সীমান্তে রক্তের রাখিবন্ধনে গড়া বাংলাদেশ-ভারত সর্ম্পক
সান বিডি ডেস্ক প্রকাশ: ২০২০-০১-২৮ ১০:০২:০৫
‘সীমান্তে গরু আনতে গিয়ে নিহত হলে দায় নেবে না সরকার’ বাংলাদেশের বর্তমান সরকার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে যে কারোরই মনে হতে পারে এই কথাটি কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা বলেছেন। কিন্তু না, কথাটা বলেছেন বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী। ২৩শে জানুয়ারি নওগাঁর পোরশা উপজেলার দুয়ারপাল সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ জওয়ানদের গুলিতে তিন বাংলাদেশি নিহত হন। পোরশা সীমান্ত খাদ্যমন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকা বলে ২৫শে জানুয়ারি সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি ওই বক্তব্য দেন।
২০১৭ সালে একটি সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশের মিডিয়ায় প্রচণ্ড ভাইরাল হয়েছিল। গোবিন্দ গৌতম নামের এক নেপালি যুবক ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। এরপর ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল (ভারতের যেকোনো মন্ত্রীর চাইতে বেশি ক্ষমতাবান মানুষ ইনি) বিষয়টি নিয়ে নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহলের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেন। নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন দোভাল।
নিহতের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেন এবং ওই বিষয়ে তদন্তের জন্য নেপাল সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন দোভাল। নানা বিবেচনায় আমাদের চেয়ে দুর্বল রাষ্ট্র নেপালের ক্ষেত্রে ভারত যা করলো আমাদের ক্ষেত্রে কেন করে তার ঠিক উল্টোটা, এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে গত জুলাইয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা বাড়ার কারণ সীমান্তবর্তী এলাকার কিছু লোকের বেপরোয়া আচরণ। তাদের ব্যাপারে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) ও বিএসএফ’র প্রতিবদেন একই। তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা চলছে।’
বিজিবি’র পক্ষ থেকেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে বারবার। ২০১৬ সালে তৎকালীন বিজিবি প্রধান স্পষ্টভাবে জানান ‘গরু চোরাকারবারি বন্ধ না হলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ সম্ভব নয়’।
যুক্ত করছি সীমান্ত হত্যা সম্পর্কে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যও ‘সীমান্ত হত্যা বন্ধে ঢালাওভাবে ভারতকে দোষারোপ না করে আমাদের নিজেদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। আর যারা মারা যাচ্ছে, তাদের অধিকাংশই চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত।’
সর্বশেষ গতকাল আলোচিত বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ’র গুলি করে বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ করতে হলে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই বলে মনে করেন। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি আমরা, এই বক্তব্যগুলোর একটা কমন প্যাটার্ন আছে।
প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের যে গল্প আমরা শুনি তাতে আমাদের এটা জানানো হয় মৃত ব্যক্তির নামে কয়টি এবং কী ধরনের মামলা আছে। জনগণের কাছে এটা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয় যেহেতু এই ব্যক্তির নামে এই ধরনের অভিযোগ আছে, সেহেতু তাকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে মেরে ফেলা যায়।
ঠিক তেমনি সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের উঁচু পদে অসীনদের প্রত্যেকটা বক্তব্যে এটা প্রমাণ করার চেষ্টা আছে যেহেতু কিছু বাংলাদেশি সীমান্তে গরু চোরাচালান এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের সঙ্গে জড়িত, সেহেতু সে সব মানুষকে বিএসএফ গুলি করে মেরে ফেলতে পারে।
ধরে নেয়া যাক কিছু বাংলাদেশি গরু চোরাচালান কিংবা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ভারতে প্রবেশ করে। সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য পৃথিবীর আর সব দেশের মতো ভারতেও আইন আছে। আমাদের কেউ যদি অবৈধ অনুপ্রবেশ করেই থাকে তাহলে তাদের আইনের আওতায় নেয়াই একটা সভ্য রাষ্ট্রের পদক্ষেপ হওয়া উচিত। যদিও বিএসএফ নানা সময়ে এই হত্যার পেছনে একটা যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করে। তারা বলে শুধুমাত্র বিএসএফ আক্রমণের শিকার হলেই পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে তারা সীমান্তে গুলি করে। ব্যাখ্যাটা পরিচিত লাগছে না? হ্যাঁ, এটাই সেই ওত পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে এবং পুলিশও চালায় পাল্টা গুলি… এই গল্পের এই ভারতীয় সংস্করণ এটা।
অসাধারণ মানবিক কোনো সরকারের কথা বাদই দেই ন্যূনতম আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন কোনো সরকার যদি এই দেশে ক্ষমতায় থাকতো তাহলে তারা ভারতের সরকারকে খুব শক্তভাবে জানিয়ে দিতে পারতো কোনো বাংলাদেশি যদি কোনো কারণে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশ করে তাহলেও তাকে কোনোভাবেই বিএসএফ হত্যা করতে পারে না। সেই সরকার ভারতকে জিজ্ঞেস করতো প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র ব্যবহার দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা হলেও ভারত সেটা কেন সেটা মেনে চলছে না? সেটা এই সরকার করছে না, এমনকি চুপ থাকছে না। বরং সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের লোকজন এমন সব কথা বলছে যেটা এই ধরনের সীমান্ত হত্যার একটা শক্ত নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে দেয়।
এমন সময়ে সীমান্তে বাংলাদেশিদেরকে হত্যা করা হচ্ছে যখন সরকার দলীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, বাংলাদেশ-ভারত রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ দেশ। কিংবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথামতো ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর মতো সম্পর্ক বিরাজমান। এমন সম্পর্কের মধ্যেই আওয়ামী লীগের ১১ বছরে প্রায় ৩৫০ জন, গত বছর ৪৩ জন আর এই বছর এখন পর্যন্ত ১৫ জনকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাড়া স্থলসীমান্ত আছে পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান ও মিয়ানমারের। চীন ভারতের চাইতে অনেক বড় শক্তি, পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা আছে, এসব বিবেচনায় এই দুইটা দেশকে সরিয়ে রাখা যাক। কিন্তু বাকি দেশগুলো এমনকি বাংলাদেশের তুলনায় নানা দিক থেকে দুর্বল রাষ্ট্র। এইসব দেশের সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে মৃতের সংখ্যা শূন্য। বাংলাদেশ সরকারের লজ্জা হওয়া উচিত।
গোবিন্দ গৌতমের মৃত্যুর পর ভারতকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল, কারণ সে সময় নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দহল কারো করুণায় ক্ষমতায় আসেননি এবং ক্ষমতায় টিকে থাকেননি। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় থাকা দহল জনগণকে নিয়ে এই নৃশংসতার প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই নৈতিক শক্তি তার ছিল। ঠিক এখানেই বাংলাদেশ সরকারের খামতি।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেনা-পাওনা বিষয়টি খুব জরুরি। ভারত বাংলাদেশ থেকে কি পেয়েছে তা খুব স্পষ্ট হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর এক উক্তিতে। তিনি বলেছেন, ভারতকে যা দিয়েছি, সেটি তারা সারা জীবন মনে রাখবে। প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য এই দেয়ার বদলে ৫৪ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, তিস্তা চুক্তি, বাণিজ্য বৈষম্য, সীমান্তে কাঁটাতার, শুল্ক-অশুল্ক বাধা, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পক্ষ নেয়া, সিএএ এবং এনআরসি’র নামে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ পুশইন করার হুমকিসহ আরো অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার বাইরে যা পেয়েছে বাংলাদেশ তা হলো ভারতের প্রত্যক্ষ মদতে জনগণের ম্যান্ডেটহীন একটি সরকার এবং সীমান্তে বাংলাদেশিদের রক্তাক্ত লাশ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যথার্থই বলেছেন ভারতের সঙ্গে রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ বাংলাদেশ। তার কথা ‘মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যে সংহতি তা বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ এর সঙ্গে সহমত পোষণ করেই বলছি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির ফল হিসেবে নিয়মিত যে লাশ পড়ে তা ভারতের সঙ্গে আরেক রক্তাক্ত রাখিবন্ধন তৈরি করে, এবং সেটাও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়েই থাকবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।
লেখক: রুমিন ফারহানা, সংসদ সদস্য
সূত্র-মানবজমিন