গাভির খোলা দুধে মিলেছে ক্ষতিকর অণুজীব
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৭-০১ ১১:০৮:৩৪
গাভির খোলা দুধের ৯৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৯৬ শতাংশ নমুনায়ই পাওয়া গেছে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর অণুজীব। ১৫ শতাংশ দুধে মানুষের জন্য গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার সিসা, ১৩ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি টেট্রাসাইক্লিন, ৯ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি কীটনাশক এবং ৩ শতাংশে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি আলফাটক্সিনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বাজারে থাকা প্যাকেটজাত দুধের ৩১টি নমুনার ৬৬-৮০ শতাংশে বিভিন্ন অণুজীব, ৩০ শতাংশে একইভাবে মানুষের শরীরের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি মাত্রার টেট্রাসাইক্লিন, একটিতে বেশি মাত্রার সিসা, কয়েকটিতে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ও এনরোফ্লোক্সাসিন পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ৩৩টি দুগ্ধজাত দইয়ের নমুনায় ৬১ শতাংশের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অণুজীব ও একটিতে সিসা পাওয়া গেছে। গত ১০ ফেব্রুয়ারি সরকারের জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের গবেষণালব্ধ ফল প্রকাশ করে।
গত বছরের ১৬ মে আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) আরেক গবেষণার ফলে জানানো হয়, দেশের বাজারে থাকা পাস্তুরিত দুধের নমুনার প্রায় ৭৭ শতাংশে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা উচ্চমাত্রায় পাওয়া যায়। এ ছাড়া ৩৭ শতাংশ নমুনায় কলিফর্ম এবং ১৫ শতাংশ নমুনায় মলবাহিত কলিফর্ম ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়।
আইসিডিডিআরবির ফুড মাইক্রোবায়োলজি ল্যাবরেটরির ড. মোহাম্মদ আমিনুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ওই গবেষণা চালানো হয়।
সব শেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের শিক্ষক ও বায়োমেডিক্যাল রিসার্সের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এক গবেষণায় বাজারে থাকা সাতটি পাস্তুরিত ও তিনটি অপাস্তুরিত দুধের নমুনায় ‘ফ্যাট ইন মিল্ক’ পাওয়া গেছে ৩.৬ থেকে ৩.৬১ শতাংশ। অথচ থাকার কথা ৩.৫ শতাংশ। ওই সব দুধে প্রচুর পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। পাস্তুরিত দুধের সব কটিতে মানুষের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক লেভোফ্লক্সাসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও এজিথ্রোমাইসিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এ ছাড়াও রয়েছে ফরমালিন ও ডিটারজেন্টের উপস্থিতি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বাজারে প্রচলিত ১১টি ফ্রুট ড্রিংকসের সব কটিতে নিষিদ্ধ ক্ষতিকর সাইক্লামেটের উপস্থিতি মিলেছে। মাত্র এক বছরের মধ্যে বড় ওই তিনটি গবেষণায় দেশের মানুষের পুষ্টির চাহিদা পূরণের সবচেয়ে বড় উপাদান দুধে মানুষের জন্য ক্ষতিকর উপাদান পাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সম্প্রতি আদালতে দাখিল করা এক প্রতিবেদনে বিএসটিআই জানিয়েছে, তাদের পরীক্ষায় দুধের মধ্যে ক্ষতিকর কিছু নেই। এ নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই মানুষের মধ্যে দেখা দেয় বিভ্রান্তি।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের কোনো কোনো শিক্ষক বিবৃতি দিয়ে গবেষণা থেকে নিজেদের দায়মুক্তি নিয়েছেন। কোনো কোনো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন দিয়ে নিজেদের পণ্য নিরাপদ বলে দাবি করেছে।
অন্যদিকে বিএসটিআই ছাড়া অন্য তিন গবেষকের কেউ আদালতে কেউবা গণমাধ্যমে জোর দিয়েই দাবি করেছেন, তাঁদের গবেষণা প্রয়োজনীয় সব প্রটোকল মেনে ও মানসম্পন্নভাবে করা হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ কিভাবে বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি পাবে জানতে চাইলে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘আমরাও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। এ ক্ষেত্রে যেহেতু আমাদের দেশ এখনো উন্নত বিশ্বের চেয়ে কিছু দিক থেকে পিছিয়ে আছে তাই আপাতত শঙ্কিত না হয়ে কিংবা দুধ খাওয়া বন্ধ না করে বরং যতটা সম্ভব নিরাপদ দেখে এই দুধই খেতে হবে।’ তিনি বলেন, এমন অবস্থায় যারা দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে তাদেরকে আরো সতর্কতা ও নিরাপদ পন্থা অবলম্বন করা জরুরি। পাশাপাশি গবেষকদেরও জনস্বার্থের দিকগুলো আরো সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় রাখলে মানুষ কম বিভ্রান্তিতে পড়বে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, ‘আমরা সব নিয়ম মেনে গবেষণা করে যা ফল পেয়েছি তাই প্রকাশ করেছি। এতে করে আমরা মানুষের মধ্যে শঙ্কা নয়, বরং মানুষকে সচেতন করার এবং যারা দুধ উৎপাদন ও বাজারজাত করে তাদেরকে সতর্ক করা হয়েছে মাত্র। অন্যদিকে গতকালও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের চারটি বিভাগের চারজন চেয়ারম্যানের নামে এক যৌথ প্রতিবাদলিপিতে জানানো হয়েছে আ ব ম ফারুকের গবেষণাটি তাঁর ব্যক্তিগত, তাঁরা এ জন্য কোনো দায় নেবেন না। এর আগে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য গবেষণাগারের কারিগরি ব্যবস্থাপক অধ্যাপক ডা. শাহনীলা ফেরদৌস গণমাধ্যম ও হাইকোর্টে জোরালোভাবেই বলেছেন, তাঁদের ল্যাবটি বিশ্বমানের। আর গবেষণাও হয়েছে সব প্রটোকল অনুসরণ করেই। ফলে এটা নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী বলেন, ‘গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি ও জনবল দক্ষ হলে কখনো গবেষণার ফল নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে না। তবে নানা কারণে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সেই সঙ্গে একই বিষয়ে একেক প্রতিষ্ঠানের গবেষকরা একেক ধরনের রিপোর্ট দিলে তো মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে এসব গবেষণাপ্রতিষ্ঠানকে আরো উন্মুক্ত হওয়া উচিত। বিশেষ করে এসব প্রতিষ্ঠানে কেবল গবেষক-বিজ্ঞানী নয়, তাঁদের সঙ্গে অন্য পেশার মানুষদেরও সম্পৃক্ত রাখা উচিত, যাতে করে ওই প্রতিবেদনের আগাম পর্যালোচনার সুযোগ থাকবে । এর মধ্য দিয়ে কোনো গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ পেলে তার গ্রহণযোগ্যতা আরো বেশি হবে এবং বিভ্রান্তির সুযোগও কমে যাবে।’