঋণ অবলোপন’ বৈধ হলেও এগুলো খেলাপি ঋণকে আরও প্রশ্রয় বা প্রলম্বিত করে।
তারা বলেন, তাই অস্থায়ী কোনো সমাধান নয়, বরং ব্যাংক খাতকে সত্যিকারভাবে বাঁচাতে হলে স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে। এর জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সদিচ্ছার প্রয়োজন।
এছাড়া লুটপাটের কারণে পুঁজি সংকটে পড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের মূলধন সরকারের জোগানো উচিত নয়। এতে লুটপাটকারীরা আরও উৎসাহিত হয়।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, যে সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়, তারা আবার ক্ষমতায় এসেছেন। তাদের কাছে প্রত্যাশা- নির্বাচনের আগে ব্যাংক খাত নিয়ে তারা যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা যেন এখন বাস্তবায়ন করেন। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপ না করা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকাণ্ড সূক্ষ্মভাবে তদারকি করা, ব্যাংক কোম্পানি আইনের যেসব ধারায় আপত্তি আছে তা সংশোধন করাসহ খাতটিকে ঢেলে সাজাতে বেশ কিছু দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব কার্যকর করতে পারলে ব্যাংকিং খাত স্থায়ীভাবে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক খাতের বড় সমস্যা উচ্চ খেলাপি ঋণ। এটি কমাতে চলমান প্রক্রিয়ায় ঋণ পুনর্গঠন, ঋণ পুনঃতফসিল ও ঋণ অবলোপন করলে শুধু হবে না, এসব প্রক্রিয়ায় সাময়িক খেলাপি ঋণ কম দেখানো যায়। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে বিপদ থেকে যায়। বরং তার চেয়ে স্থায়ী সমাধানের চিন্তা করতে হবে।
অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বেসিক ও ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারিসহ ছোট-বড় সব সমস্যার সমাধান করতে হবে। এছাড়া খেলাপি ঋণ পাঁচ শতাংশে নামিয়ে আনতে না পারলে ব্যাংকিং খাতকে ভালো বলা যাবে না। নতুন সরকারকে এসব বিষয়ে বেশি নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছিল ২৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) আমদানিতে ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সর্বশেষ অক্টোবরে আমদানির পরিমাণ আগের বছরের অক্টোবরের চেয়ে ৪ শতাংশের বেশি।
আমদানি কমায় বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৩২ বিলিয়ন ডলারের ওপরে। কিছুদিন আগে রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল।
এছাড়া ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকা রেমিট্যান্সে ঘুরে দাঁড়ানোর বছর ছিল ২০১৮ সাল। সদ্য সমাপ্ত বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলে এক হাজার ৫৫৭ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে এসেছে।
দেশের ইতিহাসে এক বছরে রেমিট্যান্স আসার এটি সর্বোচ্চ রেকর্ড। আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশের ওপরে প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আগের বছরের তুলনায় ২০৩ কোটি ডলার বা ১৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। সদ্য বিদায়ী বছরে এ প্রবৃদ্ধির বড় অংশ হয়েছে প্রথম ছয় মাসে।
জানুয়ারি-জুন সময়ে রেমিট্যান্সে ২১ দশমিক ৯১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। শেষ ছয় মাসে ৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো রেমিট্যান্স ১৫ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে।
ওই বছর প্রবাসীরা ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এক হাজার ৫৩১ কোটি ডলারের সমপরিমাণ অর্থ দেশে পাঠান। আগের বছরের তুলনায় যা ৩৯ কোটি ডলার বা ২ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।
গত অর্থবছর রফতানি আয় বেড়েছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। আর এ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সে গতি আরও বেড়ে ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতি আছে সহনীয় অবস্থায়। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসভিত্তিক) নভেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।
কিন্তু ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে ২০১৮ সালে সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এ খাতে ১০ বছরে ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ এসেছে। কিন্তু সেগুলোর কোনো সুরাহা হয়নি।
১০ বছর আগে ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেয়ার সময় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা।
আর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে হয়েছে ৯৯ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ১০ বছরে দেশে সাড়ে চার গুণ খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
এর বাইরে দীর্ঘদিন আদায় করতে না পারা যেসব ঋণ ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে, তার পরিমাণ প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন করা এ মন্দ ঋণ যুক্ত করলে প্রকৃত খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
বিশাল অংকের এই খেলাপি ঋণের পাশাপাশি ব্যাংক খাতের ঋণ কেলেঙ্কারিসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ কয়েক বছর ধরেই রয়েছে আলোচনায়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির তথ্য অনুযায়ী ১০ বছরে ব্যাংক খাতের ১০টি বড় কেলেঙ্কারিতে ২২ হাজার ৫০২ কোটি টাকা লোপাট হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের তিন সপ্তাহ আগে ৯ নভেম্বর ‘বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিয়ে আমরা কী করব’ শীর্ষক এক সংলাপে এ তথ্য দেয় সিপিডি।
তবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ তথ্য ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে উড়িয়ে দেন।
এদিকে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে আগামী পাঁচ বছরের পরিকল্পনায় বলা হয়, ‘ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের উন্নয়নের লক্ষ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমিয়ে আনা এবং দেউলিয়া আইন বাস্তবায়নের টেকসই ও কার্যকর পদ্ধতি নির্ণয় করা হবে।
বাজার ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিচক্ষণতার সঙ্গে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ব্যবহার করে সুদের হার নিয়ন্ত্রণে রাখবে। ঋণ অনুমোদন ও অর্থছাড়ে দক্ষতা এবং গ্রাহকের প্রতি ব্যাংকের দায়বদ্ধতা পরিবীক্ষণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক পদক্ষেপ নেবে।’
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. শফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, উন্নয়নের পক্ষে সরকারের নিরঙ্কুশ বিজয় হয়েছে। আর উন্নয়নের প্রধান শর্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা না থাকলে কার্যকর উন্নয়ন করা সম্ভব হবে না। সুতরাং নতুন সরকারকে উন্নয়নের স্বার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।