লক্ষ্যমাত্রার ২৫ ভাগ ধান সংগ্রহ

সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-০৭-০৮ ১১:২৮:১৭


দেশজুড়ে গত ২৫শে এপ্রিল থেকে ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে ।এই অভিযান চলবে ৩১শে আগস্ট পর্যন্ত। এই সময়ে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৩ লাখ টন। এর মধ্যে গত আড়াই মাসে ৮৫ হাজার ৫০১ টন ধান সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। যা লক্ষ্যমাত্রার ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে ১১ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে সংগ্রহ হয়েছে ৬ লাখ ৭১ হাজার টন বা প্রায় ৬১ শতাংশ। সরকার চালকলের মালিকদের সঙ্গে চুক্তি করে ধান-চাল সংগ্রহ করছে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে। কিন্তু প্রভাব পড়ছে না বাজারে।

দেশের ধান উৎপাদনের প্রধান চার জেলার ধান-চালের বিভিন্ন হাটেও একই অবস্থা বিরাজ করেছে। বর্তমানে এসব বাজারে মণপ্রতি ধান বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৬০০ টাকায়।

এদিকে ধান-চালের দাম বাড়াতে সরকারের নেয়া এক গুচ্ছ উদ্যোগ এখনো কাজে আসেনি। এছাড়া ধানের ন্যায্যদাম নিশ্চিত করতে প্রায় ১০ লাখ টন চাল রপ্তানির ঘোষণা দেয়া হয়। এই ঘোষণায় শুরুতে দর সামান্য বাড়লেও তা স্থায়ী হয়নি। বরং গত এক সপ্তাহে ধান-চালের দাম আরো ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত কমেছে।

একই সঙ্গে ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতিকেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৮ টাকায়। যা গত এক বছরের চেয়ে ১০-১৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এতে উৎপাদন খরচের সঙ্গে বাজারমূল্যের সমন্বয় না হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন প্রান্তিক চাষী। কৃষকরা ধান উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে দীর্ঘমেয়াদে চালের বাজারে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জানা গেছে, উৎপাদন খরচের প্রায় অর্ধেক দামে ধান বিক্রি হওয়ায় সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। পরে বিভিন্ন পদক্ষেপের ঘোষণা দিয়েছিল। ব্যবসায়ীরাও সরকারকে চিঠি দিয়ে বলেছিল, সেদ্ধ চাল রপ্তানির অনুমতি দিলে তারা বিপুল পরিমাণে চাল রপ্তানি করবে। এতে চালকল মালিকরা বাজার থেকে ধান কেনা বাড়িয়ে দেবে। এতে ধানের দাম বাড়বে। কিন্তু ঘোষণার আড়াই মাস পার হলেও তা কার্যকর হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলেন, গেল কয়েক বছরে চাহিদার চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হলেও এখনো চাল রপ্তানিতে যেতে পারেনি বাংলাদেশ। বাম্পার ফলনে খুশির বদলে লোকসানে দেশের কৃষকের মুখ মলিন। সরকারি ধান-চাল সংগ্রহে জটিলতা, মিল মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে কৃষকদের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে তারা মনে করেন।

কৃষকদের অভিযোগ, সরকার দাম নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে সেই দামে তাদের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে না ধান। ফলে বাধ্য হয়েই কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ধানের দাম আরও কমার পেছনে বেশকিছু স্থানে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী বলে মনে করছেন অনেকেই।

এক অনুষ্ঠানে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা কৃষকের কাছ থেকে আরো আড়াই লাখ টন ধান কিনব। প্রয়োজনে সংগ্রহের পরিমাণ আরো বাড়বে। এর আগে দেড় লাখ টন ধান সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল জানিয়ে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, বোরো ধান-চাল সংগ্রহ কর্মসূচি আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত চলবে।

বাংলাদেশ কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাম্পার ফলনে এবার দেশে ধান উৎপাদনের পরিমাণ ৩ কোটি ৬২ লাখ টনে পৌঁছেছে। মোট ধান উৎপাদন হবে ৩ কোটি ৫০ লাখ থেকে ৫৫ লাখ টন। এর মধ্যে বোরো উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৯৪ লাখ টন। এছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয় কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করবে ১ লাখ ৫০ হাজার টন এবং চাল সংগ্রহ করবে ১০ লাখ ৫০ হাজার টন।

গত এক বছরের মধ্যে মোটা চালের দাম এখন সবচেয়ে কম। জাত ও মানভেদে রাজধানী ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতিকেজি মোটা চাল ৩৪-৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও এক বছর আগে এই চাল কিনতে একজন ভোক্তাকে গুণতে হয়েছে ৪৮-৫২ টাকা পর্যন্ত।

সরকারী সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, গত এক বছরে নাজিরশাইল ও মিনিকেটের মতো সরু চালের দাম কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। মাঝারি মানের পাইজাম ও লতার দাম হ্রাস পেয়েছে ১০ শতাংশ। মোটা চাল হিসেবে খ্যাত স্বর্ণা ও চায়না ইরির দাম কমেছে প্রায় ১৬ শতাংশ। বর্তমান প্রতিকেজি নাজিরশাইল উত্তম মানের চাল ৫২-৫৬, সাধারণ নাজির ও মিনিকেট ৪৮-৫২, মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা ৪৮-৫০ এবং মোটা চাল ৩৪-৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে।

চালের দাম সামাল দিতে খাদ্য মন্ত্রণালয় সেই সময় ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের অন্যান্য সোর্স থেকে চাল আমদানি করে। এরই মধ্যে বোরো মৌসুমে ধানের বাম্পার ফলনের ফলে দেশে এখন পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ হয়েছে।

খাদ্যমন্ত্রণালয় জানান, খাদ্যশস্যের মজুত সন্তোষজনক। মাসিক চাহিদা ও বিতরণ পরিকল্পনার তুলনায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। এ মুহূর্তে খাদ্যশস্যের কোন ঘাটতি নেই বা ঘাটতির কোন সম্ভাবনা নেই।

এদিকে চলতি মৌসুমে উৎপাদিত বোরো ধানের দাম অস্বাভাবিক হারে কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহলের দাবির প্রেক্ষিতে রপ্তানির বিষয়টি সামনে আসে। চালের একটি বড় অংশ আমদানি করা হয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত থেকে। কিন্তু ধানের বাম্পার ফলনে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ধান এখন দেশে মজুদ হয়েছে। এ কারণে খুচরা পর্যায়ে ধানের দাম কমে গেছে। দেশের বেশিরভাগ জায়গায় উৎপাদন খরচের তুলনায় কম দামে ধান বিক্রি হয়েছে। প্রান্তিক কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

এদিকে দেশের প্রধান কয়েকটি ধান-চালের বাজার এলাকা থেকে জানা গেছে, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, বগুড়া ও মৌলভীবাজার জেলার বিভিন্ন হাটে ধানের দাম গত এক সপ্তাহে প্রতি মণে ৫০ থেকে ৭০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। পাশাপাশি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান চলছে ধীর গতিতে।

কুষ্টিয়ায় সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান ক্রয়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলেও চালে হয়নি। গত অর্থবছরে (২০১৮-২০১৯) ৩০জুন পর্যন্ত (২৬ টাকা কেজি দরে) দুই হাজার ৭৩০ টন ধান কিনেছে জেলা খাদ্য অফিস। অপরদিকে ২৭ হাজার টন চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও (৩৬ টাকা কেজি দরে) ২৪ হাজার টন চাল কিনতে পেরেছেন তারা। সরকারকে চাল সরবরাহে মিলারদের অনাগ্রহই এর মূল কারণ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি অতিরিক্ত ১ হাজার ৭০০ টন ধান ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছে জেলা খাদ্য অফিস সূত্র।

এদিকে জেলায় ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই হাজার ৭৩০ টন। এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের পর আরো এক হাজার ৭০০ টন ধান ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে বলে জানান তিনি।

জেলা চালকল মালিক সমিতির সাধারন সম্পাদক জয়নাল আবেদিন প্রধান বলেন, সরকারি গোডাউনে চাল সরবরাহে মিলারদের অনাগ্রহের বিষয়টি ঠিক নয়।

বগুড়া প্রতিনিধি জানান, বগুড়ার ধানচাষীদের কান্না এখনও থামেনি। তারা এখনও ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। সরকার ধানের মূল্য ১০৪০ নির্ধারণ করে দিলেও কৃষক তার কিছুই পাচ্ছে না। ফলে বিপাকে পড়েছে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও কৃষকরা। এদিকে বাজারে চালের দাম স্থিতিশীল থাকলেও ধানের দাম কমেছে।

বগুড়ার বাজারে বর্তমান ধানের মূল্য মিনিকেট ৭২০-৭৩০ টাকা, নাজির শাইল ৫০০ থেকে ৫১০ টাকা, বীনা-৭ঃ ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা, আটাশ ও উনত্রিশ ৬২০ থেকে ৬৩০ টাকা প্রতি মণ। গত ১০ দিনে মণ প্রতি ধানের দাম প্রকার ভেদে কমেছে ১০ থেকে ২০ টাকা।

বর্তমান বাজারে চালের মূল্য জিরাশাইল ১১৫০-১২০০ টাকা। আটাশ চাল ১০৫০-১১০০ টাকা। স্বরণা-৫ ৯৫০-১১০০ টাকা। উনত্রিশ ১০০০-১০২০ টাকা। কাটারিভোগ ১৪০০-১৪৫০ টাকা। লাল পাইজাম ১৫৫০-১৬০০ টাকা। গত ১০ দিনে প্রকারভেদে চালের দাম ৪০ থেকে ৫০ টাকা কমেছে।

দুপচাঁচিয়া চালকল মালিক সমিতির নেতা আবুল কালাম আজাদ জানান, চালের এই বাজারমূল্যে চাষীরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তেমনিভাবে আমাদের মতো ক্ষুদ্র মিল মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।