টাস্কফোর্সের গতি নেই বিদেশি কর্মী শনাক্তে
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০১৯-১০-০৬ ১২:৫৫:৫৬
দেশে বিদেশি কর্মী শনাক্তে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠিত টাস্কফোর্সের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে। ৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে টাস্কফোর্স নামকাওয়াস্তে দু-একটি প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালালেও তথ্য ভাণ্ডারের (ডাটাবেজ) কাজ শেষ করতে পারেনি। এমনকি বিমানবন্দরগুলোতে বিদেশি কর্মীদের জন্য আয়কর বুথ চালুর কথা থাকলেও সেটি পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করেনি। বর্তমানে টাস্কফোর্সের কার্যক্রম প্রায় বন্ধ রয়েছে।
জানা গেছে, ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এনবিআরে অনুষ্ঠিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিদেশিদের কর ফাঁকি অনুসন্ধানে টাস্কফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এনবিআরের তৎকালীন চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ওই সভায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব, বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), পুলিশের এসবি, ডিজিএফআই, এনএসআই, বাংলাদেশ ব্যাংক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেপজা, পাসপোর্ট অধিদফতর, এনজিও ব্যুরো ও এফবিসিসিআইয়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। এ টাস্কফোর্সের কাজ ছিল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে কর ফাঁকিবাজ বিদেশিদের চিহ্নিত এবং কর্মরত বিদেশিদের ডাটাবেজ তৈরি করা।
বর্তমানে বাংলাদেশে কত বিদেশি কর্মী কাজ করছেন, তার সঠিক তথ্য সরকারের কোনো সংস্থার কাছে নেই। এনবিআরে বিদেশি প্রায় ১৩ হাজার কর্মী রিটার্ন জমা দেন। ঢাকার কর অঞ্চল-১১ তে প্রায় ১১ হাজারের মতো বিদেশি রিটার্ন জমা দেন। এর বাইরে চট্টগ্রামে কিছু রিটার্ন জমা পড়ে। বিডার তথ্য মতে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত দেশে বিদেশি শ্রমিক ছিল প্রায় ২৩ হাজার ৮৫৪ জন। এর মধ্যে শিল্প অধিশাখায় নতুন এবং মেয়াদ বৃদ্ধিসহ মোট ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে ১৪ হাজার ৯১ জনের। আর বাণিজ্য অধিশাখায় নতুন এবং মেয়াদ বৃদ্ধিসহ মোট ওয়ার্ক পারমিট রয়েছে ৯ হাজার ৭৬৩ জনের। অন্যদিকে গত বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, দেশে মোট ৮৫ হাজার ৪৮৬ জন বিদেশি নাগরিক কাজ করছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৫ হাজার ৩৮৬ জন ভারতের নাগরিক।
নিয়মানুযায়ী, বাংলাদেশে বৈধভাবে কাজ করতে হলে বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) অনুমতি নিতে হয়। এর বাইরে এনজিও ব্যুরো ও বেপজা বিদেশিদের কাজের অনুমতি দিয়ে থাকে। বিদেশিদের হয়ে তাদের নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অনুমতি নেয়ার কাজ করে থাকে। ক্যাসিনো ইস্যুতে নেপালিদের বাংলাদেশে অবস্থানের ঘটনায় আবারও বিদেশি কর্মীদের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, অধিকাংশ বিদেশি কর্মী বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে টুরিস্ট ভিসা ব্যবহার করেন। এরপর বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছেন। এনজিও, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, প্রকৌশল, চিকিৎসা, গার্মেন্ট, মার্চেন্ডাইজিং, পরামর্শকসহ নানা পেশায় তারা কাজ করছেন। অনেক ক্ষেত্রে বিদেশিদের বেতন-ভাতা গোপন রাখা হচ্ছে। কারণ বিদেশিদের আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ আয়কর ধার্য আছে। মূলত কর ফাঁকি দিতেই এ কৌশল অবলম্বন করছে দেশীয় নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি গোপন চুক্তি অনুযায়ী বেতন-ভাতা পরিশোধ করতে মানি লন্ডারিংয়ের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে। এতে বিপুল পরিমাণ মুদ্রা পাচার হচ্ছে।
কার্যক্রম বন্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করে ট্যাক্স লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্টের সদস্য হাফিজ আহমেদ মুর্শেদ বলেন, এখন টাস্কফোর্সের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। এজন্য অবশ্য ইমিগ্রেশনের অসহযোগিতাকে দায়ী করেন তিনি। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, অবৈধভাবে বিদেশিদের নিয়োগ দিলে জেল-জরিমানার বিধান আছে। কোনো ব্যক্তি বা ব্যবসায়ী যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বিদেশীদের নিয়োগ দিলে নিয়োগদাতা হিসেবে ওই ব্যক্তিকে সর্বনিম্ন তিন মাস থেকে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড অথবা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আর্থিক দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
শৃঙ্খলা আনতে বিডার নতুন উদ্যোগ : ১৭ সেপ্টেম্বর বিডার পরিচালক আরিফুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কাজের অনুমতি ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো বিদেশি কমর্রত থাকলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সেবা বন্ধ করে দেয়া হবে। এছাড়াও নির্দেশনায় একটি ছক তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানে বিদেশি কর্মীর সংখ্যা, কাজের অনুমতি আছে এমন বিদেশি কর্মীর সংখ্যা, অনুমতি ছাড়া কাজ করছেন এমন কর্মীর সংখ্যা এবং কাজের অনুমতি গ্রহণ না করার প্রেক্ষিতে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কিনা সে বিষয়ে তথ্য দিতে বলা হয়েছে। বিডা বিদেশিদের ভিসা সুপারিশ, কাজের অনুমতি পাওয়া, কাজের অনুমতির মেয়াদ বাড়ানো, সংশোধন ও বাতিল সংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে।
তৈরি পোশাক খাতে বিদেশি কর্মী ১৭৭ জন : এদিকে তৈরি পোশাক খাতে কী পরিমাণ বিদেশি কাজ করে তা জানতে সম্প্রতি বিজিএমইএ থেকে একটি জরিপ চালানো হয়। বিজিএমইএর বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেয়ার পর ২৯ এপ্রিল পোশাক কারখানায় কর্মরত বিদেশিদের সংখ্যা জানতে চেয়ে সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিঠি দেয়। এরপর কয়েক দফা তাগিদ দেয়ার পর ৪ হাজার ৫৬০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৫২টি পোশাক কারখানা তথ্য সরবরাহ করে। এতে দেখা গেছে, ৫২টি পোশাক কারখানা কাজ করেন ১৭৭ জন বিদেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভারতীয়।
বিমানবন্দরে আয়করের বুথ বন্ধ : ২০১৬ সালের জুলাইয়ে টাস্কফোর্সের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দেশের ৩টি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও একটি স্থলবন্দরে আয়কর বুথ চালু করা হয়। ঢাকার হযরত শাহজালাল, চট্টগ্রামের শাহ আমানত, সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরে আয়কর বুথে সহকারী কর কমিশনার পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়া হয়। এসব বন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগের আগে বিদেশিদের আয়কর প্রত্যয়নপত্র দেখানোর বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু এখন সেই বুথগুলো বন্ধ রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্স ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দেশে কর্মরত বিদেশি কর্মীদের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের যথেষ্ট সুযোগ আছে। এর সঙ্গে অর্থ পাচারের বিষয়ও জড়িত। এনবিআর যথাযথভাবে উদ্যোগ নিলে ট্যাক্স আদায় ও অর্থ পাচার দুটোই বন্ধ করা সম্ভব। কিন্তু এনবিআর সেটি করতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, যারা বাংলাদেশে আসেন তারা সঠিক ঠিকানা দেন না। তাই সেই ঠিকানায় খুঁজে বিদেশি কর্মী পাওয়া যাবে না। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে বিদেশি কর্মী শনাক্ত করতে হবে।
সানবিডি/ঢাকা/যুগান্তর/এসএস