ফাঁসি: শাস্তি নাকি পাপমুক্তি?
আপডেট: ২০১৫-১১-২৪ ১০:৫৪:৫৩
প্রথম আলোতে পড়ছিলাম বিএনপির নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী ও জামায়াতের নেতা আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদের ফাঁসি নিয়ে। একটা বিষয়ে চোখ আটকে যায় পড়ার সময়। আটকে যায় মনও। উপরে করা প্রশ্নটা মনে ঘুর পাক খায়। যে অংশ পড়ে মনে এমন প্রশ্ন জাগে সেই অংশাটা আগে লিখে দেই:
“কারাগার মসজিদের পেশ ইমাম মনির হোসেন তাঁদের দুজনকেই তওবা পড়াতে যান। কিন্তু তাঁরা দুজন নিজেরাই তওবা পড়তে চান বলে জানান। তখন পেশ ইমাম বলেন, রীতি অনুযায়ী তাঁদের তওবা পড়তে হবে। পরে তাঁরা তওবা পড়েন” – প্রথম আলো
প্রথমেই বলে নিচ্ছি যে আমি ব্যক্তগতভাবে ফাঁসির বিরুদ্ধে। যে জীবন মানুষ দিতে পারে না, তার নেয়ার ভারও মানুষের গ্রহণ করা ঠিক না। তাছাড়া একটা জীবন নেয়ার সাথে অসংখ মানুষের অধিকার হরণ হয়। সে যদি অন্যায়কারী হয় তাহলে তার একার শাস্তি হওয়া উচিত, তার পরিবারের অন্যদের কেন শাস্তি দেয়া হবে? বরং তার যদি একই অপরাধ করার প্রবণতা থাকে তাতে করে যাতে সে এই অপরাধ আর না করতে পারে সেজন্য তার কারাবাসকে আজীবনের জন্য করা যেতে পারে। আর যদি তাকে অপরাধী মনে করে ভুলবশত সাজা দেয়া হয়, ফাঁসির মতো শাস্তির পরে মানুষটিকে আর কিছুতেই ফিরিয়ে দেয়া যায়না।
সে যাই হোক এ লেখা আমার মতামত নিয়ে নয়। আমার জিজ্ঞাসা নিয়ে। প্রথম আলোর নিউজের উপরের অংশটা পড়ে আমার মনে এই প্রশ্ন এসেছে যে- এই যে ফাঁসি দেয়া হয় এটা আসলে কার জন্য? এটা কি যিনি অপরাধ করেছেন তাকে পাপ মুক্ত করার জন্য নাকি তিনি যে অপরাধ করেছেন তার জন্য তার শাস্তি হিসাবে দেয়া হয়, নাকি অন্য কিছু যেমন যাদের আপন জনের উপরে তিনি অপরাধ করেছেন তাদের চোখের শান্তির বা মনের তৃপ্তির জন্য?
যদি শাস্তি দেয়াই কারন হয়, তাহলে কেন তাকে তওবা পড়াতে হবে? তওবা তো পাপ মুক্তির জন্য, শাস্তির জন্য না। আর ফাঁসি যদি শেষ শাস্তি হয় তাহলে পাপ মুক্তিতো হয়েই গেলো আলাদা করে তওবার কি আছে? বিশেষ করে একজন বিশেষ ব্যক্তির মাধ্যমে কেন পড়তে হবে? তিনি কি তওবা কবুলের কোন গ্যারান্টি? আর শাস্তির জন্য যদি ফাঁসি দেয়া হয়, তাহলেতো তওবা তেমন যায়ওনা। কারন, একজনকে যদি দশ খুনের জন্য সাজা দেয়া হয়, তাকে একবার ফাসি দেয়া যেতে পারে, বাকী নয় খুনের শাস্তি না হয় ওপারে উপরওয়ালা দিয়ে দিবেন। তওবা করিয়ে যদি মাপই নিয়ে দেয়া হয়, তাহলে বাকী সাজা কিভাবে দেয়া হবে তাকে?
আর যদি শাস্তি অপরাধের দায় মুক্তির জন্য হয়, তাহলেতো যিনি মারা গেছেন তাকে সন্মানের সাথে দেখা উচিত, কারন মানুষ হিসাবে আমরা সবাই কম বেশি পাপের কাজ করি। কেউ বেশি করি, কেউ কম করি। কেবল কিছু মানুষদের এই সুবিধার আওতায় আনা হয়েছে যে তাদের পাপের ফল দুনিয়াতেই শেষ করা হয়েছে। তাহলে তাদের মরদেহওতো সন্মান পাওয়ার যোগ্য। যখন আমাদের মরদেহ আমাদের পাপ নিয়ে কবরে যাচ্ছে তখন কিছু মানুষের শরীর পাপ দুনিয়াতে ঝেড়ে যাচ্ছে! তারতো তাহলে নিষ্পাপ মানুষ। তাদেরতো আর সমালোচনাও করা যাবেনা!
আর যদি ফাঁসির মতো সাজা কেবল এ কারনে দেয়া হয় যে যাদের উপর জুলুম করা হয়েছিলো তাদের পরিবার খুশি হবে- তাহলে কি সেই পরিবারের অপরাধ প্রবনতাকে উসকে দেয়া হয়না? অন্যের উপর অত্যাচারে যার সন্তুষ্টি সে ইতো আসল অপরাধী। একজন তার অপরাধ প্রবনতার জন্য শাস্তি পাচ্ছে আর আরেকজনকে তাদের অপরাধ প্রবনতার খোরাক যুগিয়ে দেয়া হচ্ছে এটা কেমন যেন হলোনা?
ফাঁসির আরেকটা বিষয় আমার কাছে মন্দ জ্ঞান হয়- ফাঁসির জল্লাদ সব সময় অন্য কোন খুনের আসামী হতে হবে। কেন ভাই? যে লোকটা একটা খুন করার কারনে যাবত জীবন জেলে পরে আছে কেন তাকে দিয়ে সেই একই অপরাধ আবার করানো হবে? যেখানে সে তার কাজের জন্য অনুসোচনা করছে, সে একই কাজকে তার জন্য কেন ভালো এবং পুরুস্কার উপযোগী করে দেখানো হচ্ছে? এটা আমার মনে হয় অনৈতিক। খুবই অনৈতিক।
আরেকটা বিষয় মনে হলো। তা হলো যে জাজ কোন ক্যাপটাল পানিশমেন্ট দিবে সেই জাজকে সেই সাজা পুরনের সময় সামনে রাখতে হবে। তার এক কথায় এক জীবন নিশেষ হয়ে যেতে পারে এই জিনিসটা তাকে দেখতে দিতে হবে। অথবা অন্য উঠতি জাজাদের জাজ জীবনের শুরুতেই এ দৃশ্য দেখাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। অথবা প্রতিজন জাজকে দায়ীত্ব দেয়ার আগে ফাঁসির ডকুমেন্টারী দেখাতে হবে। মৃত্যু রায় দেয়ার যার পাওয়ার আছে তার এর যন্ত্রনা বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে। তবেই কেবল কিছুটা হলেও মানবিক বিচার সম্ভব হবে।