বিপুর অংকের জরিমানা
৪০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী আটকা পড়েছেন লেবাননে
সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০১-৩০ ০৯:২৪:৩১
আর্থিক স্বচ্ছলতার আশায় তিন বছরের চুক্তিতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে লেবাননে যান ফরিদপুরের আসমা। সেখানে নিয়োগকর্তার বাসায় দুই বছর কাজ করার পর অতিরিক্ত অর্থ উপার্জনের আসায় অন্য জায়গায় কাজ শুরু করেন তিনি। এরপর থেকেই তিনি দেশটিতে অবৈধ হয়ে পড়েন। অবশেষে গত বছর সাধারণ ক্ষমার আওতায় নির্ধারিত জরিমানা দিয়ে দেশে ফেরেন।
তবে আসমা দেশে ফিরতে পারলেও তার মতো অনেকেই আছেন, যারা জরিমানার অর্থ দিতে না পারায় ফিরতে পারছেন না। তাদের বেশির ভাগই আট থেকে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অবৈধ হয়ে বসবাস করছেন লেবাননে। লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের দেয়া তথ্যমতে, ৪০ হাজারের মতো অবৈধ বাংলাদেশী রয়েছেন লেবাননে। ফেরার ইচ্ছা থাকলেও বিপুল অংকের জরিমানার কারণে তারা দেশে ফিরতে পারছেন না।
লেবাননের আইন অনুযায়ী, অবৈধভাবে অবস্থান করা কর্মীরা দেশে ফিরতে চাইলে প্রতি বছরের জন্য পুরুষদের ২৬৭ ডলার এবং নারী কর্মীদের ২০০ ডলার জরিমানা দিতে হয়। সেই সঙ্গে বিমান ভাড়ার অর্থও ওই কর্মীকে বহন করতে হয়। সে হিসেবে একজন কর্মী যদি পাঁচ বছর অবৈধভাবে দেশটিতে অবস্থান করেন, তাকে দেশে ফিরতে হলে জরিমানা বাবদ ১ হাজার ৩৩৫ ডলার (প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা) পরিশোধের পাশাপাশি বিমান ভাড়াও জোগাড় করতে হয়। যদিও অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত লেবাননের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ অর্থ জোগাড় করা প্রায়ই অসম্ভব।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে লেবাননের অর্থনীতি এখন খুবই নাজুক সময় পার করছে। দেশটি এখন ঋণের ভারে জর্জরিত। দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগে গত অক্টোবরে পদত্যাগে বাধ্য হন লেবাননের প্রধানমন্ত্রী। আর্থিক সংকট মোকাবেলায় ব্যয় সংকোচনের নীতিও বাস্তবায়নের চেষ্টা করছে দেশটি। যার ধারাবাহিকতায় বেতনভাতা কমিয়ে দেয়ার পাশাপাশি চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হচ্ছে অভিবাসী শ্রমিকদের। এ অবস্থায় লেবানন থেকে দেশে ফিরতে চাইলেও জরিমানার অর্থ পরিশোধের ব্যর্থতায় আটকা পড়েছেন অন্তত ৪০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী।
দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে সাধারণ ক্ষমায় অবৈধ বাংলাদেশীদের দেশে ফেরার বিশেষ সুযোগ দেয় লেবানন সরকার। বিশেষ ওই সুযোগে একজন শ্রমিক যত বছরই অবৈধভাবে থাকুন না কেন, তাকে শুধু এক বছরের জরিমানার অর্থ (পুরুষদের জন্য ২৬৭ ডলার ও নারীদের জন্য ২০০ ডলার) ও বিমান টিকিটের টাকা জমা দিয়ে দেশে ফিরতে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করা হয়।
লেবাননের জেনারেল সিকিউরিটি বিভাগ ঘোষিত সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিতে কোনো নির্দিষ্ট মেয়াদ নেই বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ দূতাবাস। গত বছর তিন ধাপে দূতাবাস অবৈধ প্রবাসীদের নাম নিবন্ধনের সুযোগ দেয়। যার প্রথমটি গত বছরের সেপ্টেম্বর, দ্বিতীয়টি নভেম্বর ও তৃতীয় ধাপটি ডিসেম্বরে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু লেবাননে অস্থিরতার কারণে নভেম্বর ও ডিসেম্বরে নাম নিবন্ধনের কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, অবৈধ শ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশনের জন্য বাংলাদেশ দূতাবাস মাত্র তিনদিন (১৫, ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর) সুযোগ দেয়। ওই তিনদিনে মাত্র আড়াই হাজার অবৈধ প্রবাসী তাদের নাম নিবন্ধনের সুযোগ পান। তাদের মধ্যে প্রাথমিক ধাপে ৪৫০ বাংলাদেশী দেশেও ফিরেছেন। বঞ্চিত হন অন্তত ৪০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী।
লেবানন সরকারের সময়সীমা অনির্দিষ্ট থাকলেও দূতাবাস কেন এত স্বল্প সময় বেঁধে দিয়েছিল— এমন প্রশ্নের উত্তরে লেবাননের বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আবদুল মোতালেব সরকার বণিক বার্তাকে জানান, লেবাননের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী অবৈধ প্রবাসীদের দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়াটা জটিল। তাছাড়া সব ধরনের কাগজপত্র দূতাবাস থেকে যাচাই-বাছাই করতে হয় বলে অনেক সময় লেগে যায়। এছাড়া লোকবলের অভাবে এত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশীকে একসঙ্গে সুযোগ দেয়াটাও কঠিন। তাছাড়া নিবন্ধন করালেও এসব প্রবাসীকে দেশে পাঠানোর জন্য ফ্লাইটের সমস্যাও রয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তিনি আরো বলেন, অনেক নিবন্ধন করিয়ে হাতে যথেষ্ট টাকা না থাকার কারণে তারা সময়টা দীর্ঘায়িত করেন, যে কারণে এটাও এক ধরনের সমস্যা।
জানা গেছে, বেশ কয়েক বছর ধরে লেবাননে অভিবাসী কর্মী ছাঁটাই, অবৈধ অভিবাসন, পলায়ন, অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়াসহ নানা ঘটনা ঘটছে। আর এসব কারণে বাজারেও সংকট তৈরি হয়েছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর গড়ে ১৬ হাজার করে কর্মী দেশটিতে গেলেও গত তিন বছরে গেছেন মাত্র ১৯ হাজার। অন্যদিকে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে টিকতে না পেরে গত তিন বছরে ফিরে এসেছেন পাঁচ হাজার কর্মী। তাদের মধ্যে অসুস্থ হয়ে দেশে ফিরেছেন ৫০০-এর মতো বাংলাদেশী। তবে কাগজে-কলমে গত বছর (২০১৯) ফিরে গেছেন ১ হাজার ২৫০ জন বাংলাদেশী। ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন আরো অন্তত আড়াই হাজার।
লেবাননে বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম কাউন্সিলর আব্দুল্যাহ আল মামুন জানিয়েছেন, লেবানন থেকে বাংলাদেশীদের দেশে ফিরে যাওয়ার কারণ মূলত দেশটির আর্থিক মন্দা। এটি শুধু বাংলাদেশীদের সংকট নয়, এটা লেবানিজদেরও সংকট। আর এ আর্থিক মন্দায় কর্মী ছাঁটাই হবে এটাই স্বাভাবিক। তবে যারা বৈধ আছেন, তাদের ক্ষেত্রে ছাঁটাইয়ের সংখ্যাটা খুবই কম।
জনশক্তি রফতানি ও কর্মসংস্থান উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যমতে, লেবাননে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৬৭ হাজার বাংলাদেশী কর্মী গেছেন। তাদের মধ্যে নারী কর্মী গেছেন ১ লাখ ৭ হাজার। দেশটিতে ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৩২৭ জন, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৯৯১ ও ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৮৬৩ জন বাংলাদেশী গিয়েছেন।
বেসরকারি সংস্থা ‘রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ড. তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, শ্রমবাজারে অস্থিরতা দূর করতে হলে মধ্যস্বত্বভোগীদের (দালাল) থামাতে হবে। কারণ কাজ না থাকার পরও শ্রমবাজারে কর্মী পাঠায় তারা। যে টাকা দেবেন বলে কর্মীদের সঙ্গে চুক্তি হয়, সেটি দেন না তারা। যে কারণে এ ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে। শ্রমবাজারে এমন ঘটনা কমাতে হলে দেশের অভ্যন্তরে দক্ষ মানবসম্পদ প্রস্তুত করার কোনো বিকল্প নেই। এটা করতে পারলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। সুত্র-বণিক বার্তা