প্রস্তাবিত বাজেটে হিসাবে পড়েনি মধ্যবিত্ত

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৬-১৬ ১২:৪২:২৬


দেশের প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এক-চতুর্থাংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। অথচ প্রস্তাবিত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের বাজেটে এ শ্রেণির জন্য কিছু নেই। বরং করজাল বিস্তারের বড় লক্ষ্য হয়ে পড়ছে মধ্যবিত্ত স্তরের মানুষ। অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ধনীদের আদৃত করা হয়েছে এবং মধ্যবিত্তদের হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। অথচ প্রত্যাশা ছিল ঠিক তার উল্টো। তাই বাজেট পাস করার সময় ন্যূনতম আয়করসীমা, সঞ্চয়পত্রে প্রস্তাবিত উেস কর, স্মার্টফোন আমদানি ও মোবাইল ফোনে কথা বলা এবং ইন্টারনেট ব্যবহার সাশ্রয়ী করা সর্বোপরি সয়াবিন তেল, গুঁড়া দুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে প্রস্তাবিত কর বিবেচনা করার পরমর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ছিল। অথচ প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এতে মধ্যবিত্তের ওপর বেশি খড়্গ নামবে। ফলে আয়বৈষম্য আরো বাড়বে। পাশাপাশি ধনী-গরিব বৈষম্য আরো্ প্রকট হবে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাজেটে উচ্চবিত্তদের জন্য যথেষ্ট দেওয়া হয়েছে। নিম্নবিত্তদের জন্য সামান্য কিছু আছে। কিন্তু মধ্যবিত্তদের জন্য কিছুই নেই। বরং তাদের ওপর বিভিন্ন করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, উচ্চবিত্তদের অনেক কণ্ঠ আছে। তাই প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের সহযোগিতা করা হয়েছে। আর যেহেতু মধ্যবিত্তদের কোনো কণ্ঠ নেই, তাই তারা উপেক্ষিত।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক মধ্যবিত্ত করের আওতার বাইরে। তারা কর দিতে সক্ষম। তাই তাদের এর আওতায় আনা উচিত। কারণ ব্যয় ব্যবস্থাপনা ঠিক থাকবে কিভাবে? করজাল বিস্তার না করলে রাজস্ব বাড়বে না। ফলে ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সমস্যা হবে। তবে প্রস্তাবিত বাজেট মধ্যবিত্তবান্ধব নয়। উচ্চবিত্তদের সুবিধা দেওয়া হয়েছে। কিছু উদ্যোগ অপ্রয়োজনে নেওয়া হয়েছে, যেমন মোবাইল ফোনে সারচার্জ বাড়ানোর কোনো দরকার ছিল না। এখন তো রিকশাওয়ালারাও মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। এটা বিবেচনা করা উচিত ছিল। সঞ্চয়পত্রে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তা-ও ঠিক নয়। এখানে উেস কর না বাড়িয়ে বিক্রি সীমিত করা উচিত ছিল। বলা উচিত, নির্দিষ্ট সীমা পার হওয়ার পর সঞ্চয়পত্র আর বিক্রি হবে না।’

বাজেটে প্রত্যাশা কী ছিল জানতে চাইলে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘মধ্যবিত্তদের ওপর একটু বেশিই চাপ হয়ে গেছে। করমুক্ত আয়করসীমা গত কয়েক বছর একই জায়গায় রয়েছে। এটি বাড়বে আশা করেছিলাম।’

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘বাজেট সার্বিকভাবে উন্নয়নমুখী, ব্যবসাবান্ধব; কিন্তু ভোক্তাবান্ধব নয়। বিশেষ করে মধ্যবিত্তবান্ধব কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ধনী শ্রেণিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। গরিব বা নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কিছু আছে, কিন্তু তা অপ্রতুল। আর মধ্যবিত্তদের হিসাবের বাইরে রাখা হয়েছে। মধ্যবিত্তদের সঞ্চয়ের নিরাপদ স্থানে হাত দেওয়া হয়েছে, করমুক্ত আয়সীমা বাড়েনি, গুঁড়া দুধের মতো পণ্যের দাম বাড়ানোর মতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কৃষকদের কিছু জিনিসে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা-ও অপ্রতুল।’

বাজেটে কী প্রত্যাশা করেছিলেন জানতে চাইলে গোলাম রহমান বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যক্তির করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো উচিত ছিল। ভেবেছিলাম, বাড়বে; কিন্তু তা হয়নি। একটা সময় সঞ্চয়পত্রে কোনো কর ছিল না, কিন্তু সঞ্চয়পত্রে উেস কর বাড়ানো হয়েছে। এটি তুলে দেওয়া উচিত। কারণ সঞ্চয়পত্র মানে শুধু নিরাপদ বিনিয়োগ নয়, সামাজিক নিরাপত্তাও। মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্তদের সঞ্চয়ের অন্যতম খাত এটি। প্রস্তাবিত বাজেটে দেশি শিল্প সুরক্ষায় কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো ভালো, কিন্তু গুঁড়া দুধের মতো পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। গুঁড়া দুধ তো বাচ্চাদের খাবার। তা ছাড়া দেশি যেসব গুঁড়া দুধ বাজারে আছে তার অনেকগুলোতে সিসার পরিমাণ বেশি। সয়াবিন তেলের দামও বাড়বে। কারণ কর বসেছে। এগুলো কমবে প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু উল্টো হয়েছে। এ ছাড়া গণপরিবহন, শিক্ষা, স্বাস্থ্যে মধ্যবিত্তদের জন্য বিশেষ কিছু থাকবে বলেও আশা করেছিলাম। বাজেট পাস করার সময় এগুলো পরিবর্তন করা উচিত।’

কয়েক বছর যাবৎ কম্পানি ব্যতীত অন্যান্য শ্রেণির করদাতার করমুক্ত আয়সীমা একই বৃত্তে আটকে আছে। প্রস্তাবিত বাজেটেও তা বাড়েনি। কয়েক বছর যাবৎ করমুক্ত আয়সীমা দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা নির্ধারিত আছে। নারী করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকায় সীমাবদ্ধ। মধ্যবিত্তদের একটু স্বস্তি দিতে ওই করমুক্ত আয়সীমাও বাড়ানো হয়নি। অথচ মাথাপিছু আয় বেড়ে এক হাজার ৯০০ ডলারের বেশি হয়েছে। এর কারণ হিসেবে বাজেটে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে করমুক্ত আয়সীমা মাথাপিছু আয়ের দেড় গুণ। এটি আরো বাড়ালে অনেকেই করের আওতার বাইরে চলে যাবে। এ ছাড়া ঢাকার দুটি ও চট্টগ্রামসহ অন্যান্য সিটি করপোরেশন এবং সিটি করপোরেশনের বাইরের অন্যান্য এলাকায় করদাতাদের ন্যূনতম করও বাড়েনি। বর্তমানে এটি ঢাকায় পাঁচ হাজার, চট্টগ্রামে চার হাজার এবং অন্যান্য সিটি করপোরেশনে তিন হাজার টাকা রয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলেই টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ফলে মধ্যবিত্তদের ওপর চাপ আসবে।

মধ্যবিত্তরাই গণপরিবহনে বেশি চড়ে। কিন্তু বাজেটে গণপরিবহনে সুবিধা দেওয়ার কথা কিছু বলা নেই। মেট্রো রেল নির্মাণ এখনো শেষ হয়নি। স্বপ্নের মেট্রো রেল শেষ হতে ২০২১ সাল লেগে যেতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। অর্থাৎ এর সুবিধা পেতে মধ্যবিত্তদের আরো দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে।

মধ্যবিত্ত স্তরের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে অন্যতম ভরসা সরকারি স্কুল-কলেজ ও সরকারি হাসপাতাল, কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে জিডিপি অনুপাতে ব্যয় বাড়ানো হয়নি প্রস্তাবিত বাজেটে। মধ্যবিত্তদের কম খরচে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি এতে। তবে বিত্তবানরা চার্টার্ড বিমান ও হেলিকপ্টারে করে দেশ বা বিদেশ ভ্রমণ করলে সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে বাজেটে।

দেশের শেয়ারবাজার অস্থিতিশীল। ব্যাংক খাতে আমানতের সুদের হার তুলনামূলক কম। এ অবস্থায় সঞ্চয়ের জন্য মধ্যবিত্তদের আস্থা সঞ্চয়পত্রে। প্রস্তাবিত বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর ১০ শতাংশ উেস কর কাটা হবে। আগে এটি ৫ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ আগে যে গ্রাহক সঞ্চয়পত্র ওঠানোর সময় এক হাজার টাকায় ৯৫০ টাকা পেত, এখন সেটি নেমে আসবে ৯০০ টাকায়।

অনেক শিক্ষার্থী স্মার্টফোনে ইন্টারনেটের মাধ্যমে লেখাপড়ার অনুষঙ্গ খোঁজে। অনেক ক্ষেত্রে ফেসবুক, ইউটিউবসহ প্রয়োজনীয় সাইট ভিজিট করে। স্মার্টফোন আমদানিতেও সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে দাম বাড়বে স্মার্টফোনের। বেশি দাম দিয়ে স্মার্টফোন কিনেও শান্তি নেই। কারণ মোবাইল ফোনের সিম ব্যবহার করে প্রদত্ত সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক ১০ শতাংশ করা হয়েছে। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে কথা বলা এবং ইন্টারনেট ব্যবহার দুটিতেই খরচ আরেক দফা বাড়বে।

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্র্যান্ড, নন-ব্র্যান্ড সব ধরনের পোশাকে ভ্যাট বাড়িয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয়েছে। ভালো পোশাক কিনতে না পেরে মন খারাপ করে রেস্টুরেন্টে বসে খেতে গেলেও বাড়তি কর দিতে হবে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয় এমন ধরনের রেস্টুরেন্টে মধ্যবিত্তরাই বেশি যায়। সেখানে খাবার বিলে ৭.৫ শতাংশ বাড়তি ভ্যাট ধরা হয়েছে। কম্পিউটার ও ল্যাপটপের ওপরও বাড়তি কর বসানো হয়েছে।

প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী চিনি, ভোজ্য তেল ও গুঁড়া দুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়বে। এটি নিম্ন, মধ্য কিংবা বিত্তবান সবার ওপর সমান কার্যকর হবে। তবে স্বাভাবিকভাবে এর ভুক্তভোগী হবে কম ও মধ্যম আয়ের মানুষ।

প্রস্তাবিত বাজেটে ধনীরা ছাড় পেয়েছে। যেমন বিত্তশালী বা সম্পদশালীরা সারচার্জে বড় ছাড় পেয়েছে। এখন থেকে তিন কোটি টাকার কম বাড়ি-গাড়িসহ বিভিন্ন ধরনের সম্পদ থাকলে সারচার্জ দিতে হবে না। অথচ চলতি বাজেটেই সোয়া দুই কোটি টাকার সম্পদ থাকলেই সারচার্জ দেওয়ার নিয়ম রাখা ছিল।

বিত্তবানদের ফ্ল্যাট ও জমি কেনায় কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়েছে সরকার। এ ছাড়া অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করলে বিনিয়োগ করা অর্থের ওপর ১০ শতাংশ কর দিলে এর উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন তোলা হবে না।