ভারত থেকে ম্যালেরিয়া জীবাণু নিয়ে ফিরছেন শ্রমিকরা

সান বিডি ডেস্ক আপডেট: ২০২০-০২-০১ ০৯:১৬:২৫


বেঁচে থাকার তাগিদে বিভিন্ন সময় কাজের খোঁজে সীমান্তবর্তী ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যাতায়াত করেন সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনার শ্রমিকরা। জীবিকার অন্বেষণে গিয়ে প্রতিবেশী দেশের পাহাড়ি এ রাজ্যে গিয়ে এসব শ্রমিকের বড় অংশই ফিরে আসেন ম্যালেরিয়ার জীবাণু নিয়ে। এ কারণেই দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলাগুলোর মধ্যে নেত্রকোনায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের এক পর্যবেক্ষণ বলছে, নেত্রকোনা জেলায় ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ওই অঞ্চলের মোট রোগীদের অর্ধেকের সমান।

ব্র্যাকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নেত্রকোনা জেলার ৭ শতাংশ মানুষ ম্যালেরিয়ার জীবাণু বহন করে থাকে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের ফলাফল বিশ্লেষণ করে সংস্থাটি বলছে, ভারতের মেঘালয় থেকে ফিরে আসা মানুষদের মধ্যে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব ৬০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল, যাদের ৯৩ শতাংশ পেশায় শ্রমিক। মূলত ভারতের মেঘালয়ের বিভিন্ন কয়লা ও পাথর খনিতে কাজ করতে গিয়ে সেখানে এক থেকে দুই বা ততোধিক সপ্তাহ ধরে অবস্থানকালে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন তারা।

জেলাটির ম্যালেরিয়া রোগীদের সবাই যে মেঘালয় থেকে আক্রান্ত হয়ে দেশে এসেছেন তা নয়। স্থানীয় দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার পাহাড়ি জনপদের মশার কামড়েও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকেই। আক্রান্তদের মধ্যে শ্রমিকের পাশাপাশি কৃষক, গৃহিণী ও শিক্ষার্থীও রয়েছেন।

মেঘালয় সীমান্তবর্তী জেলা নেত্রকোনার ভৌগোলিক কাঠামোয় রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। একদিকে গারো পাহাড়, অন্যদিকে হাওড়। বয়ে গেছে সোমেশ্বরী, মনগড়া, কংস, ধনুসহ বেশ কয়েকটি নদী। এ জনপদের, বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের জীবনও সংগ্রামের। দারিদ্র্যের কারণে জীবিকার খোঁজে প্রতিবেশী মেঘালয়ে ছোটেন সেখানকার শ্রমিকরা। মেঘালয়ে কাজের সন্ধানে গিয়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া রোগীদের ৮৪ শতাংশই পুরুষ, যাদের মধ্যে ৯৫ শতাংশই আবার বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সদস্য বলে উঠে এসেছে ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণে।

নেত্রকোনায় ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব নিয়ে ব্র্যাকের পর্যবেক্ষণকাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা শামসুন নাহার। ব্র্যাকের সংক্রমণ রোগ (ম্যালেরিয়া) কর্মসূচির ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে তিনি বলেন, এলাকাটি সীমান্তবর্তী হওয়ায় ওখানকার লোকজনের, বিশেষ করে শ্রমিকদের মেঘালয়ে যাওয়া-আসা থেকে রোগটির সংক্রমণ হয়ে থাকে। আমাদের বিশ্লেষণে সেটাই ধরা পড়েছে। মূলত কয়লা বা পাথর খনিতে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার পর মেঘালয়ের পাহাড়ি মশার কামড় থেকে তারা সংক্রমিত হয়ে থাকেন, যেটা পরবর্তী সময়ে দেশে আসার পর ছড়িয়ে পড়ে।

তিনি জানান, সরকারি-বেসরকারিভাবে স্থানীয় লোকদের সচেতন করার ফলে এখন মেঘালয়ে শ্রমিকদের যাতায়াত কিছুটা কমলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। মেঘালয়ের পাশাপাশি নেত্রকোনার স্থানীয় পাহাড় থেকেও ম্যালেরিয়া ছড়াচ্ছে। অঞ্চলটি কিছুটা দুর্গম হওয়ায় সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন ব্র্যাকের এ কর্মকর্তা।

৭১৩ জনের ওপর চালানো ব্র্যাকের এ পর্যবেক্ষণ বলছে, ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী আক্রান্ত রোগীদের ৮২ শতাংশই মেঘালয় থেকে ম্যালেরিয়া রোগের জীবাণু নিয়ে আসেন। কাজের জন্য মেঘালয়ে অবস্থানের ফলে এ বয়সী রোগীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এছাড়া ৫০ বছরের বেশি বয়সী ১১ শতাংশ, পাঁচ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের ৬ শতাংশ এবং পাঁচ থেকে কম বয়সী ১ শতাংশ রোগী ভারত থেকে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফেরে। আর ভারতে গিয়ে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা ১৬ শতাংশ।

পর্যবেক্ষণকালের হিসেবে ব্র্যাকের বিশ্লেষণ করা তথ্য বলছে, ২০১৩ সালে নেত্রকোনায় মোট ম্যালেরিয়া আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১৪৪ জন, যার মধ্যে ৬০ শতাংশই ভারতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। পরের বছর ২০১৪ সালে মোট ১৮২ রোগীর মধ্যে ১৪৯ জনই ভারতে গিয়ে আক্রান্ত হন। ২০১৫ সালে রোগীর সংখ্যা নেমে ১৩৯ জন হলেও ওই বছর আক্রান্তদের ৮৭ শতাংশই ছিলেন ভারত ফেরত। এরপর ২০১৬, ২০১৭ ও ১০১৮ সালে ভারত থেকে আক্রান্ত হওয়া রোগীর হার ছিল যথাক্রমে ৯১, ৭১ ও ৯৫ শতাংশ।

ম্যালেরিয়া নিয়ে আপাতত কোনো শঙ্কা নেই বলে জানিয়েছেন নেত্রকোনার সিভিল সার্জন ডা. মো. তাজুল ইসলাম খান।  তিনি বলেন, কলমাকান্দা ও দুর্গাপুর উপজেলা সীমান্তের কাছাকাছি হওয়ায় সেখানে অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব কিছুটা বেশি ছিল। মেঘালয় থেকে শ্রমিকরা এ রোগ নিয়ে ফিরতেন। এখন কয়লা ও পাথরের ব্যবসা সেভাবে না থাকায় শ্রমিকদের যাতায়াত কমেছে। রোগীর সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে। কিছুদিন আগে একজন রোগী মারা গেলেও বড় আকারে এটা ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই।

সাম্প্রতিক সময়ে অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারিভাবে ওই এলাকাগুলোয় সচেতনতামূলক কর্মসূচির পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে রোগী শনাক্তকরণ ব্যবস্থা ও সেবা কার্যক্রম চলমান রাখা হয়েছে, যাতে সম্ভাব্য বড় ধরনের সংক্রমণ থেকে জনগণকে সুরক্ষা দেয়া যায়।

সানবিডি/এনজে