বাজেটে কোনো ছাড় পেল না মধ্যবিত্ত

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৭-০১ ১০:৩৮:০৮


এখন থেকে ইটিআইএন ছাড়া সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিদ্যুৎ বিল দেওয়া যাবে না। বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে গেলেও লাগবে ইলেকট্রনিক ট্যাক্সপেয়ার্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর)। জমি রেজিস্ট্রি করতে হলে দলিলে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের ইটিআইএন উল্লেখ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভুয়া নম্বর দিলে দলিল বাতিল হবে। বাজেটে শুল্ক বাড়ানোর কারণে বাজারে বিদেশি গুঁড়া দুধের দাম এরই মধ্যে বেড়ে গেছে। বেড়েছে আরো কিছু নিত্যপণ্যের দাম। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও গত তিন বছরের মতো একই থাকছে করমুক্ত আয়সীমা। এতে মাসে ২০ হাজার ৮৩৪ টাকা নিট আয় থাকলেই একজন ব্যক্তিকে সরকারি কোষাগারে করের অর্থ জমা দিতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপনের পর থেকেই সংসদের ভেতরে বাইরে সঞ্চয়পত্রে বাড়তি উেস কর প্রত্যাহারের দাবি উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত তা কমানো হয়নি। করপোরেট কর কমানোর দাবি ছিল বেসরকারি খাতের। বাজেটের আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল আশ্বাসও দিয়েছিলেন। তবু কমেনি করপোরেট কর হার। মোবাইল কলরেট ও স্মার্টফোনের ওপর বাড়তি কর আরোপে এ ক্ষেত্রেও মানুষকে গুনতে হবে পকেটের টাকা।

অগ্রিম কর প্রত্যাহার না হওয়ায় এবং জোগানদারের ভ্যাট বাড়ানোয় ব্যবসায় খরচ বেড়ে যাবে। নতুন অর্থবছর থেকে ভ্যাটের সব হারে রেয়াত নেওয়ার সুযোগও থাকছে না।

এ রকম অনেক প্রত্যাশা অপূর্ণ রেখেই গতকাল সংসদে পাস হয়ে গেল নতুন অর্থবছরের জন্য পাঁচ লাখ ২৩ হাজার ১৯০ কোটি টাকার বাজেট। বিপুল অঙ্কের এই ব্যয় মেটাতে কর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে তিন লাখ ৪০ হাজার ১০৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) জোগান দিতে হবে তিন লাখ ২৫ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। করের হার না বাড়িয়ে কর জাল বিস্তৃত করার কথা বাজেটে বলা হলেও রাজস্ব আদায়ের বিশাল চাপ সামাল দিতে গিয়ে এনবিআর নতুন নতুন করক্ষেত্র যেমন খুঁজে বের করেছে, তেমনি কিছু খাতে বিদ্যমান করহারও বাড়িয়েছে, যার মাশুল গুনতে হবে মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষকে।

বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। এবারের বাজেটেও সঞ্চয়পত্র থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসরভোগীদের শেষ সম্বলের সুরক্ষা দেওয়ার জন্য এটি সরকারের একটি বিশেষ উদ্যোগ। ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কম হওয়ায় মধ্য ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য বিশেষ আস্থার বিনিয়োগ সঞ্চয়পত্র। বাজেটে এর মুনাফা থেকে উেস কর ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করার প্রস্তাবে সংসদের ভেতরে ও বাইরে এ নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়। শনিবার অর্থবিল পাস হয়ে গেলেও এটি কমানো হয়নি। ফলে বিনিয়োগের এ আস্থার জায়গাতেও ধাক্কা খেল স্বল্প আয়ের মানুষ ও অবসরভোগীদের পরিবার।

করদাতা ধরতে বিদ্যুতে টিআইএন : পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে ও বিল দিতে ইটিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে নতুন বাজেটে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ বিল গ্রহণকালে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইটিআইএন আসল না ভুয়া তা যাচাই করা হবে।

এনবিআরের সদস্য কানন কুমার বলেন, ‘পোস্ট পেইড এবং প্রিপেইড উভয় ধরনের বিদ্যুৎ বিল প্রদানকালেই বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মালিকের ইটিআইএন যাচাই করা হবে। ইটিআইএন না থাকলে কোনোভাবেই বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে না। অর্থবছরের শুরু থেকেই এ ব্যবস্থা কার্যকর সম্ভব না হলেও অচিরেই হবে। এ জন্য নতুন সফটওয়্যার সংযোগের কাজ জোরেশোরে চলছে। ভুয়া ইটিআইএন দেওয়া হলে বিদ্যুতের লাইন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্লক হয়ে যাবে।’

ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদ্যুৎ বিল ধরে করদাতা খুঁজে বের করা হবে। এরই মধ্যে আমরা তিনটি কম্পানির সঙ্গে বৈঠক করেছি। হিসাব পেয়েছি বিদ্যুৎ বিল থেকে শুধু ঢাকা সিটি করপোরেশনেই ২০ লাখ করদাতার সন্ধান পাওয়া যাবে। এর বাইরে বিভিন্ন সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা থেকেও ন্যূনতম ২০ লাখ করদাতা পাওয়া যাবে। বর্তমানে ইটিআইএনধারীর সংখ্যা ৪০ লাখ। এভাবে আগামী অর্থবছরের মধ্যে করদাতার সংখ্যা ৮০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে।’

ভুয়া টিআইএনে দলিল বাতিল : জমি বেচাকেনার সময় দলিলে বাধ্যতামূলকভাবে ক্রেতা-বিক্রেতার ইটিআইএন উল্লেখ করতে হবে। রাজস্ব কর্মকর্তারা বলছেন, জমির নিবন্ধনে ভুয়া ইটিআইএন দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। এটি বন্ধ করতে তাঁরা কঠোর হচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে ইটিআইএন উল্লেখ না করলে বা মিথ্যা ইটিআইএন দিলে দলিল বাতিল বলে গণ্য হবে।

বাজেটে আবাসন খাতে রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে তাতে এই খাতে রাজস্ব আয় বাড়বে। ফ্ল্যাট এবং অ্যাপার্টমেন্ট ক্রয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ বিনিয়োগের সুবিধা এই খাতে স্থবিরতা দূর করবে বলে মনে করে আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাব। তবে মধ্যবিত্তরা যাতে ভাড়ার টাকায় মাথা গোঁজার একটা ঠিকানা খুঁজে পায় সে জন্য স্বল্প সুদের দীর্ঘমেয়াদি একটি তহবিল গঠনের দাবিতে সাড়া মেলেনি বাজেটে।

ছাড় পেল না সীমিত আয়ের মানুষ : জীবনযাত্রার ব্যয় প্রতিবছরই বাড়ছে। বিশেষভাবে ঘরভাড়া, চিকিৎসা, খাবার, যাতায়াত, সন্তানের পড়ালেখার খরচ বেড়েই চলেছে। অথচ এসব খরচের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি টাকাও করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আড়াই লাখ টাকা স্থির করা হয়েছিল, এবারও তাই। আয়কর আইন অনুযায়ী আয়-ব্যয় ও সম্পদের হিসাব মিলিয়ে বছরে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি প্রকৃত আয় থাকলে একজন ব্যক্তিকে অবশ্যই আয়কর পরিশোধ করতে হবে। আয়কর পরিশোধ বা রিটার্ন জমা না দিলে শাস্তি হিসেবে জেল-জরিমানার বিধান আছে। দুই লাখ ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত করযোগ্য আয় আছে, এমন করদাতাদের বেশির ভাগই সাধারণ আয়ের মানুষ। বিভিন্ন রেয়াত ও সুবিধা বাদ দিয়ে তাদের নিট মাসিক আয় ২১ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা।

করপোরেট কর কমল না : প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করপোরেট করহার বেশি। দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে সব ক্ষেত্রে এ হার ২.৫ শতাংশ হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়। অর্থমন্ত্রী বাজেট প্রস্তাব পেশের আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় করপোরেট করহার কমানোর আশ্বাস দেন। কিন্তু রাজস্ব আদায় কমে যাবে—এনবিআর এ যুক্তিতে অটল থাকায় শেষ পর্যন্ত করপোরেট করহারও একই থাকল।

ব্যবসার খরচ বাড়বে : বাজেটে শিল্পের সব কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম কর পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে এবং জোগানদারের ক্ষেত্রে ভ্যাট ৫ শতাংশর পরিবর্তে ৭.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন থেকে কাঁচামালের ওপর আরোপিত অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ এবং জোগানদারের ভ্যাট কমানোর দাবি জানিয়ে বলা হয়, তা না হলে ব্যবসার খরচ বাড়বে। চূড়ান্ত বাজেটে এ দাবি মানা হয়নি। একইভাবে ব্যবসায়ীদের উেস কর কর্তনকারী সত্তা ও প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক টার্নওভারের সীমা এক কোটি টাকার পরিবর্তে তিন কোটি টাকা করার দাবিও আমলে আনা হয়নি। ভ্যাট আইন ২০১২ প্রণয়নের পর থেকে ব্যবসায়ীরা কর কর্মকর্তার ক্ষমতা কমানোর দাবি করে আসছে। নতুন বছরে কর কর্মকর্তার ক্ষমতা কমানো হয়নি বরং এবারের অর্থ বিলে কর কর্মকর্তার ক্ষমতা আরো স্পষ্ট করা হয়েছে। জব্দ করা ও আটক করার স্বেচ্ছা ক্ষমতা বহাল রাখা হয়েছে। ১৫ শতাংশের বাইরে ৫ শতাংশ, ৭.৫ শতাংশ ও ১০ শতাংশ ভ্যাট প্রদানকারীর উপকরণ কর রেয়াত নেওয়ার সুযোগ রাখার দাবি করা হলেও এ সুযোগ দেওয়া হয়নি। উল্টো আরোপ হয়েছে আইনি মারপ্যাঁচ। কেউ যদি রেয়াত নিতে চায় তাহলে তাকে কম হারে ভ্যাট প্রদানের পরিবর্তে ১৫ শতাংশ হারে প্রদানে সম্মত হতে হবে। পৃথক নিবন্ধনের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় নিবন্ধনের বিধান করার কথা বলা হলেও তা সংশোধন করা হয়নি। আপিলের প্রতি স্তরের পরিবর্তে শুধু প্রথম স্তরে দাবির ১০ শতাংশ জমা দেওয়ার প্রস্তাব করা হলেও তা মানা হয়নি। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে আইন প্রতিপালনে অনিয়মে জরিমানার হার ১০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে। এই জরিমানার হারও কমানো হয়নি।

বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা থেকে তৈরি পোশাক খাত ও বস্ত্র খাতের মতো অন্যান্য রপ্তানি খাতেও একই রকম করপোরেট করহার করার প্রস্তাব হয়, প্রাপ্ত নগদ ভর্তুকির ক্ষেত্রে অগ্রিম কর ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ বহাল রাখা, তৈরি পোশাক খাতসহ সব রপ্তানি খাতে একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব করা হলেও তা চূড়ান্ত বাজেটে আনা হয়নি। ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে অগ্রীম আয়কর হারে ছাড় দেওয়া, সব রপ্তানি আয়ের উেস ন্যূনতম করহার কমানোর প্রস্তাব করা হলেও চূড়ান্ত বাজেটে আনা হয়নি।