প্রবাসীদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠছে সৌদি আরব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক আপডেট: ২০১৯-০৬-২৭ ১০:৪৩:৪৯


সৌদি আরব বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের জন্য সবচেয়ে বড় উৎস । প্রবাসী বাংলাদেশী শ্রমিকদের বড় অংশের কাজেরও জায়গা দেশটি। রেমিট্যান্সের সর্ববৃহৎ এ উৎসটি ক্রমেই অসহনীয় হয়ে উঠছে প্রবাসী বাংলাদেশীদের জন্য। অতিমাত্রায় সৌদিকরণের ফলে কাজের সুযোগ কমছে দেশটিতে। চলছে নির্যাতনও। চাকরি খুইয়ে, কখনো নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন সৌদিপ্রবাসী বাংলাদেশীরা। সর্বশেষ গত শুক্রবারও ফিরতে হয়েছে সৌদিপ্রবাসী ৪৩৪ বাংলাদেশী শ্রমিককে।

জানা গেছে, সৌদিকরণের অংশ হিসেবে অনেকগুলো পেশায় বিদেশী কর্মী নিয়োগ পুরোপুরি নিষিদ্ধ করেছে দেশটি। এসব পেশায় আগে থেকে যেসব প্রবাসী কর্মরত আছেন, নবায়ন করা হচ্ছে না তাদের কাজের অনুমতিপত্র (আকামা)। বৈধ কাগজপত্র না থাকায় জেল খাটতে হচ্ছে তাদের। কারাভোগ শেষে বাংলাদেশ দূতাবাসের আউটপাস নিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। বৈধ কাগজপত্র না থাকার অজুহাতে কয়েক বছর ধরেই এভাবে বহু প্রবাসী শ্রমিককে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে সৌদি সরকার। যদিও দেশে আসার পর অনেকেই বলছেন, তাদের কাছে বৈধ আকামা (বসবাসের অনুমতিপত্র) ছিল।

সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস বলছে, সৌদি আরবে অবস্থানকারী বাংলাদেশী শ্রমিকদের আকামায় যে পেশা ও নিয়োগদাতার নাম উল্লেখ করা আছে, সেখানে কাজ না করে অন্য স্থানে বা অন্য কোনো পেশায় কাজ করছে এমন প্রবাসী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিচ্ছে সৌদি আরব সরকার। এর অংশ হিসেবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাদের।

গত আড়াই বছরে ৭০ হাজার ২৮ জন প্রবাসী বাংলাদেশীকে আউটপাস দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে দূতাবাস। এর মধ্যে চলতি বছর ২০ জুন পর্যন্ত আউটপাস ইস্যু হয়েছে ১১ হাজার ২২২ জনের। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৭ হাজার ৫২০ এবং ২০১৭ সালে ৩১ হাজার ২৯৬ জনের।

মূলত যাদের পাসপোর্ট নেই, অবৈধ কিংবা বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত প্রবাসীরা, যারা একেবারে দেশে চলে যেতে ইচ্ছুক অথবা দেশে গিয়ে নতুন ভিসায় আবার সৌদি আরবে আসতে চান, তাদের জন্য দেশে যাওয়ার ছাড়পত্র বা আউটপাস দেয় দূতাবাস। এছাড়া যেসব গৃহকর্মী দূতাবাসের সেফ হাউজে হেফাজতে থাকেন এবং যাদের মামলা শেষ, তাদেরও আউটপাস দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে দূতাবাস।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূতাবাসের আউটপাস নিয়ে ফিরে আসাদের বড় অংশই সৌদি আরব ছেড়েছেন নিজ পেশায় টিকতে না পেরে। মূলত চাকরিতে ব্যাপকমাত্রায় সৌদিকরণের ফলে দেশটিতে প্রবাসীদের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে পড়েছে। যার কারণে বৈধভাবে বা অবৈধ হয়ে ফিরে আসতে হচ্ছে তাদের।

বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দা সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বেশকিছু পেশা শুধু সৌদি নাগরিকদের জন্য সংরক্ষিত রাখার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ কারণে এসব পেশায় কর্মরত বৈধ প্রবাসী শ্রমিকদেরও আকামা  নবায়ন করা হচ্ছে না। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে থাকা বৈধ প্রবাসীরাও অবৈধ হয়ে পড়ছেন।

জেদ্দায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের শ্রমকল্যাণ উইংয়ের কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, গত বছর সৌদি আরব সরকার ১২টি পেশায় প্রবাসীদের কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এসব ক্ষেত্রে কেবল সৌদি আরবের নাগরিকরা কাজ করতে পারবে। এতে দীর্ঘ সময় ধরে যেসব বাংলাদেশী সৌদি আরবে ছিলেন, তাদের কাজের ক্ষেত্র সীমিত হয়ে গেছে; যার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই দেশে ফিরে যাচ্ছেন। অন্যদিকে যাদের আকামার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, পাসপোর্ট নেই অথবা অন্যান্য কারণে অবৈধ হয়ে পড়েছেন, তাদের দূতাবাসের সহায়তায় আউটপাসের ব্যবস্থা করে দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সম্প্রতি সৌদির বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, সৌদি আরব সরকার ১২টি পেশায় প্রবাসীদের কাজ করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এসব ক্ষেত্রে কেবল সৌদি আরবের নাগরিকরা কাজ করতে পারবে। প্রবাসীদের জন্য নিষিদ্ধ করা কর্মক্ষেত্রগুলো হলো ঘড়ির দোকান, চশমার দোকান, ওষুধ সরঞ্জামের দোকান, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকান, প্রাইভেট কারের খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান, ভবন নির্মাণের উপাদানের দোকান, কার্পেটের দোকান, অটোমোবাইলের দোকান, ফার্নিচারের দোকান, প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাকের দোকান, শিশু ও পুরুষদের পোশাকের দোকান, চকোলেট ও মিষ্টির দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানে যেকোনো অভিবাসীকে নিয়োজিত পাওয়ামাত্র তাদের অবৈধ বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

সৌদি আরবে প্রবাসী শ্রমিকদের কাজের ক্ষেত্র সীমিত করা হয়েছে কয়েক ধাপে। গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে অটোমোবাইলের দোকান, প্রস্তুতকৃত তৈরি পোশাকের দোকান, আসবাবের দোকান এবং গৃহস্থালি ও রান্নায় ব্যবহার্য উপকরণের দোকানে প্রবাসী জনবল নিয়োগ বন্ধ করে সৌদি সরকার। পরবর্তী সময়ে ৯ নভেম্বর থেকে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকান, ঘড়ির দোকান ও চশমার দোকানে প্রবাসী জনবল নিয়োগ ও চাকরির পথ বন্ধ করা হয়। এরপর গত ৭ জানুয়ারি থেকে প্রবাসীদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায় ওষুধ সরঞ্জামের দোকান, প্রাইভেট কারের খুচরা যন্ত্রাংশের দোকান, ভবন নির্মাণের উপাদানের দোকান, কার্পেটের দোকান ও মিষ্টির দোকানের সব ধরনের চাকরি।

সৌদি আরবে নারীরা গাড়ি চালানোর অনুমতি পাওয়ার পর দেশটিতে গাড়িচালক পদেও চাকরির সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে প্রবাসীদের জন্য।

বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল জেদ্দা সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে স্থানীয় গাড়িচালক (ডমেস্টিক ড্রাইভার) হিসেবে বিভিন্ন দেশের প্রায় এক লাখ প্রবাসী কাজ করছেন। যাদের বেতন-ভাতা হিসেবে সৌদি নাগরিকদের প্রায় ১৪ বিলিয়ন সৌদি রিয়াল ব্যয় হয়। এটি কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি সরকার। এজন্য প্রথম ধাপ হিসেবে গত বছরের জুন থেকে সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। এর মধ্যেই সৌদি নারীদের ২৪ শতাংশ ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে আবেদন করেছে এবং আরো ৬১ শতাংশ নারী আবেদনের আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ডমেস্টিক ড্রাইভার হিসেবে সৌদি আরবে প্রবাসী নাগরিকদের চাকরির সুযোগ কমে আসছে। এর ফলে পেশাটিতে থাকা বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী প্রবাসীর দেশে ফিরে আসার আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ দূতাবাস।

অভিবাসন বিশ্লেষকরা বলছেন, রিক্রুটিং এজেন্সির ভিসা কেনাবেচার কারণে এমনিতেই সৌদি আরবে অভিবাসন ব্যয় অনেক গুণ বেশি। অন্যদিকে অত্যধিক খরচে বিদেশে যাওয়ার পর কম মজুরিতে নিয়োগ, নিচু পদে কাজ করা, এমনকি চাকরিচ্যুত হতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত টিকতে না পেরে অনেকেই দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন।

প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ড. সি আর আবরার এ প্রসঙ্গে বলেন, সৌদিকরণের কারণে ১২ ক্যাটাগরিতে প্রবাসী শ্রমিক নিষিদ্ধ। আকামা ফি বাড়ানোর ফলে যারা ছোট ব্যবসা ও দোকান করতেন তাদের অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে দেশে চলে আসছেন। আবার আকামা নবায়ন না হওয়ায় অনেকেই অবৈধ হয়ে গ্রেফতার হচ্ছেন। ফিরে আসতে হচ্ছে দেশে।

সৌদি আরবে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র কমে যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে গত বছর ২৮ ডিসেম্বর প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় জেদ্দার বাংলাদেশ কনস্যুলেট জেনারেল। কাউন্সিলর আমিনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, সৌদিকরণের প্রভাবে সৌদি আরবে প্রবাসীদের চাকরির বাজার ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হওয়ায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশীর সৌদি আরব ত্যাগ করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সৌদিকরণ প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে সৌদি আরবে ২০১৮ সালের প্রথম প্রান্তিকে সরকারি ও বেসরকারি খাতে ২ লাখ ৩৪ হাজারের বেশি প্রবাসী চাকরি হারিয়েছেন। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে প্রবাসী জনবল পরিচালন ব্যয় সৌদি জনবল ব্যয়ের তুলায় বেশি হওয়ায় সেখানে প্রবাসীদের কাজের সুযোগ কমছে। পাশাপাশি সৌদি আরবে আকামা ফি বৃদ্ধি ও পরিবারের সদস্যদের ওপর আকামা ফি আরোপ হওয়ায় প্রবাসীদের সৌদি আরব ত্যাগের হার দিন দিন বাড়ছে।

বৃহৎ পরিসরে বাংলাদেশী নারীদের সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানো শুরু হয় ২০১৫ সালে। কিন্তু যাওয়ার পর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। কম পাচ্ছেন পারিশ্রমিকও। শেষ পর্যন্ত পালিয়ে সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের শেল্টার হোমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে দূতাবাসের সহায়তায় কেউ কেউ দেশে ফিরে আসছেন। আইনি জটিলতায় আটকে গিয়ে দেশে ফিরতে পারছেন না, এমন নারীর সংখ্যাও কম নয়।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালেই প্রতি মাসে গড়ে ২০০ নারী শ্রমিক দেশে ফিরেছেন। একই সঙ্গে সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দায় সেফ হোমগুলোয় গড়ে ২০০ জন করে নারী শ্রমিক আশ্রয় নিয়েছেন। গত দুই-তিন বছরে অন্তত পাঁচ হাজার নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে এসেছেন। এ নারীদের একটি বড় অংশ নানা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বিএমইটি সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবে কর্মরত আছেন ২১ লাখ বাংলাদেশী। এর মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ বাংলাদেশী গৃহকর্মী হিসেবে দেশটিতে কর্মরত। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে কর্মী গেছেন ২ লাখ ২৬ হাজার ৭৭১ জন। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গেছেন ১ লাখ ২৩ হাজার ৪৭৪ জন, যা বিদেশে যাওয়া মোট শ্রমিকের ৫৪ শতাংশ। পুরুষ কর্মীর পাশাপাশি সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে নারী কর্মীরাও যাচ্ছেন। চলতি বছরের চার মাসে ৪৫ হাজার ২৯০ জন নারী কর্মী গেছেন বিভিন্ন দেশে। সবচেয়ে বেশি গেছেন সৌদি আরবে, ২৯ হাজার ৯০৪ জন।