পিপলস লিজিং বন্ধের উদ্যোগ বাংলাদেশ ব্যাংকের

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০১৯-০৭-১০ ১১:৪১:২৭


আমানতকারীদের টাকা কোনোভাবে ফেরত দিতে পারছে না আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড।বিভিন্ন রকমের  অনিয়ম, বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণ এবং চরম অর্থ সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে। এসব কারণে এই প্রতিষ্ঠানটিকে বন্ধ করতে চাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরইমধ্যে সরকারের সম্মতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দেওয়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগও নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রতিষ্ঠানটির আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় যা যা করা দরকার বাংলাদেশ ব্যাংক তার সব উদ্যোগই নিচ্ছে।

জানা গেছে, প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার আমানত ফেরত পাচ্ছেন না আমানতকারীরা। এমন অবস্থায় আর্থিক এই প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে আমানতকারীদের এক টাকাও ফেরত পাওয়ার কোনও বিমা নিশ্চয়তা নেই। কারণ, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতের বিপরীতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে কোনও আমানত বিমা নেই। যার ফলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হতে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত, আমানতকারীর অর্থ ফেরতসহ দায়-দেনা কীভাবে মেটানো হবে, তা আদালতের আদেশে নির্ধারিত হবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে কোনও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অবসায়নের উদ্যোগ এটাই প্রথম।

সূত্র জানায়, পিপলস লিজিংয়ের অবসায়নের বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির চিঠি দিলে গত সপ্তাহে তাতে সম্মতি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগ প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তারা প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের আমানতের পরিমাণ, অনিয়ম, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ও তাদের বেতন-ভাতার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজ শুরু করেছে।

তবে আর্থিক এই প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠনের চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন পিপলস লিজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামি হুদা। তিনি বলছেন, আমরা প্রতিষ্ঠানটিকে পুনর্গঠনের জন্য গত তিন বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। শেয়ার বিক্রি করার চেষ্টা চলছে। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ৬০০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহের প্রস্তাব দিয়েছি। এই তহবিল পাওয়া গেলে সব সমস্যার সমাধান হবে বলেও মন্তব্য তার।

আমানতকারীদের কী হবে ?

জানা গেছে, যদি প্রতিষ্ঠানটির অবসায়ন করা সম্ভব হয়, তবে আর্থিক খাতের এই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে। প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনায় নিয়োগ হবেন একজন অবসায়ক (লিকুইডেটর)। আমানতকারীরা যাতে তাদের জমানো টাকা ফেরত পায় সে জন্য গঠন করা হবে দীর্ঘমেয়াদি স্কিম।  সংশ্নিষ্টরা বলছেন, অবসায়ন হওয়া প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীর অর্থ কোন উপায়ে ফেরত দেওয়া হবে, সে বিষয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই। তবে আদালত যে উপায়ে অর্থ পরিশোধ করতে বলবেন, সেভাবেই কার্যকর হবে। সাধারণত, সম্পদ বিক্রি এবং সরকারের সহায়তার আলোকে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়া হয়।

তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের আমানতকারীদের সুরক্ষায় ‘ব্যাংক আমানত বীমা’ নামে একটি তহবিল থাকলেও নন ব্যাংক তথা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের সুরক্ষায় কোনও তহবিল নেই। যদিও ব্যাংকের পাশাপাশি ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের জন্য আমানত বিমা চালুর জন্য ২০১৪ সালে মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এখন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের জন্য আমানত বিমা চালু করা সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, ব্যাংকের মতোই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের সুরক্ষায় আমানত বিমা থাকা জরুরি। পাশাপাশি ব্যাংকের আমানত বিমার পরিমাণও বাড়ানো দরকার।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ব্যাংক আমানত বিমা নামে একটি তহবিল আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের জন্য আলাদা আমানত বিমা থাকা দরকার ছিল। এখন সময় এসেছে আমানত বিমা তহবিল সংস্কার করা। কারণ, এখন অনেকগুলো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া পর্যায়ে রয়েছে।

যে কারণে দেউলিয়ার পথে পিপলস লিজিং?

২০১০ সাল পর্যন্ত পিপলস লিজিং ভালোই চলছিল। তবে এর পর থেকেই তদারকি দুর্বলতা ও পরিচালকদের অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটি এখন দেউলিয়ার পথে। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পরিদর্শন প্রতিবেদনে উঠে আসে, পিপলস লিজিং থেকে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালকরা বিতরণ করা ঋণের অধিকাংশই জালিয়াতির মাধ্যমে তুলে নিয়েছেন।

ভুয়া কাগজ তৈরি করে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটায় প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালকরা। সেই ঘটনায়  ২০১৫ সালে পাঁচ পরিচালককে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে শুধু প্রতিষ্ঠানের নামে জমি কেনার কথা বলে নিজ নামে জমি রেজিস্ট্রি করার ঘটনায় আত্মসাৎ হয় প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকা। জমি রেজিস্ট্রির এ জালিয়াতির মাধ্যমে সাবেক চেয়ারম্যান মতিউর রহমান ১১৬ কোটি টাকা, সাবেক পরিচালক খবির উদ্দিন মিয়া ১০৭ কোটি টাকা, আরেফিন সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন ও হুমায়রা আলামিন ২৯৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন মর্মে ওই সময় দুর্নীতি দমন কমিশনে ( দুদক) প্রতিবেদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটি থেকে পরিচালক সামসুল আলামিন, নার্গিস আলামিন, হুমায়রা আলামিন ও খবির উদ্দিনকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর  তৎকালীন চেয়ারম্যান এম মোয়াজ্জেম হোসেন স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন।

১৯৯৭ সালের আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পিপলস লিজিংকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ডিসেম্বর শেষে প্রতিষ্ঠানটির আমানত ছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩০০ কোটি টাকায় বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের। আর ৭০০ কোটি টাকা রেখেছে প্রায় ৬ হাজার সাধারণ গ্রাহক।  পিপলসের ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপিই ৭৪৮ কোটি টাকা। ২০১৫ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি অব্যাহতভাবে লোকসান গুনছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয় রাজধানীর মতিঝিলে। এছাড়া গুলশান ও চট্টগ্রামে দুটি শাখা রয়েছে।