আইসিজে’র রায়কে কটাক্ষ করছে মিয়ানমার
আন্তর্জাতিক ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০১-২৫ ০৯:৪৭:২১
২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর ব্যাপক নির্যাতন চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী।এর বিচার দাবি করে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করে গাম্বিয়া। জেনোসাইড বা গণহত্যা থেকে রোহিঙ্গাদের রক্ষায় আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের (আইসিজে) অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘসহ অনেক দেশ ও সংস্থা। আইসিজেতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদনের বিরোধিতাই শুধু নয়, গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকার নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল মিয়ানমার। আইসিজেতে হেরে মিয়ানমার অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাসংক্রান্ত আইসিজের আদেশের প্রতিই কটাক্ষ করেছে।
গত বৃহস্পতিবারের সেই আদেশের প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, “আমাদের সবার জানা উচিত, ‘প্রভিশনাল মেজার্স’ (অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা)-এর অন্যতম ঐতিহাসিক কাজ হলো মামলার শুরুতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে এমন সম্ভাব্য অভিযোগ থেকে আদালতকে সুরক্ষা দেওয়া।”
মিয়ানমারের বিবৃতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মিয়ানমার বোঝাতে চাইছে যে আইসিজে তার সম্ভাব্য দায় এড়াতেই ‘অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা’ নেওয়ার আদেশ দিয়েছে। আইসিজের আদেশ উদ্ধৃত করে মিয়ানমার বলেছে, এই রায়ের সঙ্গে মূল মামলার আবেদনের স্বীকৃতি বা গ্রহণযোগ্যতার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
মিয়ানমার তার বিবৃতিতে আইসিজের আদেশ আমলে নেওয়ার কথা বলেছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমার গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছে, মিয়ানমারে কোনো গণহত্যা হয়নি। যুদ্ধাপরাধ হয়ে থাকতে পারে। আর সেসব অপরাধের বিচার মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থায়ই করা হবে।
মিয়ানমার আরো বলেছে, মামলার যোগ্যতা বিচার করে আদালতের সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মিয়ানমারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তথ্য-উপাত্ত ছাড়াই কিছু মানবাধিকার গোষ্ঠী মিয়ানমার পরিস্থিতির বিভ্রান্তিকর চিত্র তুলে ধরে নিন্দা জানিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে বেশ কিছু দেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের ওপর। এসব কারণে রাখাইনে টেকসই উন্নয়নে মিয়ানমার সরকারের সক্ষমতার ভিত্তিও ব্যাহত হচ্ছে।
গত নভেম্বর মাসে গাম্বিয়া আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক সনদ লঙ্ঘন এবং রোহিঙ্গা গণহত্যা চালানোর অভিযোগ আনে। সেই মামলায় রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী আদেশ দেওয়ার অনুরোধ করেছিল গাম্বিয়া।
মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে কি না সে প্রশ্নে শুনানি শুরু হয়নি এখনো। গত ডিসেম্বরে আইসিজেতে শুনানি হয়েছে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার বিষয়ে। গত বৃহস্পতিবার আইসিজের আদেশে বলা হয়নি যে মিয়ানমারে গণহত্যা হয়েছে। তবে মিয়ানমারে গণহত্যা হচ্ছে এবং অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা গণহত্যার প্রবল ঝুঁকিতে আছে বলে গাম্বিয়ার অভিযোগ এবং জাতিসংঘের স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদনসহ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ও মানবাধিকার পরিষদের এসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো আইসিজে আমলে নিয়েছে। মিয়ানমার ওই প্রতিবেদন ও প্রস্তাবগুলো আগেই প্রত্যাখ্যান করেছিল।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, আইসিজের গত বৃহস্পতিবারের আদেশে মিয়ানমারের বড় ধরনের পরাজয় হয়েছে। গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকার নেই—মিয়ানমারের এমন যুক্তি আইসিজে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটি আগামী দিনে মূল মামলার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ এরই মধ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে আইসিজে। মিয়ানমারের প্রত্যাখ্যান করা প্রস্তাবগুলো আইসিজে আমলে নিয়ে আদেশ দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, আদেশের পর সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে মিয়ানমার সরকার তার দেশে অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থায় অপরাধের অভিযোগ সুরাহা করার বিষয়ে যে আশ্বাস দিয়েছে তা গত ডিসেম্বরে আইসিজেতে শুনানির সময়ও দিয়েছিল। মিয়ানমারের ওই সব উদ্যোগ অপর্যাপ্ত বলেই আদেশ দিয়েছে আইসিজে। তিনি আরো বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আইসিজে আদেশে উল্লেখ করেছে, জেনোসাইড কনভেনশনের আওতায় রোহিঙ্গারা সুরক্ষিত গোষ্ঠী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার অধিকার রাখে। এ ছাড়া আইসিজে তার সর্বসম্মত আদেশে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিও উচ্চারণ করেছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, মিয়ানমার আইসিজের আদেশ প্রত্যাখ্যান করেনি। এটি করার সুযোগও তার নেই। কারণ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মিয়ানমার ওই রায় মানতে বাধ্য। তবে মিয়ানমার আইসিজের আদেশকে গুরুত্ব না দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। রোহিঙ্গা নিপীড়নের দায়ে মিয়ানমারের জবাবদিহি প্রশ্নে সবচেয়ে বড় বাধা চীন নিজেও আন্তর্জাতিক আদালতগুলোর আদেশ মানে না।
জানা গেছে, আইসিজের আদেশ বা রায় বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। আইসিজের আদেশ নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো হবে। মিয়ানমার যদি আদেশ না মানে তাহলে আইসিজে বিষয়টি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নজরে আনবে। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রস্তাবে স্থায়ী সদস্যগুলোর ‘ভেটো’ দেওয়ার ক্ষমতা আছে। চীন এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ঠেকাতে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে আইসিজের আদেশের ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলো স্বপ্রণোদিত হয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে এবং দ্বিপক্ষীয়ভাবেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।
এদিকে আইসিজের আদেশ মেনে চলতে চাপ বাড়ছে মিয়ানমারের ওপর। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত বৃহস্পতিবার রাতে আইসিজের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, তিনি আইসিজের আদেশ দ্রুত নিরাপত্তা পরিষদে পাঠাবেন।
অন্যদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র লিজ থ্রোসেল গতকাল শুক্রবার দুপুরে জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে মিয়ানমারকে অবিলম্বে আইসিজের আদেশ বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়েছেন।
সানবিডি/এনজে